আমার যারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেখিনি বা পাইনি; তারা অতীতে ওই সময় দেখেছি সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রীতিমতো ভিপি-জিএসের মর্যাদা ভোগ করেন। এটা সব সরকারের আমলেই হয়েছে। এবার অন্তত অনির্বাচিত এই মর্যাদা ভোগের অবসান হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানা অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেছেন। ঢাবির জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা।
বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই কোনো নির্বাচন অনিয়ম ছাড়া হয় না। ডাকসু নির্বাচন নিয়েও কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিল। বিরোধী প্রার্থীদের সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের হুমকি, ধমকি, মারধরের খবর পড়েছি। বিভিন্ন দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এসব অভিযোগকে গ্রাহ্যই করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বরং একটি নির্বাচনকে যতভাবে বিতর্কিত করা সম্ভব, তার সব উদ্যোগই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়েছিল। গণমাধ্যমের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, হলগুলোতে ভোটের ব্যবস্থা, আগের রাতেই ব্যালট বাক্স হলে হলে পাঠিয়ে দেওয়া, অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা—এসবে ঢাবি কর্তৃপক্ষের একপেশে আচরণ একেবারেই স্পষ্ট।ধারণা ছিল ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো থেকে অন্তত ভিন্ন হবে। এখানে ক্ষমতার পালাবদলের কোনো বিষয় নেই। শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির সংযোগ অবশ্যই আছে। কিন্তু এর কারণে ত্বরিত কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের শঙ্কা বা সম্ভাবনা নেই। ডাকসু বা শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচন এমন এক নির্বাচন, যেখানে কেউই হারে না, বরং অর্জন করে। এখানে অর্জনের অনেক কিছুই থাকে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, উদারতার উদাহরণ হয়ে থাকার সুযোগ থাকে। চলমান স্রোতের বিপরীতের নিজেকে উজ্জ্বলতর করে তুলে ধরার অর্জন থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ কিন্তু ঠিক কমিশনের মতোই হয়েছে। শিক্ষকেরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। শ্রদ্ধার উচ্চ আসন তাঁদের। তাঁরা শিক্ষা দান করবেন। গবেষণা করবেন। রাজনীতির পঙ্কিল চক্রে নিজেদের মিলিয়ে ফেলা সমীচীন না। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এক শ্রেণির শিক্ষক দিন দিন নিজেদের হাস্যাস্পদ করে ফেলছেন। তাঁদের সংখ্যাও কম নয়। এমন জায়গায় এমনভাবে এমন সব বিষয়ে তাঁরা বক্তব্য দিচ্ছেন; মনে হচ্ছে তাঁদের তাল-জ্ঞান নেই।রোকেয়া হলের একটি কক্ষে ব্যালট-ভর্তি বাক্স রাখা হয়েছে—এমন অভিযোগ পেয়ে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সহসভাপতি প্রার্থী নুরুল হক গিয়েছিলেন রোকেয়া হলে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে নুরুল যাওয়ার পর যা হয়েছে, তা খুবই মর্মান্তিক। প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশন না আসা পর্যন্ত প্রাধ্যক্ষ নুরুলকে ওই কক্ষে যেতে বাধা দেন। পরে প্রক্টর ও ছাত্রলীগের প্রার্থীরা আসেন। সেখানে বৈঠক শেষে নুরুল বেরিয়ে এলে ছাত্রলীগের কর্মীরা নুরুলের ওপর হামলা করেন। এখানে লক্ষণীয় যে হলের প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর, নির্বাচন কমিশনার ও ছাত্রলীগের প্রার্থীদের উপস্থিতিতে নুরুলের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাবি প্রক্টর স্তম্ভিত হওয়ার মতো বক্তব্য দিয়েছেন গণমাধ্যমে। তিনি বলেছেন, নুরুলকেই জিজ্ঞাসা করুন কেন ছাত্রীদের হলে গিয়েছিলেন। কখনো কখনো শিক্ষকদের আচরণ একেবারেই দলীয় ক্যাডারদের মতো হয়ে যায়। একজন শিক্ষকের কতটা অধঃপতন হলে নিজেকে দলীয় ক্যাডারদের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারেন?
যা-ই হোক, ছাত্রলীগ বাদে প্রায় সবার বর্জনেই নির্বাচন শেষ হয়েছে। এখন ফলাফলের অপেক্ষা। কিন্তু এ রকম নির্বাচনে সবাই আশাহত হয়েছে। এখানে গ্লানি ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই। এই গ্লানি সবার জন্যই। শুরুতেই বলেছিলাম, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমার আশাবাদী হয়েছিলাম। ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু আর কত? এভাবে আমরা কতবার প্রতারিত হব। ভোট নিয়ে তামাশার শেষ কোথায়? বরং এই তামাশার নির্বাচন আয়োজন না করে নিজেদের মনোনীত ঘোষণা করে দিলেই ভালো হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট ছাত্র সংসদ ঘোষণা করে দেবে। এতে করে শিক্ষার্থী, জনগণ অন্তত মানসিক ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবে।