এরিক কাবুলে, খালিলজাদ দোহায়

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: সংবাদমাধ্যম গত সপ্তাহে খুব সরব ছিল আফগান ভোট নিয়ে। তবে নির্বাচনী প্রতিবেদনগুলোতে কমই উচ্চারিত হলো যে দেশটিতে ন্যাটোর অভিযানের ১৭ বছর পূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি।

আফগানিস্তানে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর। ফলে আগামী বছর থেকে যারাই ভোটার হবে, তারা জন্ম আজীবন দেখে আসছে তাদের দেশে আন্তর্জাতিক বাহিনী। আর যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীতে ১৭ বছরের পরই যোগ দেওয়া যায়, ফলে সেখানকার নতুন সৈনিকদের যারাই আফগানিস্তানে আসবে, তাদেরও জন্ম আফগান যুদ্ধ শুরুর পর।

আফগানিস্তানে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও ২০ অক্টোবরের নির্বাচন হলো আট বছর পর। বিলম্বে হলেও নির্বাচনের আয়োজন করে ন্যাটো দেখাতে চাইছে, যুদ্ধাবস্থায়ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভালো কাজ করছে এবং পরিস্থিতির ওপর তালেবানের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ নেই।

তবে বাস্তবতা হলো ২০০১ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ‘টেকসই স্বাধীনতার লক্ষ্যে অভিযান’ (অপারেশন ইনডিউরিং ফ্রিডম) আজও স্থায়ী স্বস্তি আনতে পারেনি। মধ্য আফগানিস্তানের কিছু নগর ছাড়া অন্যত্র প্রশাসনের সামান্যই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। নির্বাচনের দুদিন আগে ন্যাটো অভিযানের প্রধান জেনারেল মিলারের বৈঠকস্থলে হামলা চালিয়ে তালেবানরা তাদের সামর্থ্য জানিয়ে দিল আবার। এই হামলার সময় আতঙ্কিত হয়ে মিলারকেও হাতে অস্ত্র নিতে দেখা যায়। সিএনএন ১৯ অক্টোবর দুঃখ করে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অভিযান-প্রধানকে যুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে, Ñসমকালীন ইতিহাসে এমন নজির বিরল।

তবে আফগান ভোটের প্রচারণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে খবরটি আড়াল করেছে তা হলো গত মাসে এরিক প্রিন্সের কাবুলে আসা। বিশ্বের মানবাধিকারকর্মীদের কাছে এরিক পরিচিত ‘মার্চেন্ট অব ডেথ’ নামে। কুখ্যাত প্রাইভেট যুদ্ধ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ব্ল্যাক ওয়াটার’-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ইরাকে এরিকের ভাড়াটে সৈনিকদের হাতে বেসামরিক নাগরিকদের বহু গণহত্যা সংঘটিত হয়। বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়ে কিছুদিন আড়ালে থাকলেও ট্রাম্পের নির্বাচনী বাজেটে বিরাট অঙ্কের ডোনেশন দিয়ে হোয়াইট হাউসে এখন এরিকের অবাধ যাতায়াত। এরিকের বোন বেটসি ডেভোস ট্রাম্পের শিক্ষামন্ত্রী, সেটাও তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রশাসনে ঢুকতে সাহায্য করছে।

একদা যুক্তরাষ্ট্রের এলিট নেভি-সিল স্কোয়াডের সদস্য এরিক দুই দশক ধরে দেশে দেশে যুদ্ধের ঠিকাদারি করে যাচ্ছেন। ভাড়াটে সৈনিক থেকে ভাড়াটে বিমানবাহিনী—সবই রয়েছে তাঁর। ইরাক যুদ্ধ থেকে ব্ল্যাক ওয়াটার আয় করে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ৯-১১–এর পর পেন্টাগনের বহু বৈশ্বিক প্রকল্পের অংশীদার এরিকের ব্ল্যাক ওয়াটার। ওবামা প্রশাসনের সময় ব্ল্যাক ওয়াটার নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘এক্সি সার্ভিস’ এবং ২০১০-এ এরিক প্রতিষ্ঠানটি এক শ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দেন।

এরপর এরিক আবুধাবিতে কার্যক্রম শুরু করেন এবং ‘ফ্রন্টিয়ার রিসোর্স’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন, যার কাজ ছিল আমিরাতের জন্য একটি ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তোলা। গত বছর থেকে এরিক ট্রাম্প প্রশাসনকে বোঝাচ্ছেন আফগান যুদ্ধ পুরোটাই বেসামরিক ঠিকাদারদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর প্রস্তাবটি পছন্দ। এরিক ট্রাম্প প্রশাসনকে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন কীভাবে বর্তমানের চেয়ে বছরে মাত্র এক-অষ্টমাংশ খরচে যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব।

এ মুহূর্তে যুদ্ধে ন্যাটোর প্রায় ৫০ হাজার জনশক্তি রয়েছে। এরিক মনে করেন, ছয় হাজার সদস্যের দুর্ধর্ষ ভাড়াটে বাহিনীকে দিয়েই কাজটি করা সম্ভব, যাদের তিনি সংগ্রহ করবেন সাবেক সৈনিকদের মধ্য থেকে, যে সৈনিকদের রেকর্ড থাকবে খুব ‘মারকুটে’। সঙ্গে দুই হাজার সদস্যের বিমানবাহিনীও থাকবে। বছরে মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলারে এভাবে ঠিকাদার দিয়ে যুদ্ধটি চালানো সম্ভব।

একই প্রস্তাব নিয়ে আফগান সরকারকে রাজি করাতে এরিক সম্প্রতি কাবুলেও এলেন। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো লিখেছে, প্রেসিডেন্ট আশরাফ
ঘানির আপত্তি সত্ত্বেও এরিক কাবুলে ঢুকতে পেরেছেন, যা প্রমাণ করছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কাবুলে অনেকেই এরিকের প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে প্রস্তুত। এটা একই সঙ্গে এ-ও বার্তা দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সামরিক অভিযান ব্যর্থ হলেও সরাসরি পরাজয়ের দৃশ্য এড়িয়ে আফগানিস্তান ত্যাগের পথ খুঁজছে তারা। এরিকের ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী এ ক্ষেত্রে একটা বিকল্প।

দুই.

