শুরু হলো উলট পুরাণ পর্ব

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ভারতীয় রাজনীতিতে শুরু হয়েছে উলট পুরাণের হুজুগ কিংবা ভোল বদলের ভেলকি। উপলক্ষ, আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচন। বোঝাই যাচ্ছে, ভোট বড় বালাই।

উলট পুরাণ অথবা ভোল বদল, ইংরেজিতে যাকে বলা যেতে পারে ‘রোল রিভার্সাল’, ইদানীং তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ দাখিল করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবত। সম্প্রতি রাজধানী দিল্লিতে ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞান ভবনে তিন দিনের এক অনুষ্ঠানে সংঘের দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ ভারত কী রকম হওয়া উচিত, তার একটা রূপরেখা তিনি এঁকে দিয়েছেন। সেই রূপরেখায় মোহন ভাগবত যে যে কথা বলেছেন, এযাবৎ কোনো সংঘপ্রধানের মুখে তা শোনা যায়নি। শুধু তা–ই নয়, ভাগবত যা শোনালেন, ৯৩ বছর
ধরে (১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত) সংঘ বলে এসেছে ঠিক তার উল্টো কথা। শিখিয়ে এসেছে ঠিক সেগুলো, যা ভাগবতের শোনানো কথার ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত!

বিস্ময় শুধু সংঘের বাইরের জগতেই নয়, সংঘপ্রধানের এই ভাষণ বিস্মিত করেছে সংঘের অন্দরমহলকেও। শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সংঘসেবী বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধব ৬৮ বছর বয়সী মোহন ভাগবতের এই দর্শনকে সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের ‘গ্লাসনস্ত’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে তিনি লিখেছেন, ‘এবার প্রয়োজন পেরেস্ত্রৈকার। নতুন এই দর্শন ছড়িয়ে দিতে হবে সংগঠনের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত। মোহন ভাগবতের চ্যালেঞ্জ সেটাই।’

এসব দেখেশুনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই ভোল বদলের কারণ কী? কেনই–বা এই উলট পুরাণ?

ভাগবত–বাণী বা মোহন-দর্শনের নমুনাগুলো দেখা যাক।

সাড়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে, সেই যেদিন থেকে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে বেছে নেয়, ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারত গঠনের কথা আমরা শুনে আসছি। মোহন ভাগবত তাঁর মূলে কুঠার হানলেন! বললেন, ‘মুক্ত নয়, আমাদের যুক্ত করতে শিখতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে দেশ চলতে পারে না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। যারা ভুল করছে, তাদের ভুল শুধরে দিতে হবে। এই দেশটা সবার।’

‘মুক্ত’ ও ‘যুক্ত’র এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা হতে না হতেই দ্বিতীয় বিস্ময় হাজির কংগ্রেসের ভূমিকা ব্যাখ্যায়! নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশবাসী শুনে আসছে, ৭০ বছর ধরে এই দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠিয়েছে একটি দল এবং একটিমাত্র পরিবার! দলটির নাম কংগ্রেস, পরিবারটি নেহরু-গান্ধীর! শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের এই মন্তব্য ও বিশ্বাস নস্যাৎ করে ভাগবত এই প্রথম শোনালেন ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম ও দেশ গঠনে’ কংগ্রেসের ‘অবদানের’ কথা। নাম নিলেন কংগ্রেসের মহান নেতাদেরও। এ-ও এক চমক বৈকি! সেই চমকের রেশ কাটল কি কাটল না, তিনি পেশ করলেন ‘হিন্দুত্বের নতুন সংজ্ঞা’। এই সংজ্ঞা এযাবৎ ছিল অশ্রুত। তিনি বললেন, ‘হিন্দুত্ব হলো একতাবদ্ধ হওয়া। সর্বজন হিতায়। মুসলমানদের বাদ দিয়ে হিন্দুত্ব অসম্পূর্ণ।’ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদের বলা কথার সূত্র টেনে তিনি বললেন, ‘মুসলমানরাও সমান ভারতীয়। অন্যদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য শুধু উপাসনাপদ্ধতিতে।’ বললেন, ‘সংঘ সেই হিন্দু রাষ্ট্র চায় না, যেখানে মুসলমানদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’ শোনালেন, ‘হিন্দুত্বের নামে যা চলছে তা আর যা–ই হোক হিন্দুত্ব নয়।’

হিন্দুত্বের এমন বিশ্লেষণ কোনো সংঘপ্রধানের মুখ থেকে কখনো শোনা যায়নি! সংঘের আদর্শে যাঁরা লালিত ও দীক্ষিত, তাঁদের কেউ এযাবৎ ভারতীয় মুসলমানদের এভাবে চিত্রিতও করেননি! বরং সর্বদাই এই সম্প্রদায় তাঁদের চোখে ‘ভিনদেশি’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। সংঘগুরু মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের বাণীসমৃদ্ধ বাঞ্চ অব থটস-এ মুসলমানরা ‘দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসেবে বর্ণিত। বিনায়ক সাভারকরের কথায় ভারতীয় মুসলমানদের ‘পুণ্যভূমি’ ভারতের বাইরে অবস্থিত। এহেন মুসলমানরা মোহন ভাগবতের কথায় রাতারাতি ‘শুদ্ধ’ ও দেশের ‘সম্পদ’ হয়ে উঠলেন! কীভাবে? সংঘপ্রধানই তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘যেকোনো মত বা ধারণার একটা প্রেক্ষিত থাকে। কোনো ধারণাই চিরকালীন হতে পারে না। গুরু গোলওয়ালকরের ভাবনাও চিরন্তন নয়।’

