আসামে তিন ‘ডি’: অপারেশন বাঙালি খেদাও

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: হজ্বে গিয়ে দেখা হলো কালাম আলীর (ছদ্মনাম) সঙ্গে। কালাম এসেছেন গুয়াহাটি থেকে। কালাম আলীর পরিবারের সবার নাম ওঠেনি নাগরিকত্বের তালিকায়। এমনকি তাঁর স্ত্রী আম্বিয়া খাতুনের নামও নেই। প্রায় ৪০ বছরের সংসার তাঁদের।

আসামে ৩৪ শতাংশ মুসলমান। তার মানে প্রতি তিনজনে একজন মুসলমান। আসামের নয়টি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। গত ৩০ জুলাই আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনসে (এনআরসি) যে খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়, তাতে ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জন বাঙালিকে অবৈধ নাগরিক, তথা ‘বাংলাদেশি’ ঘোষণা করে আসাম সরকার।

বৈধতা প্রমাণ করতে না পারলেই কি বাংলাদেশি?
তা কেমন করে হবে? কালাম আলী আমাকেই প্রশ্ন করেন। এই যে আমার বোনের স্বামী হিসামুদ্দিন, ওরা তিন পুরুষ ধরে কাছাড়ে কাপড়ের ব্যবসা করে। আদতে ওদের বাড়ি ছিল মুঙ্গেরে, বিহারের মুঙ্গের। সেভাবে ধরলে ও বিহারি। এখন ওকেও বলা হচ্ছে অবৈধ বাংলাদেশি। ও কী? ওর চোদ্দ পুরুষও কোনো দিন বাংলাদেশ দেখেনি। আসামে অন্যান্য ভাষাভাষীর মানুষের অভাব নেই। বিশেষ করে শহরে নানা ব্যবসায় তারা নিয়োজিত বংশপরম্পরায়। এনআরসিতে তো তাদের নাম কোনো সময়ই ছিল না।

এনআরসির খেলাটা কত দিনের? আমার চেহারা-সুরত ভালো করে জরিপ করে কালাম আলী বলেন, ‘আপনার জন্মের আগে।’ প্রায় দেশভাগের পরপরই বলা যায়। তাতে কোনো অসুবিধা ছিল না, প্রথম গোল বাধে ১৯৫০ সালে। ১৯৫০ সালের ভয়াবহ ‘চরুয়া খেদা’ দাঙ্গায় এক মুসলমান গ্রামেই ৮০০ মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দাঙ্গার আতঙ্কে হাজার হাজার মানুষ পূর্ব বাংলায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী তাদের ভারত ফেরত নেয় ঠিকই কিন্তু সীমান্ত পেরোনোর সময়ে সঠিক নথিপত্র দেয়নি। আর ওই শরণার্থীরা ফেরত আসার আগেই ১৯৫১ সালে আসামে এনআরসি তৈরি হয়ে যায়। তাই বহু বাংলাভাষী মুসলমানেরই আর সেই এনআরসিতে নাম ওঠেনি।

সেই সুবাদে বহু বাংলাভাষীকেই (নৃতাত্ত্বিক কারণে যাদের বেশির ভাগ আবার মুসলমান) সন্দেহজনক ভোটার বা ডি ভোটার, অর্থাৎ সন্দেহজনক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করা হয়ে গেছে। আসাম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে যাঁরা আসামে এসেছেন, তাঁদেরই বিদেশি বলে চিহ্নিত হওয়ার কথা। কালাম আলীর কয়েক চাচা ওই দলে ছিলেন।

সবকিছু গুটিয়ে গুয়াহাটি চলে আসার আগে কালাম আলীর দাদারা থাকতেন বারপেটা জেলার বগুলামারিতে। দাঙ্গার রাতেই তাদের গ্রামের প্রায় শ পাঁচেক মানুষ জানে বাঁচতে সবকিছু ফেলে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী বেকিতে ঝাঁপ দেয়। কয়েক দিন নদীতে, নদীর পাড়ে কিংবা চরে লুকিয়ে থেকে তারপর দেশি নৌকায় করে তখনকার পূর্ব বাংলায় দিকে যাত্রা করেন। দীর্ঘ ১৮ দিন পরে নদী তাদের টাঙ্গাইল নিয়ে আসে। প্রথম দিকে স্থানীয় মানুষ তাঁদের খাবার আর আশ্রয় দিলেও শেষ পর্যন্ত দৈনিক আট আনা (এখনকার ৫০ পয়সা) দিনমজুরিতে কাজ করে দিন গুজরান করতে হতো। নেহরু-লিয়াকত চুক্তির পর তাঁরা দেশে ফেরত আসেন। কিন্তু খাতায় আর নাম ওঠে না।

