তারেক-মিশুকের মামলার রায় ও ক্ষতিপূরণের আইন

মিজানুর রহমান খান

আজ রোববার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের সড়ক দুর্ঘটনা মামলায় ক্ষতিপূরণ বিষয়ে একটি রায় দেওয়ার তারিখ স্থির আছে। ২০১১ সালের এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁদের অকালমৃত্যু দেশ-বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘাতক চালকের যাবজ্জীবন শাস্তির রায় দেওয়া হলেও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসেনি। ২০১০ সালের ১১ মে হাইকোর্ট বিভাগ দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর মামলায় বলেছিলেন, ‘টট আইন দেশে কমবেশি কাগজেই আছে, চর্চায় নেই।’ বিচারপতি শরিফউদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি মো. নুরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ উক্ত বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লি. বনাম রওশন আখতার মামলায় আরও বলেছিলেন, যদি ক্ষতিপূরণ দিতে হতো, তাহলে সড়কে মৃত্যু নিশ্চয় কমত।

আইনজীবী ফজলে নূর তাপস ওই মামলায় নিহত বার্তা সম্পাদকের বিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছিলেন, নিহত সাংবাদিক অবসর গ্রহণের আগের ১৮ বছরে বেতন ও গ্র্যাচুইটি বাবদ ৫১ লাখ ৪৭ হাজার ৮ টাকা পেতেন। বাদিনীর দাবি ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে দুই নাবালক সন্তানরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিল। রায়দানের তারিখ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮ টাকা শোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

গতকাল শনিবার টেলিফোনে মার্কিন বংশোদ্ভূত প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার ও প্রয়াত তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে কথা হলো। তাঁর ধারণা, বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষতিপূরণ আইনের যে বিরাট ঘাটতি চলছে, সেটা আজকের রায়ের মাধ্যমে অনেকাংশে পূরণ হতে পারে। এ কথা খুবই খাঁটি যে টট বা ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেশ অপ্রচলিত বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর জোনাকি সিনেমা হলের কাছে রং সাইড থেকে আসা কোমল পানীয় বোঝাই মিনিট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেই ঘটনার মতো কিছু হাতে গোনা নজির রয়েছে, যাতে আমরা উচ্চ আদালতের রায়ে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বাধ্য হতে দেখেছি। কিন্তু সেসব সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কখনো কোনো সুস্পষ্ট গাইডলাইন তৈরি হয়নি। দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু ঘটা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কমবেশি ‘আল্লাহ মাল’ হিসেবেই গণ্য হয়ে চলছে। সড়ক বা নৌপথ শাসনে রাষ্ট্রের যে চরম ব্যর্থতা, তা আড়ালেই চাপা পড়ে থাকছে।

দেশের আইনি ইতিহাসে তাই আজকের দিনটি অসামান্য তাৎপর্যময় হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ, যার আওতায় হাইকোর্ট বিভাগ ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন বিবেচনায়’ নিম্ন আদালতকে বিচার করতে না দিয়ে নিজেই সরাসরি বিচার করে দিতে পারেন, তার আওতায় সম্ভবত এই প্রথম আমরা এমন একটি রায় পাচ্ছি। আইনজীবীরা আশা করছেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে একটি আইনি শূন্যতা পূরণ হবে। এর আগে বড়জোর দু-চারটি বিরল নজির তৈরি হয়েছে, যাতে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। এর আগে ক্ষতিপূরণের যেসব মামলায় ভুক্তভোগীরা সাফল্য পেয়েছেন, তার কোনোটিই ১১০ অনুচ্ছেদের আওতায় নয়। কোনো ক্ষতিপূরণের মামলায় তাই এবারই সম্ভবত নতুন নজির তৈরি হতে চলেছে।

বিদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকারবিষয়ক টট আইন সম্পর্কে দেশবাসী প্রথমবারের মতো একটি দিকনির্দেশনা পেতে পারেন। তারা জানতে পারেন, ক্ষতিপূরণ দিতে রাষ্ট্র, সমাজ ও দায়ী ব্যক্তি বা সংগঠনের কী করণীয়?

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের অক্টোবরে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা দুটি মামলা হাইকোর্টে বদলি হয়। বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টিকে অত্যন্ত জনগুরুত্বসম্পন্ন হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

