আমাদের শিশুরা পথে। বহুদিন আগে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, ‘আমরা এখানে কেন? রাজপথ কোনো সুখস্থান নয়!’ বড় দুঃখে আমাদের সন্তানেরা রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের মনে অনেক দুঃখ। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরবে বলে রাস্তার কিনারে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের সহপাঠীরা মৃত্যুবরণ করেছে, বেপরোয়া চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেড়ে নিয়েছে দিয়া খানম মিম আর আবদুল করিম রাজীব নামে দুই শিক্ষার্থীর জীবন। আহত হয়েছে ৯ জন। একজন এখনো আইসিইউতে আছে।
শিক্ষার্থীরা এই নৈরাজ্যের অবসান চায়। এটা আমরা সবাই চাই। আর যেন একজন মায়েরও বুক খালি না হয়। আপনার চেয়ে বেশি করে এটা আর কেউ চাইতে পারে বলে বিশ্বাস করি না।আমাদের শিশুকিশোরেরা রাস্তায় আন্দোলন করছে, তার যেসব ছবি আর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দেখছি, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষের দিনের স্বস্তি ও রাতের ঘুম কেড়ে নেবেই। রক্তমাখা কেডস। রক্তমাখা স্কুল ইউনিফর্ম। নাহ্, আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। প্রার্থনা করি, এসব যেন আপনার চোখে না পড়ে। পড়লে অবধারিত যে আপনি সহ্য করতে পারবেন না। আমরা সবাই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি নিয়ে পথে নেমেছে। এই দাবিগুলোর কোনোটাই অপূরণীয় নয়। বিপুলসংখ্যক নবীন প্রাণের মনে যে বড় বেদনার জন্ম নিয়েছে, আমরা তার নিরসন চাই। আপনিই তা করতে পারেন।
বাংলাদেশে সড়কে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যায়, তা গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। যত লোক আহত হয়, যত পরিবার পথে বসে, তার হিসাব কষলে তা একটা জাতীয় দুর্যোগের পর্যায়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় তো চালকদেরও প্রাণহানি আর অঙ্গহানি ঘটে। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের কাছে বিমানবন্দর সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম নিজেই তো একজন বাসচালক। তিনি বলেছেন, ‘এটা তো দুর্ঘটনা নয়, এটা মার্ডার। আমি অপরাধীর ফাঁসি চাই।’ আমরা গিয়েছিলাম দিয়া খানমের বাসায়, আবদুল করিম রাজীবের মা-বোনের কাছে, কান্নামাখা স্বরে তাঁরা জিজ্ঞাসা করেছেন, অপরাধের বিচার হবে তো, অপরাধী চালকের ফাঁসি হবে তো!
নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের অবস্থান অত্যন্ত স্ববিরোধিতাময়, ইংরেজিতে যাকে বলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। তিনি যদি শ্রমিকনেতা হতে চান, তবে তা-ই হোন। আর যদি সরকারে থাকতে চান, তাহলে তাঁকে শপথের মর্যাদা রাখতে হবে, আবেগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে তিনি কোনো কাজ করতে পারবেন না।
আমরা দেখেছি, যাত্রাবাড়ী-নারায়ণগঞ্জ এলাকায় শ্রমিকদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। যাত্রাবাড়ীতে কলেজছাত্র ফয়সাল মাহমুদের ওপর পিকআপ তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা আরও জানতে পেরেছি, আন্দোলনকারীদের ছবি ও ভিডিও সংরক্ষণ করার আদেশ এসেছে। এই কচি কচি ছেলেমেয়েগুলো না আবার হেনস্তার শিকার হয়! এর সবই দমন করার কৌশল। স্কুল বন্ধ করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাতে পরিস্থিতি হয়তো সাময়িকভাবে সামলানো যাবে, কিন্তু মূল সমস্যার কোনো হেরফের হবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না যে জনগণের মনে ক্ষোভ জন্মালে ক্ষোভের কারণ দূর করতে হয়। বলপ্রয়োগে আপাতত কামিয়াব হওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার ফল ভালো হয় না।
দেশের কোটি কোটি কিশোর-তরুণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি যে সমর্থন দেখা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার উন্মেষ ঘটেছে, তার ওপর ভরসা রেখে তরুণ প্রজন্মের প্রাণের কথাটা পড়ার চেষ্টা করুন। আপনি সারা দেশের কয়েক কোটি তরুণের ভালোবাসা এক নিমেষেই অর্জন করে নেবেন, আপনারই জয়জয়কার ধ্বনিত হবে, যদি আপনি সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী আন্দোলনের দাবিগুলো পূরণ করার উদ্যোগের ঘোষণা দেন। একইভাবে কোটাবিরোধী আন্দোলনের একটা ইতিবাচক সমাধান যদি আপনি করেন, তরুণেরা আপনার নামে জয়ধ্বনি দেবে।
সড়ক দুর্ঘটনা সার্বিক নৈরাজ্যের প্রতিফলন মাত্র। আইনের যৎসামান্য রদবদলে তা পাল্টে যাবে না; এক দিনে বা একটা বিচারে তার সমাধান হবে না। কিন্তু আপনি মানুষের নেত্রী, সন্তানহারা মায়ের অশ্রু মুছে দেওয়ার ভূমিকা তো আপনাকেই মানায়।
বলপ্রয়োগ সমস্যাকে বাড়াবে। কালক্ষেপণ সুযোগসন্ধানীদের ফায়দা নেওয়ার অবকাশ দেবে।
আপনিই ত্বরিত পদক্ষেপ নিন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের সময় যেভাবে আপনি সাহসিকতার সঙ্গে দাবি মেনে নিয়েছিলেন। বৃহত্তর মানুষের জনহিতকর দাবি পূরণ করায় গৌরব আছে। ছাত্রদাবির বিপরীতে অবস্থান নেওয়া ইতিহাস সমর্থন করে না।
এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে আপনার সংহতি প্রকাশই হবে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সমাধান। আমাদের শিশু-কিশোরেরা ঘরে আর স্কুল-কলেজে ফিরে যাক।
বাংলাদেশের জয় হোক।