ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ওপরে ওঠে অনেকগুলো হাত। হাত তুলে থাকা একজন হেসে বলে, ‘আমি দেবী দেখিনি। দেখব বলে ঠিক করেছি।’
‘তাহলে হাত ওপরে কেন?’
‘কারণ, যারা দেখেছে এবং যারা দেখেনি সবাইকে হাত তুলতে বলা হয়েছে।’
আড্ডায় হাসির তরঙ্গ ওঠে। প্রস্তাবককে থতমত খেতে হয়, যারা দেখেছে এবং দেখেনি, হাত তুলতে বলা হয়েছে উভয়কেই। এ রকম বোকামো সে কীভাবে করতে পারল?
এমন ভুল করা অস্বাভাবিক নয়, ব্যাখ্যা দেয় একজন। ভালো লাগার আনন্দ, উত্তেজনা, অস্থিরতায় এমন ভুল হতেই পারে।
শেষে জানা গেল, সেই আড্ডার ছয়জন দেবী দেখেছে। চারজন দেখবে ঠিক করেছে। বাকি দুজন দেখবে কি দেখবে না, কোনোটা নিয়েই ভাবেনি। তাদের ভাবনায় ঘুরছে থাইল্যান্ড, তিন দিন পর যাচ্ছে সেখানে।
‘তোমাদের ভ্রমণ উপভোগ্য হোক’ বলল একজন, ‘কিন্তু এই মুহূর্তে ঢাকায় সবচেয়ে চমৎকার আকর্ষণ হচ্ছে দেবী। এ ছবি না দেখে ভ্রমণে গেলে ফিরে এসে এর-ওর মুখে দেবী সম্পর্কে শুনে আফসোস করতে হবে।’
তারপর সে আড্ডায় সিনেমা হলের পরিবেশ, বর্তমানের সিনেমা ইত্যাদি নিয়ে অনেকক্ষণ অনেক কথা হয়। স্মৃতিচারণাও হয়। বর্ণনা করা হয় একসময় কে কেমন সিনেমাপাগল ছিল। একজন ঢাকা শহরে পা রেখেই নতুন মুক্তি পাওয়া দর্পচূর্ণ দেখেছিল। সিনেমা হলগুলোয় আলাদা একটা ঘ্রাণ ছিল। সে ঘ্রাণের টান উপেক্ষা করা যেত না। ঢুকে পড়তে ইচ্ছা হতো সিনেমা হলে। সবকিছু একসময় কেমন ছিল আর এখন কেমন, এ আলাপে বিষণ্নতা ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু একজন এই পরিণতি মানতে পারে না। সে বলে, ‘শোনো সবাই। কী ছিল, নেই হয়ে গেছে কী কী, সেসবের দুঃখে ভেসে যাব সবাই? জীবনে যেসব সুন্দর এখনো আছে, তা কি উৎসাহের সঙ্গে উপভোগ করা উচিত নয়?’
এই প্রশ্নে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সে নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় খালি গলায় তপনের। সে গেয়ে ওঠে ‘ক্রমশ এ গল্পে আরও পাতা জুড়ে নিচ্ছি, দুমুঠো বিকেল যদি চাও ছুড়ে দিচ্ছি’।
খালি গলার সে গানে কবিতার মতো যে দৃশ্যগুলো সিনেমায় দেখা গিয়েছে, দেবী দেখা মানুষগুলোর চোখে একে একে সব ভেসে উঠতে থাকে। গানের বেশি লাইন জানা নেই তপনের। একসময় গুনগুন করে থেমে যেতে হলো।
একসঙ্গে অনেকে বলে ওঠে: অপূর্ব! তারপর একজন বলল, ‘গানটার সঙ্গে দৃশ্যকল্প ছিল খুবই মিল খাওয়া।’ আর একজন বলল, ‘মিলের চেয়ে বড় কথা মুহূর্তগুলোর চিত্রায়ণ। দৃশ্যকল্পে চেনা–জানা মুহূর্তগুলোকে মনে হয়েছে কত নতুন।’
পুরো সিনেমাটা প্রচলিতের বাইরের, সে প্রসঙ্গও এল। ছবিটিতে অজস্র নতুনত্ব। নতুন মানেই আগ্রহ, কৌতূহল সৃষ্টিকারী। কখনো মনে হয় না ছবিটা কোথাও খানিকটা থমকে দাঁড়াল। মুগ্ধতার রেশ ধরে, এক-একজন নিজের মতো করে অনুভূতি প্রকাশ করতে থাকে:
‘এমন মুগ্ধ বহুকাল হইনি।’
‘সুরুচি, সৌন্দর্য, আধুনিকতা, পরিশীলিত সিনেমার ভাষা, সব আছে দেবীতে।
‘পরিচালকের পরিমিতিবোধ অসাধারণ। এটা তাঁর প্রথম পরিচালনা শুনে অবাক হয়েছি।’
