মুহম্মদ জাফর ইকবাল ::
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ২১ লাখ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। এর মাঝে প্রায় ৮২ শতাংশ পাস করেছে। সময়মতো পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে; সময়মতো পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছে। মনে আছে, একটা সময় ছিল যখন হরতালের পর হরতাল দিয়ে আমাদের জীবনটাকে একেবারে এলোমেলো করে দেওয়া হতো? আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার সময় রুটিনের নিচে লিখে রাখতাম, অনিবার্য কারণে পরীক্ষা নেওয়া না গেলে অমুক দিন পরীক্ষা নেওয়া হবে। আমরা যারা একটু বেশি দুঃসাহসী ছিলাম, তারা সারাদিন হরতাল শেষে সন্ধ্যাবেলাও পরীক্ষা নিয়েছি। হঠাৎ করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে যেন পরীক্ষা নিতে পারি, সে জন্য মোমবাতি রেডি রাখতাম। শুধু মুখ ফুটে কোনো একটা রাজনৈতিক দলকে উচ্চারণ করতে হতো, অমুক দিন হরতাল। ব্যস, সারাদেশ অচল হয়ে যেত! মনে আছে, আমি অনেকবার রাজনৈতিক দলের কাছে অনুরোধ করতাম, হরতালের সময় যে রকম হাসপাতাল-অ্যাম্বুলেন্সকে হরতালমুক্ত রাখা হতো, সে রকম স্কুল-কলেজ এবং পরীক্ষা যেন হরতালমুক্ত রাখা হয়। কিন্তু কে আমাদের কথা শুনবে? সেই হরতাল দেশ থেকে উঠে গেছে। আমার মাঝেমধ্যে নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে হয়, সত্যিই এটা ঘটেছে নাকি স্বপ্ন দেখছি! এভাবে আরও কিছুদিন কেটে গেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে একদিন বোঝাতে হবে, হরতাল জিনিসটি কী!
শুধু যে হরতাল উঠে গেছে তা নয়। মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস থেকেও আমরা মুক্তি পেয়েছি। এই মাত্র কয়দিন আগেও মায়েরা রাত জেগে বসে থাকতেন, ফেসবুক থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ডাউনলোড করে সেটা সমাধান করিয়ে নিজের বাচ্চাদের হাতে তুলে দিতেন মুখস্থ করার জন্য (হয়তো বাবারাও কিংবা অন্য আত্মীয়-স্বজনও এটা করেছেন; কিন্তু আমার কাছে যেসব তথ্য এসেছে, সেখানে মায়েদের কথাটাই বেশি এসেছে। তাই মায়েদের কথা বলছি এবং সুস্থ-স্বাভাবিক মায়েদের কাছে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এ রকম কুৎসিত একটা বাক্য লেখার জন্য)। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আমার ক্ষোভটা একটু বেশি। কারণ মনে আছে, আমি এটা নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করার পর হঠাৎ করে আবিস্কার করেছিলাম, এই বিশাল নাটক করার পরও আমার সঙ্গে কেউ নেই! আমি মোটামুটিভাবে একা। কোনোভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বোর্ডগুলোকে একবারও স্বীকার করানো যায়নি যে, আসলেই দেশে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যাটির অস্তিত্ব স্বীকার করা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই সমস্যাটির সমাধান হবে কেমন করে? শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় যখন স্বীকার করতে শুরু করল যে, আসলেই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। তখন মোটামুটি ম্যাজিকের মতো সমস্যাটি দূর হয়ে গেল!
