:: জোয়েরজেন মোয়েলার ::
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে চিহ্নিত করেছে একটি বিকার, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির আকস্মিক ফল, একটি রাজনৈতিক প্রপঞ্চ, নিশ্চিতভাবে একটি উৎপাত, এমনকি ভীতিকর ও ভবিষ্যদ্বাণী অযোগ্য মানুষ হিসেবে। তারা এমনটি বলার কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের কেউ নন এবং তিনি ‘তাদের একজন’ হতে চানও না।
বস্তুত বিশ্বায়নের ধাক্কায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া হতাশার গভীরতা এলিটরা বুঝতে পারেননি- এর ওপর ভিত্তি করেই ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি নিজের তৈরি নীতিতে চাল চেলেছেন, নিজের রীতিতে অবিচল থেকেছেন এবং তিনি জানতেন তিনি কী করছেন, কী চাচ্ছেন এবং কীভাবে সেসব পাওয়া যায়।
সফল হওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে অনেক বন্ধু তার দরকার ছিল এবং তিনি তাদের পেয়েছেনও। আমেরিকার রাজনীতির কর্তৃত্ব বড় বড় তেল কোম্পানি ও কর্পোরেশনের আওতায় চলে গেছে। এর বড় লক্ষ্য হল যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়ি ঘোরানো, বৈশ্বিক খনিজ জ্বালানির তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক হওয়া এবং নিট রফতানিকারক হওয়া, বিশেষত তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রফতানির ক্ষেত্রে। এর অন্যতম লক্ষ্য হল বড় বড় ব্যবসায়ীকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয়া।
এসব লক্ষ্যমাত্রার চূড়ান্ত অর্জনে ট্রাম্প পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল ও প্রস্তুত করেছেন। এজন্য আগের প্রশাসনগুলোর রেখে যাওয়া প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে এবং অফশোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে (বেনামি কোম্পানি) অন্তর্ভুক্ত করাসহ তাদের কাজ করার সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার (এপিএ) বর্তমানে মূল লক্ষ্য পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, বিপরীতে পরিবেশগত মানোন্নয়ন এবং বিষাক্ত বস্তুর হাত থেকে মানুষকে রক্ষায় নেয়া নীতি ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাজের একটি দীর্ঘ তালিকাকে বাতিল করে দিতে এটি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নেয়া বিধিনিষেধগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বেপরোয়া আচরণের দরজা খুলে দেয়া হচ্ছে, যেসব আচরণের কারণে ২০০৮-০৯ সালে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
২০১৭ সালের শেষের দিকে কর সংস্কারের একটি পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছে কংগ্রেস। এতে কর্পোরেট কর কমিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে করে বড় বড় তেল সংক্রান্ত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুবিধা পাইয়ে দেয়া যায় এবং উচ্চ আয়ের পক্ষগুলোকে তুলনামূলক কম ট্যাক্স দিতে হয়। মূলত, এটি হচ্ছে রিপাবলিকানদের নীতি যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পদক্ষেপ হিসেবে ভোটারদের বোঝানো হয়েছে; কিন্তু সরকারি ঋণ এবং মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য এর মধ্যমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব কী হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি।
এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পররাষ্ট্রনীতিও সেভাবে সাজানো হয়েছে। ভবিষ্যতে সম্ভবত সবচেয়ে বড় হতে যাওয়া চীনা এলএনজি মার্কেটকে অবশ্যই পরাজিত করতে ও বশে আনতে হবে। এমন নীতি ব্যাখ্যা করছে যে, পররাষ্ট্রনীতি হতে যাচ্ছে চীন ও উত্তর কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস রফতানিকারক দেশগুলোর মুখোমুখি অবস্থান নেয়ার মতো।
কূটনৈতিক মহলে আলোচিত গুজব অনুযায়ী আরও বেশি আগ্রাসী একটি বাণিজ্যনীতি পাইপলাইনে আছে। এটি কেবল বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্যাঞ্চল নাফটাকেই খোজা করছে না, একইসঙ্গে সাময়িক আমদানি বিধিনিষেধের সুনির্দিষ্ট ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে। ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিজের সমর্থনের ঘাঁটি সুরক্ষিত রাখার জন্য ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।