আরএসএস কখনো ভারতীয় সংবিধানকে মেনে নেয়নি। কারণ, গুরু গোলওয়ালকর ছিলেন সংবিধানের কট্টর সমালোচক। বাঞ্চ অব থটস-এ তিনি লিখেছেন, ‘সংবিধানে এমন কিছু নেই, যাকে আমরা নিজস্ব বলে ভাবতে পারি।’ সংঘ কোনো দিন গুরু-বিরোধিতা বরদাশত করেনি। বরং গুরুর বাণীকে শিরোধার্য করে রেখেছে। ভাগবতের ঠিক আগে যিনি ছিলেন সংঘপ্রধান, সেই কুপ্পাল্লি সীতারামাইয়া সুদর্শন ২০০০ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সংবিধানে দেশের মৌলিক ভাবধারাই অনুপস্থিত। ভারত বা ভারতীয়ত্বের প্রতিফলন এতে ঘটেনি।’ সংবিধান নিয়ে গোলওয়ালকর কিংবা সুদর্শনের এই নিদানের বাইরে সংঘ আজ পর্যন্ত বেরোয়নি। বেরোল এই প্রথম। ভাগবত সেই গণ্ডি টপকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘সংবিধানকে আমরা শ্রদ্ধা করি। অনেক ভেবেচিন্তে এই সংবিধান তৈরি করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সংঘ কখনো সংবিধানের বিরোধিতা করেনি।’

শেষের এই বাক্য, এই বিরোধিতার বিষয় যে সত্য নয়, সুদর্শনের সাক্ষাৎকারই তার প্রমাণ। ভাগবতের সে তথ্য অজানাও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি শুধু মান্যতার কথাই শোনালেন না, জোর দিলেন সংবিধানে উল্লিখিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটির ওপর, যা কংগ্রেসের আদর্শগত ও সাংগঠনিক ভিত বলে স্বীকৃত।

কেন্দ্রে একার শক্তিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই মোহন ভাগবত আরএসএসে ধীরে ধীরে বদল ঘটাতে শুরু করেন। খাকি শর্টস ত্যাগ করে ট্রাউজার্স আমদানি তার প্রথম উদাহরণ। কংগ্রেসি বলে পরিচিত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে নাগপুরে দীক্ষান্ত ভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানানো দ্বিতীয় চমক। বিজ্ঞান ভবনের অনুষ্ঠানে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ও সমাজবাদী পার্টির নবীন নেতা অখিলেশ যাদবকেও সংঘ আমন্ত্রণ জানাবে বলে একটা খবর প্রচার করা হয়েছিল। অখিলেশ সেই আমন্ত্রণ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেও রাহুল উচ্চবাচ্য করেননি। সংঘও নয়। এই আচরণের মধ্য দিয়ে মোহন ভাগবত এটাই বোঝাতে সচেষ্ট যে তাঁদের চোখে কেউ ‘অচ্ছুত’ নয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে দীর্ঘকাল ধরে সবার কাছে কংগ্রেসের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, সেই গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে ভোল বদল প্রয়োজন। এতখানি বলশালী হয়ে এতগুলো রাজ্য দখল করেও সংঘ বা বিজেপি কেউই কংগ্রেসের সেই ‘প্যান ইন্ডিয়ান’ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১৯ তো অবশ্যই, তারপরও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য এই ভোল বদলের প্রয়োজন খুব।

উলট পুরাণের ক্ষেত্রে সংঘ যতটা সাবলীল, কংগ্রেস ততটাই আড়ষ্ট। বিজেপির ‘উগ্র হিন্দুয়ানার’ মোকাবিলায় কংগ্রেস যা করছে, তা ‘নরম হিন্দুত্ব’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাবরি মসজিদ আন্দোলনের সময় থেকেই এই নরম হিন্দুত্বের নামাবলি পরে কংগ্রেস বাঁচতে চেয়েছিল। পারেনি। এখন আবার ধুমধাম করে কংগ্রেস তুলে ধরছে রাহুল গান্ধীর মানস সরোবর যাত্রা। কিংবা প্রচারের আলোয় নিয়ে আসছে রাজ্যে রাজ্যে তাঁর মন্দিরে ঢুঁ মারার দৃশ্য। মধ্যপ্রদেশ দখলে মরিয়া কংগ্রেস এই সেদিন বড় করে তুলে ধরল রাহুলের ‘শিবভক্ত’ চরিত্র। ভোট জিততে এটাও তো কংগ্রেসের উলট পুরাণ! লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে উলট পুরাণের এই হুজুগই হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের রাজনীতির আবহ সংগীত।

মোহন-বাণী শোনার পর বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত। ‘মুক্ত’র বদলে ‘যুক্ত’ করার রাজনীতির কথা প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এখনো শোনা যায়নি! ‘লাভ জেহাদ’-এর তলোয়ার খাপে মুখ লুকোয়নি। ‘ঘর ওয়াপসি’ আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। গোহত্যার অপরাধে গণপিটুনি বন্ধ হওয়ার কোনো ইঙ্গিতও এখনো নেই। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ তৈরির কর্মসূচি থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সরে আসছে বলেও কোনো ঘোষণা শোনা যায়নি। বরং অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর উল্লসিত হতে দেখা গেছে সংঘ পরিবারের বহুবিধ শাখা সংগঠনের নেতাদের। ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান’-এর স্লোগান থেকে সরে আসার কোনো লক্ষণ এখনো ছিটেফোঁটা দৃশ্যমান নয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মোহন ভাগবতের দর্শন নিছক অরণ্যে রোদন নয়। শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেসের বিকল্প হতে গেলে বহুত্ববাদী এই দেশে সর্বগ্রাহ্য গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের পাসপোর্ট এটাই।

Advertisement