BAME-র ভ্যাকসিনে অনীহা, প্রতিকার ও ভ্যাকসিনের অনালোচিত সুফল

॥ Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA ॥

সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে বৃটেনে BAME-দের মধ্যে ব্ল্যাক মাইনরিটির শতকরা ৭২ ভাগ এবং বাংলাদেশী ও পাকিস্তানীদের মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগ কোভিড ভ্যাকসিন নিতে চান না। বিষয়টির গভীরে প্রবেশ না করে এর একটি ভাসাভাসা diagnosis খাড়া করানোকে আমি সঠিক মনে করিনা। আমার অভিজ্ঞতায় এই পুরো BAME গ্রুপ যারা ভ্যাকসিন নিতে চান না তাদের আমি দুটো ভাগে ভাগ করতে চাই। একটি দলের মধ্যে কাজ করছে reluctance, আরেকটি দলের মধ্যে কাজ করছে Scepticism.

যারা reluctant তাদের মধ্যে সঠিক তথ্যের অভাব এবং অ-বৈজ্ঞানিক ও অ-ধর্মীয় কিছু ভুল তথ্যের কারণে তারা বিভ্রান্ত। এই দলটি হচ্ছে মুলত বাংলাদেশী ও পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত। এই দলটির সঙ্গে কাছাকাছি কাজ করে আমি দেখেছি সততার সঙ্গে এবং ধৈর্য্য সহকারে সহজ করে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার পর তাদের অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে রাজি হয়েছেন যদিও তারা আদতে ভ্যাকসিনের ঘোর বিরোধী ছিলেন।

আর আরেকটি দল যারা Sceptic তারা সবই জানেন, বোঝেন কিন্তু তারা এর সঙ্গে একমত নন। এই গ্রুপটি মুলত ব্ল্যাক মাইনরিটি। সরকার এ বিষয়টির একটি superficial সমাধান হিসেবে নানান ভাষায় তথ্যগুলো দিয়ে স্থানীয় সরকারের সাহায্যে বিতরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভাবখানা এই যে ইংরেজি না জানার কারণে তারা ভ্যাকসিন নিতে এগিয়ে আসছেন না অর্থাৎ সমস্যাটা ভাষাগত সুতরাং সমস্যাটা ব্ল্যাক মাইনরিটির। ONS এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারের ভ্যাকসিন বিষয়ক সহজ ইংরেজি নির্দেশনা বুঝতে পারে না এমন লোকের সংখ্যা বৃটেনে ১.৩%, তবে বাংলাদেশী মহিলাদের মধ্যে এটি ৫% এর একটু বেশী এবং বিশেষভাবে নিউহ্যাম বারাতে এটি সব চাইতে বেশী।

একটু পেছনের দিকে তাকানো প্রয়োজন। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামাতে ‘টাসকেগী সিফিলিস ষ্টাডি’ -র অংশ হিসেবে আফ্রিকার বংশোদ্ভুত সিফিলিসে আক্রান্ত পুরুষদের না জানিয়ে বিনা চিকিৎসায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে পেনিসিলিন যে সিফিলিসের কার্যকরী ঔষধ তা জানবার পরেও ব্ল্যাক মাইনরিটিকে পেনিসিলিন দেওয়া হয়নি। ১৯৭৪ সালে অবশ্য ন্যাশনাল রিসার্চ নামে কড়াকড়ি আইন পাশ করে এ ধরনের unethical রিসার্চ বন্ধ করা হয়েছে।

পরবর্তীতে এর সম্পূরক আরো কিছু আইন বিশ্বব্যাপী কড়াকড়িভাবে করা হয়েছে যার কারণে বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের কোনো কিছু আর ঘটতেই পারেনা। তবে সেই ‘টাসকেগী ষ্টাডির কথা বিশ্ববাসী বিশেষ করে ব্ল্যাক মাইনরিটি আজও ভোলেনি। আজকের প্রজন্ম বই পড়ে আর তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে সে গল্প শোনাতে কর্তৃপক্ষের প্রতি তাঁদের অবিশ্বাস এখনো পুরোপুরি যায়নি যদিও এ ধরনের unethical গবেষণা আজকের বিশ্বে একেবারেই অসম্ভব!

কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ইতিহাসকে স্বীকার করে দু:খ প্রকাশ করে বলা যে বর্তমান বিশ্বে এ রকম ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। এ কথা না বলে শুধুমাত্র ব্ল্যাক এথনিসিটির কাউকে মন্চে উঠিয়ে একই কথা বল্লেই সবাই সে কথা শুনেছনা। আমার মতে এখানে ম্যাসেন্জার কে তার যতটা প্রভাব আছে তার চাইতেও জরুরী হচ্ছে কি ম্যাসেজ দেওয়া হচ্ছে। তাইতো আমরা ব্ল্যাক মাইনরিটিকে বলতে শুনেছি ‘মারকাস রাসফোর্ড চৌকষ ফুটবল খেলোয়াড় হতে পারেন তবে আমাদের শরীরে সুঁই ফোটানোর ব্যাপারে তিনি কি জানেন?’

তাই আমি বলব, এখানে ইংরেজি অনুবাদের বিষয়টি পরে আসা উচিত, আগে প্রয়োজন সততার সঙ্গে সহজ ভাষায় বৈজ্ঞানিকভাবে সব কিছু ব্যাখ্যা করা। প্যান্ডেমিকে আর যাই হোক এ যাত্রা বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সবাই টের পেয়েছে। কাজেই মোদ্দা কথা হচ্ছে যারা ভ্যাকসিন নিতে চান না তাদের সবার মুল কারণ এক নয় এবং প্রতিকারও এক নয়।

এবার আসুন আমরা দেখি কেন আমাদের সকলের ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরী। আমাকে সম্প্রতি একটি টকশোতে একজন দর্শক ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি বৃদ্ধ নন, তাঁর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল বলে তাঁর বিশ্বাস, সে কারনে তার ধারনা করোনা হলেও তাকে তেমনভাবে জেঁকে বসবে না এবং এতদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতে তিনি করোনামুক্ত থাকতেও পেরেছেন, তাহলে শুধু শুধু তিনি কেন ভ্যাকসিন নেবেন যেখানে বলা হয়ে থাকে কোনো ঔষধ, কোনো ভ্যাকসিনই শতভাগ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়। এটি খুবই সঙ্গত একটি প্রশ্ন।

এ প্রশ্নের উত্তরে দুটো কথা বলা প্রয়োজন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর বাড়ীতে ফিরেছেন তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশকে ৫ মাসের মধ্যে আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে আর সেই এক তৃতীয়াংশের প্রতি আটজনের একজন মার গেছেন। করোনা থেকে পরবর্তীতে ফুসফুস সহ অন্যান্য অর্গানের ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি আমরা এখন ধীরে ধীরে জানতে পারছি। আপনি সুস্থ সবল মাঝ বয়সী অথবা তরুণ হতে পারেন, আর সে কারণেই বাকীটা জীবন শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে নিশ্চয়ই দুরে থাকা প্রয়োজন। এছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে কোনো ঔষধ বা ভ্যাকসিন দেওয়া হয় তার benefit এবং risk assess করার পর। ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যাপারে benefit এর পরিমাণ ঢের বেশী।

মনে রাখবেন আমাদের শিশু সন্তানদের জন্যে কিন্তু এখনো ভ্যাকসিন বের হয় নি। তাছাড়া কিছু কিছু শারীরিক অবস্থা এবং কিছু কিছু চিকিৎসা চলাকালে ভ্যাকসিন দেওয়া যায় না। ক্যাপটেন স্যার জন মুর যিনি কোভিডের জন্যে বৃটেনে ইতিহাস গড়লেন তাঁকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন কথা হচ্ছে এ ধরনের মানুষ এবং আমাদের শিশু সন্তান যাদের জন্যে এখনো ভ্যাকসিন নেই তাদেরক আমরা কিভাবে রক্ষা করব?

আমাদের যেটা করতে হবে তা হচ্ছে আমাদের সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে হবে কারণ কমিউনিটিতে যখন সব প্রাপ্ত বয়স্করা ভ্যাকসিন নেবেন তখন আমাদের শিশু আর পরিবারের যেসব ভালনারেবল লোকজন ভ্যাকসিন নিতে পারছেন না তাদের চারপাশে ভ্যাকসিন নেওয়া অসংখ্য মানুষ যেন একটি সুরক্ষার বেষ্টনী গড়ে তুলতে পারেন যাতে ভাইরাস আর কোনো জায়গা না পায় আমাদের প্রিয়জনদের শরীরে প্রবেশ করার। এরপরও কি আমরা ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধা করব আর ভ্যাকসিন না নিয়ে ভাইরাসকে মিউটেট করার সুযোগ দিয়ে আমাদের প্রিয়জনদের অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দেব?

লেখক : ডক্টর জাকি রিজওয়ানা আনোয়ার, মা ও শিশু বিশেজ্ঞ। চ্যানেল এসের সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার এবং সিনিয়র কমিউনিটি এক্টিভিস্ট।

Advertisement