বিদেশিদের আমেরিকায় প্রবেশ আরও কঠিন করার জন্য একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং এটিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ থেকে আমেরিকানদের সুরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে। ঘোষণামূলক নীতির চমৎকার ব্যবহার হিসেবে এটি ভালোই শোনাচ্ছে এবং ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বিদেশিভীতিও তৈরি করছে।
মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরির বিষয়টি আলোচনা থেকে বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে ৭শ’ মাইলের বেশি দেয়াল তৈরির জন্য কংগ্রেসের কাছে ১৮শ’ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। ওবামাকেয়ার বা স্বল্পমূল্যের স্বাস্থ্যসেবানীতি বাতিল করা যায়নি; কিন্তু নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এর আর্থিক প্রবাহ আটকে দেয়া হয়েছে। ফলে এটি যেমনটি হওয়ার কথা ছিল, তার পরিবর্তে নিজের ছায়া হয়ে পড়েছে।
সংকট পার করে নিজের এসব নীতিকে সাহায্য করার জন্য রাষ্ট্রের তিন মূল স্তম্ভ- নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগকে কোনো না কোনো পথে নিয়ন্ত্রণ বা পাশ কাটিয়ে যেতে হয়েছে ট্রাম্পকে। এজন্য তিনি সংবিধান বা রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও শিষ্টাচার কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। নির্বাহী বিভাগ আর্থিক ও জনবলের ক্ষেত্রে তীব্রভাবে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ভেঙে দেয়ার ওপর আলোকপাত করছে।
আইন বিভাগকে বোকা বানিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রশাসন চালাতে পছন্দ করেন ট্রাম্প। এজন্য কংগ্রেসকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সমঝোতার বিষয় প্রায় সব সময়ই উপেক্ষা করা হয়েছে। কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের সঙ্গে ট্রাম্পের অংশীদারিত্ব মূলত হয়েছে ওবামা যুগের নীতি-নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের জন্য।
প্রেসিডেন্টের কিছু নির্বাহী আদেশ আটকে দেয়ার চেষ্টা করা বিচার বিভাগকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ট্রাম্পের প্রশাসন। অন্য যে কোনো পূর্বসূরির তুলনায় প্রেসিডেন্ট তার মেয়াদের প্রথম বছরে বহু ফেডারেল বিচারক নিয়োগ করার জন্য বিচার বিভাগের অনেক শূন্যপদ পূরণের সুযোগটি প্রায় পর্দার আড়ালেই নিয়েছেন।
নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য, এমনকি প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার বৈরিতা কাজে লাগাতেও সক্ষম হয়েছেন ট্রাম্প। ক্যাবল নেটওয়ার্ক ও পত্রিকাগুলো জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে এবং ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করছে- এমন অভিযোগ তুলে মূলধারার মিডিয়া হাউসগুলোকে প্রত্যাখ্যানের জন্য তিনি নিজের সমর্থকদের উৎসাহিত করেছেন। তবে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণভাবে যেসব বড় নীতি তিনি বাস্তবায়ন করতে চান সেগুলো থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে নিজের অভিব্যক্তির সঙ্গে মিডিয়া আচ্ছন্নতাকে ব্যবহার করেছেন তিনি।
নিয়মিতভাবে করা তার বিতর্কিত টুইটের দিকে মূলধারার মিডিয়া ও সাধারণ মানুষ মনোযোগী হওয়ার কারণে যা তিনি চেয়েছেন, তার বেশির ভাগই রাডারের নিচ দিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। সংক্ষেপে, তিনি যা চান তা অর্জনে নিজেকে খুবই কার্যকর প্রমাণ করেছেন ট্রাম্প। আর এগুলোই তাকে বেশ বিপজ্জনক বানিয়েছে।
এক বছরজুড়ে ট্রাম্প প্রমাণ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বেপরোয়া ও বাজে বলে বিবেচিত সিদ্ধান্তগুলো থেকে প্রেসিডেন্টকে বিরত রাখার জন্য ভারসাম্য রক্ষার যে পদ্ধতি ছিল, তা সত্যিকারার্থেই যথাযথভাবে কাজ করে না। যতটুকু সময় তিনি নিজের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পার করেছেন, এতেই সম্ভবত মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও বৈদেশিক সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি তিনি করে ফেলেছেন।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
জোয়েরজেন মোয়েলার : সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস ইউসুফ ইসহাক ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ ভিসিটিং ফেলো