এটা এখন প্রমাণিত যে মোল্লা ওমরের মৃত্যুতে তালেবানের যুদ্ধক্ষমতা কমে আসবে বলে যে অনুমান ছিল, সেটা সত্য হয়নি। হিব্বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা সফলতার সঙ্গে যুদ্ধ এবং ছায়া সরকার দুটোরই নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। দেশটির অন্তত ৪৪ শতাংশ এলাকা তাদের দখলে এবং ৩৪টি প্রদেশের অন্তত ২০টিতে যুদ্ধ চলছে। অথচ তালেবানকে হারাতে গত ১৭ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের ৭৫৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে।

যুদ্ধের গতিধারায় স্পষ্ট, ন্যাটো এখন আর যুদ্ধজয়ের জন্য লড়ছে না। তারা মরিয়া হয়ে আফগানিস্তান থেকে বের হতে চাইছে। এরিক প্রিন্সের বাইরে এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিকল্প সমঝোতা। মোটামুটি মুখরক্ষা হয়, এমন একটা বোঝাপড়া সম্ভব কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে দায়িত্ব পড়েছে জালমে খালিলজাদের ওপর। আফগানিস্তানে জন্ম নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটনীতিবিদ ইতিমধ্যে পাকিস্তান ও সৌদি আরব সফর করেছেন। গত মাসে দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক দফা দীর্ঘ আলোচনা শেষ হলো তাঁর।

যখন দুপক্ষই কোনো যুদ্ধ ময়দানে সমান সমান অবস্থায় থাকে, তখন দর-কষাকষি থেকে কোনো ঐকমত্যে আসা কঠিন। তালেবান আলোচনার টেবিলে নিজেদের ‘ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান’ পরিচয় দিতে ইচ্ছুক ছিল। খালিলজাদ ওই পরিচয় মেনে নিয়েছেন। অর্থাৎ আপস–মীমাংসা শেষে তালেবান ১৭ বছর আগে নিজেদের উৎখাত হওয়া সরকারের পুনঃস্থাপনই চাইছে। এর আরেক অর্থ, নিজেদের ছত্রচ্ছায়ায় ২০ অক্টোবরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটো সরকারকে যে বৈধতা দিতে চাইছে, তাকে বিসর্জন দিয়ে হলেও যেকোনো সমঝোতায় পৌঁছে যেতে দ্বিধা করবে না তারা।

তবেতালেবানের চাপে ফেলে সর্বোচ্চ ছাড় আদায় করতে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম সারির অধিকাংশ তালেবান নেতা পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, ইসলামাবাদ এঁদের প্রতি কঠোর হলে তালেবান তাদের শর্তেই শান্তি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হবে। বিশেষ করে তালেবান যুদ্ধ কমান্ডার সিরাজ হাক্কানির সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের গোপন যোগাযোগ রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর বিশ্বাস। খালিলজাদ মনে করেন, পাকিস্তানের অসহযোগিতার কারণেই মূলত আফগানিস্তানে শান্তি আসছে না। এরূপ মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের খুব পছন্দ। এতে করদাতাদের সামনে দায়িত্ব এড়ানো সহজ হয়।

ট্রাম্প গত বছর তাঁর আফগান কৌশল ঘোষণাকালে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শেষের দিনক্ষণ বলতে চায় না। সবকিছু মাঠের পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত হোক। তবে ট্রাম্প এই বাগাড়ম্বর করতে থামেননি, আফগান যুদ্ধে তাঁর দেশ ‘বিজয়ী’ হতেই ইচ্ছুক। কিন্তু সর্বাধিনায়ক হওয়ার পর এখনো আফগানিস্তানে আসেননি তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ভাগ্য প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করছে খালিলজাদ ও এরিকের মধ্যে কে ‘বিজয়ী’ হন, তার ওপর।

ট্রাম্পের পক্ষে যিনি প্রথম আফগান যুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন, সেই জেনারেল নিকলসন গত মাসের প্রথম রোববার কমান্ড থেকে অবসর নিলেন। সেদিন কাবুলে বিদায় ভাষণে তিনি বলেন, ‘আফগান যুদ্ধ শেষ করার সময় হয়েছে।’ কিন্তু বাস্তবে কোনো যুদ্ধই ‘শেষ’ হয় না, যুদ্ধে কেউ জেতে বা হারে মাত্র। এটা প্রায় নিশ্চিত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রায় একই ধরনের আরেকটি অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে ইতিহাসে। যেহেতু এবার তা ঘটছে অমার্ক্সবাদী কোনো শক্তির হাতে, সে কারণে এই পুনরাবৃত্তির র‌্যাডিক্যাল কোনো ভাবমূর্তি নেই বিশ্বের বোদ্ধা মহলে।

Advertisement