পরীক্ষার খাতা দেখার ব্যাপারেও একটা শৃঙ্খলা এসেছে। চোখ বন্ধ করে বেশি নম্বর দেওয়ার প্রক্রিয়াটাও মনে হয় বন্ধ হয়েছে, বাকি আছে শুধু প্রশ্নের মান। আগের থেকে যথেষ্ট উন্নত হয়েছে; কিন্তু এখনও মনে হয়, মানসম্মত প্রশ্ন করা শুরু হয়নি। শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না বলে অভিযোগ আছে। এখনও মাঝেমধ্যেই গাইড বই থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন চলে আসে। সে কারণে গাইড বইয়ের প্রকাশক এবং কোচিং ব্যবসায়ীদের অনেক আনন্দ। ভালো প্রশ্ন করা খুব সহজ কাজ নয়, একজনকে এই দায়িত্ব দিলেই সেটা হয়ে যায় না। কিন্তু যেহেতু একটা প্রশ্ন প্রায় ২০ লাখ ছেলেমেয়ে ব্যবহার করে, সেই প্রশ্ন অনেক মূল্যবান। তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়ানো দরকার। এ রকম প্রশ্নগুলো যারা করেন, তাদেরকে যে সম্মানী দেওয়া হয়, সেটা রীতিমতো হাস্যকর। আমি সুযোগ পেলেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বলি প্রশ্ন করার জন্য হোটেল সোনারগাঁওয়ে একটা সুইট ভাড়া করতে। প্রশ্ন কর্তারা সেখানে থাকবেন, ভাবনা-চিন্তা করে সুন্দর প্রশ্ন করে সেটা টাইপ করে একেবারে ক্যামেরা রেডি করে দিয়ে বাড়ি যাবেন। গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা আমার কথা বিশ্বাস করেন না। তারা ভাবেন, আমি ঠাট্টা করছি। আমি কিন্তু ঠাট্টা করে কথাগুলো বলি না, সত্যি সত্যি বলি। স্কুল-কলেজের শিক্ষক হলেই তাদেরকে হেলাফেলা করা যাবে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। যখন তারা ২০ লাখ ছেলেমেয়ের জন্য প্রশ্ন করছেন, তখন তারা মোটেও হেলাফেলা করার মানুষ নন। তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
পরীক্ষার মানসম্মত প্রশ্ন করা হলে অনেক বড় একটা কাজ হবে। সবাই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চায়। মানসম্মত প্রশ্ন হলে শুধু তারাই ভালো নম্বর পাবে, যারা বিষয়টা জানে। কোচিং সেন্টার থেকে ভালোভাবে পরীক্ষা দেওয়ার টেকনিক শিখে লাভ হবে না। সে জন্য ভালো প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভালো প্রশ্ন করার পরও আরও একটা বিষয় থেকে যায়। আমরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখন সকালে এক পেপার, বিকেলে আরেক পেপার পরীক্ষা দিয়েছি। প্রত্যেক দিন পরীক্ষা, মাঝে কোনো গ্যাপ নেই। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর ঝড়ের গতিতে পরীক্ষা শেষ! এটা নিয়ে যে আপত্তি করা যায়, সেটাও আমরা জানতাম না। খুব যে কষ্ট হয়েছে কিংবা পরীক্ষার পর অর্ধেক ছেলেমেয়ে পাগল হয়ে গেছে, সে রকম কিছু শুনিনি। সেই বিষয়টা ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যায় (আমার এই বক্তব্য শুনে পরীক্ষার্থীরা চাপাতি হাতে নিয়ে আমাকে খুঁজবে, সে রকম একটা আশঙ্কা আছে, তারপরও বলছি)। পরীক্ষা লেখাপড়া নয়, শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়ার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। ঝটপট পরীক্ষা শেষ করে বাকি সময়টা নির্ভেজাল আনন্দের মাঝে কাটানো হচ্ছে জীবনকে উপভোগ করা। বাচ্চাদের কেন জীবন উপভোগ করতে শেখাব না?
২
প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর আমরা পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনে পরীক্ষার্থীদের আনন্দোচ্ছল ছবি দেখতে পাই। এই বয়সটিতে সবকিছুকেই রঙিন মনে হয়। তাই পরীক্ষার পর তাদের আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসটিও হয় অনেক বেশি স্বতঃস্টম্ফূর্ত, অনেক বেশি তীব্র। দেখতে খুব ভালো লাগে।
কিন্তু প্রতি বছরই এই আনন্দে উদ্ভাসিত ছেলেমেয়েদের ছবি দেখার সময় আমি এক ধরনের আশঙ্কা অনুভব করি। এই বয়সটি তীব্র আবেগের বয়স; আমি নিশ্চিতভাবে জানি, অসংখ্য ছেলেমেয়ের তীব্র আনন্দের পাশাপাশি কিছু ছেলেমেয়ে রয়েছে, যাদের পরীক্ষার ফলটি তাদের মনমতো হয়নি। সে জন্য কয়দিন মন খারাপ করে থেকে আবার নতুন উৎসাহ নিয়ে জীবন শুরু করে দিলে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু সেটি হয় না। প্রতি বছরই দেখতে পাই- পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর বেশ কিছু ছেলেমেয়ে একেবারে আত্মহত্যা করে ফেলে। এ বছর এখন পর্যন্ত পাঁচটি