এম হাফিজ উদ্দিন খান
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৭৮টি উপজেলায় ১০ মার্চ ২০১৯ ভোট নেওয়া হলো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিন মাসের মধ্যে এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভোটার কিংবা সচেতন মানুষের মনে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচনটিকে একতরফা বলা ছাড়া উপায় কী? প্রতিদ্বন্দ্বিতা যা হয়েছে কিংবা ভবিষ্যতে হবে, তা নিজেদের মধ্যেই। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বৈরিতা সবই এখন দেখা দিয়েছে নিজেদের মধ্যে। অর্থাৎ দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে।
প্রথম ধাপে ১০ মার্চ ৭৮ উপজেলায় ভোট নেওয়ার সংবাদটি গত কয়েকদিন প্রায় প্রত্যেকটি জাতীয় দৈনিকে নানাভাবে শিরোনাম হয়। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ১৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছয়জন, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাতজন নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেছেন। এসব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে পদগুলোতে নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় ওই দিন তিনটি উপজেলায় ভোট গ্রহণেরই প্রয়োজন পড়েনি। আদালত ও ইসির নির্দেশে ভোট স্থগিত করা হয় কয়েকটি উপজেলায়। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী, যারা আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। তবে বিএনপি দলীয়ভাবে এই নির্বাচন বর্জন করলেও দলটির স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। দুর্মুখেরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সমালোচিত হলেও শেষ মুহূর্তে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে ইসি যে দৃশ্যত কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তাও এক ধরনের আইওয়াশ মাত্র। যাক, এ নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নিষ্প্রয়োজন মনে করি। কারণ, এমন নির্বাচন গণতন্ত্রের অলঙ্কার কি-না, এ নিয়েও জোর বিতর্ক চলতেই পারে। নির্বাচন কেন্দ্র করে আস্থার সংকট ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে এবং এর দায় নির্বাচন কমিশনের এড়ানোর কোনো অবকাশই নেই।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ নয়। কিন্তু অবশ্যই এমনভাবে নির্বাচিত হয়ে আসার বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য গৌরবেরও নয়। বরং এমন নির্বাচন কিংবা এমনভাবে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি গণতন্ত্রের সৌন্দর্যহানি ঘটায়। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম প্রায় তিন দশক পর হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি। তাছাড়া ডাকসু নির্বাচনে যে চিত্র ফুটে উঠল, তাতেও এটাই বলা যায় যে, নির্বাচন যেন ক্রমেই অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। আস্থার সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের অন্যতম অলঙ্কার হলো নির্বাচন। এই নির্বাচন যদি প্রশ্নবিদ্ধ হতেই থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের পথও খুব সঙ্গত কারণেই অমসৃণ হবে। নব্বইয়ের গণজাগরণের অধ্যায়ের কথা যদি আলোচনায় আনি কিংবা এর পূর্বাপরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট যদি আলোচনায় আসে, তাহলে সর্বাগ্রে যে কথাটি বলতে হবে তা হলো- এ দেশের সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রের জন্য ব্যাপক অবদান রয়েছে। তাদের ত্যাগ-সংগ্রামের দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে নিঃসন্দেহে এ কথাও বলতে বাধ্য যে, গণতন্ত্রপ্রেমী এ দেশের মানুষের অবদান অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্তযোগ্য। এ জন্য জীবনদানের দৃষ্টান্তও তো আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা-সূত্র মোতাবেক যদি আমরা এ দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চালচিত্র বিশ্নেষণ করি, তাহলে কোনোভাবেই কি স্বস্তিবোধ করতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তর জটিল নয়। এই কলামে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রসঙ্গে গত ছয় মাসে কয়েকটি কলাম লিখেছি। সম্প্রতি সিইসির কিছু কথায় নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ৮ মার্চ সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বক্তব্য দিতে গিয়ে সিইসি এমন কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করল। তার এসব কথার মধ্য দিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। ইতিপূর্বে একাধিকবার বলেছি, নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে যে জনপ্রত্যাশা রয়েছে, তা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এ নিয়ে আজ আর নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণে না গিয়ে সিইসির মন্তব্যের ওপর আলোকপাত করি। সিইসি কি নতুন করে বিষয়গুলো উপলব্ধি করে কিংবা বিবেকের তাগিদে কথাগুলো বলেছেন? যদি বিবেকের তাগিদ অনুভব করে থাকেন তাহলে বলব, এটা একটা শুভ দিক। আর যদি এসব কথার পেছনে ভিন্ন কোনো কৌশল থেকে থাকে, তাহলে এটি নিশ্চয়ই বড় রকমের উদ্বেগের কারণ। আমরা নতুন করে আর কোনো শঙ্কার তাড়ায় তাড়িত হতে চাই না। আমরা চাই, আমাদের যে অর্জনগুলোর বিসর্জন ঘটেছে, সেসব পুনরুদ্ধারে নবপ্রত্যয়।