সব অসমীয় কি বাঙালিবৈরী?
এবার কালাম আলী একদম অন্য কথা বললেন, ৫০-এর দাঙ্গা আর তাঁর চাচাদের আবার স্বদেশে ফিরে ফেলে আসা বাড়িঘরে আবার থিতু হওয়ার পেছনে স্থানীয় অসমীয় জনগোষ্ঠীর সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করলেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দিন থেকে ফিরে আসার দিন পর্যন্ত প্রায় ১৩-১৪ মাস তাঁরা তাঁদের জায়গা-জমি, ভিটা-মাটি, গরু-মহিষের দেখভাল করেছেন। যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন। এমন প্রতিবেশিতার গুণ না থাকলে শুধু দুই প্রধানমন্ত্রীর কাগুজে চুক্তি তাঁদের ফেরাতে পারত না।

তাহলে কি সবটাই রাজনীতি?
এ বড় কঠিন প্রশ্ন। উপমহাদেশেই প্রবল হচ্ছে ভেদাভেদের রাজনীতি। তবে সেটা শুরু ব্রিটিশ আমলে। বাংলাভাষী মুসলমান আর আদিবাসী—এঁরা আসামের ওই বোড়ো স্বশাসিত অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই এঁদের বিভিন্নভাবে এথনিক ক্লেনসিং বা জাতিগত সাফাই করে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলমান আছে। এমনটাই অভিযোগ কালাম আলীর।

১৮৫৫ সালে ছোটনাগপুর এলাকায় সাঁওতাল বিদ্রোহের পরেই ব্রিটিশ শাসকেরা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের মধ্য ভারত থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে উত্তরবঙ্গ আর আসামে, যাতে নতুন করে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে না পারে। এই অঞ্চলের একটা অংশেই আবার বোড়ো জনজাতির আদি বাস। তবে তাঁরা এখন জনসংখ্যার মাত্রই ২০ শতাংশ। ভারতের সব রাজ্যে সাঁওতালরা তফসিলি সম্প্রদায় আখ্যা পেলেও আসামে তাঁরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কেন এই দুমুখো নীতি? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারও জানা নেই।

বিজেপি নেতা রাম মাধবের হুমকি
১১ সেপ্টেম্বর বিজেপি নেতা রাম মাধব বলে দিয়েছেন, আসামে এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তিন ডি-এর ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন: ডিটেকশন, ডিলিট, ডিপোর্টেশন। অর্থাৎ চিহ্নিত, বাতিল ও বিতাড়ন—এসব ধাপে ধাপে চলবে। তবে একটা ডি-এর কাজ যে সব সময় তারা চালিয়ে যাবেন, সেটা চেপে গেছেন। বাঙালিদের, বিশেষ করে বাঙালি আর অসমীয় মুসলমানদের ডিস্টার্ব করতেই থাকবেন। কারণ, তাঁদের ভয় ভোটবাক্সের ভারসাম্য নিয়ে। রাম মাধবের সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিজেপি সভাপতি আমিত শাহের কণ্ঠে।

ঢাকা থেকে সম্প্রতি যেসব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ভারত সফর করেছেন, তাঁদের রাম মাধবের দুয়ার টপকাতে হয়েছে। রাম মাধবের সঙ্গে আসাম পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের কী কথা হয়েছে, তা কি জাতিকে জানিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেন? নাকি কোনো কথাই হয়নি? সরকারি স্তরে একদিকে ভারত অসমীয় বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশে না পাঠানোর কথা বলে আশ্বস্ত করছেন, আবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা রাজনীতির ময়দানে বলছেন বিপরীত কথা? কোনটা আমরা বিশ্বাস করব?

Advertisement