ছেলেমেয়ের খবর পেয়েছি, যারা আত্মহত্যা করেছে। সারাদেশে এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এদের মাঝে ছেলে আছে, তবে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এসএসসি পরীক্ষার্থী আছে, সে রকম দাখিল পরীক্ষার্থীও আছে। পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি, সে জন্য আত্মহত্যা করেছে, যে রকম আছে; যথেষ্ট ভালো করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিপিএ ফাইভ হয়নি বলে আত্মহত্যা করেছে, সে রকম ঘটনাও ঘটেছে। কী ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা। একজন মানুষের জীবন কত বড় একটি ব্যাপার, সেই জীবনটি থেকে কত কী আমরা আশা করতে পারি, সেই জীবনটিকে একটি কিশোর কিংবা কিশোরী শেষ করে দিচ্ছে। কারণ তার পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি, এটি আমরা কেমন করে গ্রহণ করব? যখনই এ রকম একটি ঘটনার কথা পত্রপত্রিকায় দেখি, আমার বুকটি ভেঙে যায়। শুধু মনে হয়, আহা, আমি যদি তার সঙ্গে একটুখানি কথা বলতে পারতাম! মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারতাম জীবনটা কত বড়, তুচ্ছ একটা পরীক্ষার তুচ্ছ একটা ফলকে পেছনে ফেলে জীবনে কত বড় একটা কিছু করে ফেলা যায়! পৃথিবীতে সে রকম কত উদাহরণ আছে। প্রত্যেকটা মানুষকেই জীবনে কত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়। একজন মানুষের জীবনে যতটুকু সাফল্য তার থেকে ব্যর্থতা অনেক বেশি। সেই ব্যর্থতা এলে কি কখনও হাল ছেড়ে দিতে হয়? ভবিষ্যতে আরও কত সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে, আমরা সেটি কি কল্পনা করতে পারি?/
কিন্তু আমার কখনও এই অভিমানী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হয় না। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার সুযোগ হয় না। শুধু পত্রপত্রিকায় খবরগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি আশা করে থাকি, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এবং তাদের বাবা-মায়েরা বুঝতে পারবেন যে, পরীক্ষার এই একটি ফল পৃথিবীর বিশাল কর্মযজ্ঞের তুলনায় কিছুই না। পরীক্ষায় মনের মতো ফল না করেও একটি চমৎকার জীবন হওয়া সম্ভব। শুধু ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হওয়াই জীবন নয়। ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে এই পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ আশ্চর্য রকম সুখী হয়ে জীবন কাটিয়েছে। তারা পরিবারকে দিয়েছে, সমাজকে দিয়েছে, দেশকে দিয়েছে, এমনকি পৃথিবীকে দিয়েছে। লেখাপড়ার সত্যিকার উদ্দেশ্যটি মনে হয়, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কিংবা তাদের বাবা-মাদের এখনও বোঝাতে পারিনি!
৩.
আত্মহত্যার খবর পড়ে যখন মন খারাপ করে বসে থাকি, তখন তার পাশাপাশি অদম্য মনোবলের একজনের কাহিনী পড়ে আবার মনটি আনন্দে ভরে ওঠে। তামান্না আখতার নামে একটি কিশোরী জন্ম নিয়েছে দুই হাত এবং একটি পা ছাড়া। সে সেই ছেলেবেলা থেকে অসাধারণ লেখাপড়া করে এসেছে; এসএসসিতেও তার মনের মতো পরীক্ষার ফল হয়েছে। আমার আনন্দ সেখানে নয়, আমার আনন্দ তার স্বপ্নের কথা পড়ে। সে বড় হয়ে প্রথমে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, এখন সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে! আমি মাঝেমধ্যে নতুন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের সামনে বক্তৃতা দিই। যদি বেঁচে থাকি তাহলে এমন তো হতেও পারে যে, সে রকম কোনো একটি সভায় হঠাৎ করে দেখা সামনে একটি হুইলচেয়ারে মাথা উঁচু করে তামান্না বসে আছে। স্বপ্ন দেখতে দোষ কী?
এবার আরও একটি আনন্দের ব্যাপার হয়েছে। আমি সবসময়ই বলে থাকি, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি যে এখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা সমানভাবে লেখাপড়া করে যাচ্ছে। আমি মোটামুটিভাবে বিশ্বাস করি, মেয়েরা যখন জীবনের সব ক্ষেত্রে ছেলেদের সমান সমান হয়ে যায়, তখন এই দেশটি নিয়ে আমাদের আর কোনো দুর্ভাবনা করতে হবে না।
এবারে এসএসসি পরীক্ষার ফল দেখে মনে হলো, আমরা সেদিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে!
মেয়েরা এর মাঝে ছেলেদের থেকে ভালো করতে শুরু করেছে।