‘চিত্রনাট্যকার, পরিচালকের নাম অনম বিশ্বাস, অনম বিশ্বাস আয়নাবাজিরও চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন।’
আসরের একজন নয়ন, হাত তুলে উঁচু গলায় বলে, ‘আমি জয়ার ফ্যান ছিলাম, দেবী দেখে মনে হয়েছে এমন একজনের ফ্যান হওয়া গৌরবের।’
‘অসাধারণ অভিনয় করেছে জয়া। অভিনয় যে গুরুত্বপূর্ণ, মানসিক প্রস্তুতি, গভীর ভাবনার বিষয়, তা সে বুঝিয়ে ছেড়েছে।’
‘সংলাপ, অভিব্যক্তি আর শরীরী ভাষার প্রয়োগও দেখার মতো ছিল।’
‘শুধু অভিনয়ের জন্য নয়, জয়া আহসানকে বিশেষভাবে সাধুবাদ দিতে হয় দেবী প্রযোজনার সাহস দেখাতে পেরেছে বলে।’
আতিকুল, যে শুরুতে সবাইকে হাত তুলতে বলেছিল, সেই এনেছিল সাহসের প্রসঙ্গ। অভিনয়ের বিষয় এসে যাওয়ায় সে হাতজোড় করে বলে, ‘সাহসের কথা অকারণে আসেনি। জয়া আহসান অভিনয় করে, দেবী হবে তার প্রথম প্রযোজনা, অসীম সাহসী সিদ্ধান্ত। দেবী পরিচালনা করবে অনামা পরিচালক, অনম বিশ্বাস—তাও সাহসের ব্যাপার কি না?’
মাথা নাড়ানো সম্মতি আসে। আতিকুল আরও বলে, ‘এ চলচ্চিত্রের প্রতি ধাপে অজস্রজনের সাহসী ভূমিকা দৃশ্যমান, তাই সাহসের কথা বলেছি। চঞ্চল চৌধুরী সু–অভিনেতা, তাকে পাকা এলোমেলো চুলের মিসির আলি ভাবতে পারাটাও সাহসের ব্যাপার। খুবই সংবেদনশীল একটা চরিত্র নীলু। শবনম ফারিয়াকে ভাবা হয়েছে সে চরিত্রে। গুটিয়ে থাকা একটা মানুষ, কিন্তু ভেতরে চলে বিচিত্র অনুভবের অনুরণন। বেশ জটিল চরিত্র অথচ মেয়েটা অনায়াসে নিজেকে ভুলিয়ে দিয়ে নীলু হয়ে যেতে পেরেছে। ইরেশ যাকের নিজে এই চরিত্রটা গ্রহণ করেছে, সেটাও সাহসের ব্যাপার নিশ্চয়ই।’
সবকিছু মানানসই হলে সিনেমাকে সত্য মনে হয়। ছবিটার যেদিকে মন ঘোরানো যাবে দৃশ্যমান হবে সাহস। মনস্তাত্ত্বিক গল্পের রূপটা উপযুক্তভাবে বলার জন্য রহস্যময় আবহ দরকার। আলোছায়ার অপূর্ব এক ঘোর তৈরি করতে পেরেছে দেবীর চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরু। দর্শকের সিনেমা দেখার অভ্যাস নেই, তার ওপর সকলেরই সত্যনিষ্ঠ হওয়ার একান্ত চেষ্টা—বলতে হবে সবটাই দুর্দান্ত সাহসের ব্যাপার। নিশ্চয় খেয়াল করেছি সবাই, মিসির আলি কোথায় থাকেন, কেমন তাঁর ঘরদুয়ার, সমগ্র পরিবেশ। ছবির শিল্প নির্দেশক সামুরাই মারুফ বিশ্বস্ত থাকার সাহস দেখিয়েছে। একটিমাত্র গান, তার সুর, কথা প্রয়োগের সবখানে সাহস, সাহস আর সাহস।
গান গেয়ে উঠেছিল যে, সেই তপন তামাশা করে বলে, ‘আচ্ছা, শব্দগ্রহণ আর আবহসংগীত এ দুটো বিষয়কে আমরা খুব বেশি গণ্য করি না; কিন্তু সিনেমা দেখতে গিয়ে এ দুটো বেশ ভুগিয়েছে—লোম দাঁড়ানো, ভয় দেখানো কাজ। তাকেও কি সাহসের বলে বিবেচনা করতে হবে?’
হা হা-হো হো হাসির হুল্লোড়। হাসি শেষে খবর আসে রাতের খাবার প্রস্তুত। কেউ আড্ডা ছেড়ে ওঠে না। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি যে জন, সেই মুকুল ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলে, দেবী সাহসী ছবি। সাহসের সঙ্গে যুক্ত হতে না–পারাদের বলা হয় ভিতু। ভিতুদের দিয়ে জগতে কিছুই হয় না। সাহসীরা দীর্ঘজীবী হোক, সফল হোক। চলো, দেবী দেখাকে সেলিব্রেট করি এবার।