ক্যাথরিন মাসুদ আশা করেন, হাইকোর্টের নতুন রায় অনাদিকালের ভুক্তভোগীদের জন্য একটি মাইলফলক রায় হিসেবে গণ্য হতে পারে। তিনি স্মরণ করেন, মানিকগঞ্জ আদালতেই মোটরযান অর্ডিন্যান্সে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদের আওতায় ওই দুটি মামলার শুনানি ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার এখতিয়ার সরাসরি হাইকোর্টের আছে বলে উচ্চ আদালতে ২০১৩ সালে আরজি পেশ করেছিলেন। মামলার বিবাদী বিশেষ করে রিলায়েন্স বিমা গ্রুপ শুনানিতে ওই যুক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ক্যাথরিন মাসুদসহ তিনজন ও মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী ও ছেলে সুহৃদ মুনীরের দায়ের করা মামলার প‌ক্ষে ড. কামাল হোসেন ও সারা হোসেন ১১০ অনুচ্ছেদ কেন ও কীভাবে এই মামলায় প্রয়োগযোগ্য, তা ব্যাখ্যা করেন। হাইকোর্ট বেঞ্চ তা গ্রহণ করেন।

রিলায়েন্স গ্রুপ বলেছিল, প্রধানত চারটি কারণে হাইকোর্ট এই ক্ষেত্রে সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করতে পারেন না। তাঁরা তাদের প‌ক্ষে প্রধানত চারটি যুক্তি দেন।

এক. বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের আদালত ক্ষতিপূরণ নির্দিষ্ট করার নীতি চূড়ান্ত করেছেন।

দুই. বাদীপক্ষ যে মামলা আদালতের সামনে এনেছে, তার ধরনটা হলো বিবিধ মামলা, এ কারণে এটা জনগুরুত্বসম্পন্ন হতে পারে না। এর ফলে শুধু সংশ্লিষ্ট মামলার পক্ষগণ (ক্যাথরিন মাসুদ, কানিজ এফ কাজী প্রমুখ) লাভবান হবেন।

তিন. আবেদনকারীরা ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিক্যাল আইনের ১৩০ ধারার ব্যাখ্যা চেয়েছেন। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ বিধান। এ কারণে এরূপ বিধানের ব্যাখ্যা দেওয়া প্রশ্নে কোনো মামলা স্থানান্তরযোগ্য নয়।

চার. সংসদ মোটরযান আইনের ১৩৬ ধারার আওতায় ক্ষতিপূরণ দিতে বিআরটিএকে কর্তৃত্ব দিয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগ এরূপ কর্তৃত্ব জবরদখল করতে পারে না। আদালত ওই যুক্তি নাকচ করে বলেছিলেন, আমরা যদিও একমত যে ১১০ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত এখতিয়ার কেবল বিরল‌ ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আলোচ্য মামলা তেমনই একটি ব্যতিক্রমী মামলা।

আমরা তিন কারণে এই যুক্তিগুলোর বিপক্ষে
প্রথমত, এটি বিবিধ মামলা হলেও এতে আইনের উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন এবং সাধারণ জনগুরুত্বের বিষয় জড়িত।

দ্বিতীয়ত, আমরা যদি ১১০ অনুচ্ছেদের আওতায় এই মামলা বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্টে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তাহলে হাইকোর্ট বিভাগের কোনো একটি বেঞ্চ ভবিষ্যতে রিভিউ করতে পারবেন। তারা খতিয়ে দেখবেন, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মধ্যেও টট আইনটি চালু করা যায় কি না।

তৃতীয়ত, হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এখন সময় এসেছে কী করলে টট হয়, সেটা বুঝতে ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা দরকার। অধস্তন আদালত কী করে এবং কী মানদণ্ডে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। তাঁরা কীভাবে যাচাই করবেন, কখন ও কী মূল্যায়নের ভিত্তিতে কাকে কতটা কী উপায়ে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

এর উত্তর খুঁজতে ওই হাইকোর্ট বেঞ্চ চার বছর আগে একটি উপযুক্ত বেঞ্চ গঠনে প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরণ করেছিলেন। আজ তাঁর রায় দেবেন বিচারপতি জিনাত আরার নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চ। ওই দুর্ঘটনায় মোটরযান অর্ডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ২০১২ সালে করা মামলা দুটি মানিকগঞ্জ জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা নামক স্থানে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে ঘটনাস্থলেই তারেক-মিশুকসহ পাঁচজন নিহত হন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের আদালত তাঁদের হত্যার দায়ে বাসের ঘাতক চালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন।

ওই রায়ের পরে মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী বলেছিলেন, ‘এই রায় নজির হিসেবে ব্যবহার হবে, অন্য যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরাও বিচার পাবেন।’ তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ বলেছিলেন, পৃথিবীর কোনো আদালত আর তাঁদের ফিরিয়ে দিতে পারবে না। তবু এই রায় কিছুটা হলেও তার দায় মেটাল।’ তবে কোনো সন্দেহ নেই, এই মামলার বিচারপ্রার্থী হিসেবে তাঁরা সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদের আওতায় যে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন, তার মূল্য ওই রায়ের থেকে বহুগুণে বেশি ও বিস্তৃত। যদি একটি পূর্ণাঙ্গ টট আইন পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে এটি সত্যিই তৈরি করবে একটি যুগান্তকারী অবদান।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক

Advertisement