হঠাৎ করে সিইসি বলে বসলেন, ইলেকট্রনিক ভোটের মেশিনে ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনের দু’দিন আগে তিনি এ কথা বললেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার এই বক্তব্যের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগের বিষয়টি। নির্বাচন সংক্রান্ত সব ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কিংবা কোনো কমিশনার যদি এখন এমন কথা বলেন, তাহলে সাধারণ মানুষের এ ধারণা হতেই পারে- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এও প্রশ্নের বিষয় হতে পারে- প্রকারান্তরে কি তাহলে তারা বাস্তবতা স্বীকার করে নিলেন? মানুষের মনে যদি এমন প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে তা অমূলক বলা যাবে কি? তিনি এও বলেছেন, ‘নির্বাচনী পরিবেশ ক্রমে অবনতির দিকে যাচ্ছে’ (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়, ৯ মার্চ, ২০১৯)। আমরা তো এ কথাটাই এতদিন ধরে বলে আসছিলাম। তারা বরাবরই আমাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমাদের গঠনমূলক সমালোচনা বক্রভাবে নিয়ে এসব ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও নেতিবাচক কথা বলেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, বিলম্বে হলেও সিইসি আমাদের কথাই যেন মেনে নিলেন। নির্বাচনী পরিবেশ উন্নত করা, অধঃপতন ঠেকানোর দায়দায়িত্ব সর্বাগ্রে তাদেরই। তারা যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে এর অশুভ ছায়া নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত হবে- এটিই তো স্বাভাবিক এবং হয়েছেও তাই। আমাদের নানা ক্ষেত্রে আস্থার সংকট সৃষ্টির প্রেক্ষাপট কিন্তু দায়িত্বশীলদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। আস্থার সংকট যদি এভাবে প্রকট হতেই থাকে, তাহলে নানা শঙ্কা তাড়া করতেই থাকবে।
একটি সমাজে নানারকম অশুভ চক্র থাকে। তাদের নানারকম অপক্রিয়ায় দেশ-সমাজ-জাতির ক্ষতিও হয়। কিন্তু এদের ঠেকানো এবং এরা যাতে এ রকম পথ সৃষ্টি করতে না পারে, এ জন্য সরকারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা কিংবা স্তর রয়েছে। এসব শাখা-প্রশাখা-স্তরের কিংবা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলরা যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ থাকেন, তাহলে অপক্রিয়া ঠেকানো তো দুরূহ কোনো বিষয় নয়। এ দেশের রাজনীতির অর্জনের যে খতিয়ান, তা অনেক বিস্তৃত। যা কিছু শুভ অর্জন এর সবকিছুই রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলনের ফসল। কিন্তু আমাদের অনেক অর্জনের যে বিসর্জন ঘটেছে, তাও তো অসত্য নয়। এও ঘটেছে পথহারা, গতিহারা রাজনীতির কারণেই। রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চা থেকেও আস্থার সংকট প্রকট হচ্ছে। এ জন্যই হীন স্বার্থবাদিতার শিকড় উৎপাটন দরকার। হীন স্বার্থবাদিতার দীর্ঘছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে অনেক কিছু। গণতন্ত্রের যে বিবর্ণ চালচিত্র কখনও কখনও আমাদের খুব মারাত্মকভাবে পীড়িত করে, এর জন্যও দায়ী কিন্তু রাজনীতির নামে অপরাজনীতির ফন্দি-ফিকির। আবারও বলি, প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনের দু’দিন আগে সিইসি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, তাতে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবস্থা, রাজনীতি ও গণতন্ত্র সম্পর্কে নতুন করে চিন্তিত-উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। ব্যালট বাক্স ভরে যাতে না রাখা যায়- এ সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে দাওয়াইয়ের কথা বললেন, তাতে তো প্রশ্ন কেবল বাড়ছে। রাজনীতিবিহীন সমাজ কিংবা রাষ্ট্র মজাপুকুরের মতো। নির্বাচন হলো রাজনীতি ও গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ। নির্বাচন ও রাজনীতি কলুষমুক্ত করতে না পারলে উন্নয়নও শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না। আমাদের দায়িত্বশীলরা এসব বিষয় যে বুঝেন না, তা তো নয়। তারা অবশ্যই বিজ্ঞ এবং সচেতন। কিন্তু যেসব কারণে আস্থার সংকট ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে, সেসব নিরসনে যদি উদাসীনতা চলতেই থাকে, তাহলে অকল্যাণের পথটাই আরও প্রশস্ত হবে।
এবার প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগে ভোটারদের উৎসাহ কমে যাওয়া বা হারিয়ে ফেলা যে কোনো সচেতন ও সভ্য জনগোষ্ঠীর জন্য অবশ্যই নেতিবাচক লক্ষণ। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে তৃণমূল স্তরের নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া ক্রমাগত যে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে, তা চরম ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। এ থেকে পরিত্রানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ভোটারের আস্থা কীভাবে ফেরানো সম্ভব, তা নিশ্চয়ই দায়িত্বশীলদের অজানা নয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন