‘অর্ঘ্য’ মিরপুর রোড ও গ্রিন রোডের মিলনস্থলে বানানো অনেকটা বদ্বীপের মতো দেখতে ছোট একটি উদ্যান, যার অবস্থান সায়েন্স ল্যাবরেটরির সড়কদ্বীপে। চোখজুড়ানো সড়কদ্বীপ পথচারীদের চোখকে আরাম দেয়। এতে আছে মিনি লেক, দুটি মিনি জলাধার। নানা ধরনের ছোট ছোট মাছ আছে, সেই সাথে বেশ কিছু জলজ উদ্ভিদ। জলাধারে পদ্ম ফুলও ফোটে আর তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ওদের সঙ্গেই থাকে হাঁস, সুযোগ পেলে লেকের পানিতে ডুব দেয়, সাঁতার কাটে। তৃষ্ণা মেটাতে আসে পাখিরা। আরও থাকে ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক। সারা বছর কত রঙের ও জাতের যে ফুল ফোটে আর তাদের টানে ছুটে আসে রঙিন প্রজাপতি, ফড়িং। বিভিন্ন প্রজাতির গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে দোয়েল, শালিক, চড়ুই। কৃত্রিম পাহাড়ের চূড়ায় বসানো ঘর, তাতে কবুতর ডাকে বাকবাকুম। কালো টাইলসে বানানো ভাস্কর্য রয়েছে ভেতরে।
রাজধানী ঢাকায় হাতে গোনা কয়েকটি সবুজ দৃষ্টিনন্দন সড়কদ্বীপ ছিল। এদের মধ্যে অন্যতম দুটি সড়কদ্বীপ পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে অবস্থিত ‘নগরে নিসর্গ’ ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির ‘অর্ঘ্য’। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে ইজারা নিয়ে সড়কদ্বীপ দুটিতে নান্দনিক সবুজায়ন করেছিল ‘হেরিটেজ ক্রিয়েটিভ কাউন্সিল’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন। নকশা ও মূল পরিকল্পনায় ছিলেন স্থপতি রাফেয়া আবেদিন। সাধুবাদ তাদের নিঃসন্দেহে প্রাপ্য। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের ভালোবাসার ‘নগরে নিসর্গ’ এখন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের ব্যস্ততম সড়কে ‘নগরে নিসর্গ’ সড়কদ্বীপ পথচারীদের প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিত। কিন্তু সেসব এখন অতীত। সড়কদ্বীপটি ভেঙে সেখানে বিশাল ডিজিটাল বিলবোর্ড বসিয়েছে সিটি করপোরেশন। অথচ সড়কদ্বীপটিই ছিল ওই এলাকার একমাত্র সবুজ স্থান। এবার সায়েন্স ল্যাবরেটরির ‘অর্ঘ্য’ সড়কদ্বীপটিও সিটি করপোরেশন থেকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। শুরু হয়েছে তোড়জোড়। ভাঙার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বুদ্ধিজীবী, স্থাপত্যবিদ, নাট্যকার, সমাজসংস্কারক, পরিবেশবাদী, প্রকৃতিপ্রেমী সচেতন নাগরিক।
এখন যেখানে ‘অর্ঘ্য’ আগে সেই জায়গাটি পরিত্যক্ত ছিল। ১৮ কাঠার এই জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে বিআরবি কেবল কোম্পানি। সেখানে নাকি তারা বহুতল বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করবে। বসবে এলইডি বিলবোর্ড। কৃত্রিম রঙিন আলো ও শব্দের কারণে পাখি আসবে না, মানুষের চোখ ও মন পীড়িত হবে। হেরিটেজ ক্রিয়েটিভ কাউন্সিল যেভাবে এর সবুজায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে রাজধানীর এই স্থাপনা নজরকাড়া রূপ ধরে রেখেছিল, সেটিও দিন কয়েক বাদে শুধুই স্মৃতি হিসেবে আর পুরোনো ছবির অ্যালবামে রয়ে যাবে? ঠিক যেভাবে ‘নগরে নিসর্গ’ হারিয়ে গেছে?
মন্দ থেকে আরও মন্দের দিকে যাওয়াই কি আমাদের নিয়তি? মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির পরিবেশ ও বাতাস ছিল ভয়াবহতম দূষিত। যানজট তো ছিলই। সেই শহরটির নগর কর্তৃপক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি লতাগুল্ম, ঘাস আর পাতাবাহারের বাগান করেছে। মাটিতে জায়গা নেই বলে, বাগানগুলো তারা করেছে খাড়াখাড়ি। দেয়াল, উড়ালসড়কের থাম, সড়কদ্বীপ, সড়ক বিভাজক, যেখানেই জায়গা পেয়েছে, সেখানটাকেই তারা সবুজ বানিয়েছে। কুৎসিত দৃশ্যগুলো সুন্দর হয়েছে, বাগানের ছাড়া অক্সিজেনে বাতাস পরিষ্কার হয়েছে, পরিবেশ হয়েছে মনোরম। শহরটাকে তারা সুন্দরের দিকে বদলে দিয়েছে। আর আমরা যাত্রা করছি অসুন্দর থেকে কুৎসিতের দিকে।
এমনিতেই নগরের বিভিন্ন উন্নয়নকাজ করতে সড়ক বিভাজকের বনায়নসহ অনেক গাছ কাটা পড়ছে, কাজেই বহু ক্ষতি ইতিমধ্যে আমরা করে ফেলেছি। আরও কেন? প্রাণিকুল, সবুজ–স্নিগ্ধ প্রকৃতি হারিয়ে আমাদের জীবন আর কত যন্ত্রময় করতে হবে? নিত্যদিনের যানজট, জীবন অতিষ্ঠ করা মশা, দ্রব্যমূল্যের প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকট, গণপরিবহনের স্বল্পতা—সবকিছু রাজধানীর মানুষ সহ্য করেই চলেছে। সবকিছুর বিনিময়ে রাস্তার মাঝে ও পাশে গাছ, ফুলের সুবাস, একটু ছায়া—এসব কি অনেক বেশি কিছু চাওয়া? আমরা মানুষ বলেই আর্তনাদ করতে পারছি। কিন্তু প্রাণী, পাখি, গাছপালার বুকচেরা হাহাকার, কান্না, নীড় হারানোর ভয়ে গুটিয়ে থাকাও কি আপনারা উপলব্ধি করেন না? এত নিষ্ঠুর আপনারা? এত হৃদয়হীন?
সবুজ বিলীন হতে চলা এই নগরে মানুষের চাওয়ার বিপরীতে অযত্নে, অবহেলায়, তাচ্ছিল্যে বাদবাকি সবুজও ধুঁকছে। এ যেন ছায়াহীন কংক্রিটের এক প্রেতপুরী। সড়ক বিভাজকে যেসব গাছ লাগানো আছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকগুলোই মৃত। কিছু গোড়াসহ উপড়ে ফেলা। কোথাও শূন্য বেড়া জানান দেয়, একসময় সেখানে একটা বৃক্ষ বাঁচতে চেয়েছিল। এভাবে আমরাও অযত্নে, উপড়ে ফেলার টানে ধুঁকছি না কি এই শহরে?
তানজিনা আকতারী: সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার।