জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনের ভাষণে কোভিডমুক্ত বিশ্ব গড়তে সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মুল্যে টিকা প্রাপ্যতায় যথাযথ বৈশ্বিক পদক্ষেপ দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, বর্তমান ‘টিকা-বিভাজন’ প্রবণতা শুধুমাত্র মহামারিটিকেই দীর্ঘস্থায়ী করবে। কোভিডমুক্ত বিশ্বের জন্য আমাদের অবশ্যই সব মানুষের জন্য সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে টিকা বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানান তিনি।শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেওয়া ১৭তম বাংলা ভাষণে একথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা বৈষম্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ যাবৎ উৎপাদিত টিকার ৮৪ শতাংশ উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের দেশগুলো ১ শতাংশেরও কম টিকা পেয়েছে। জরুরিভিত্তিতে এ টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারবো না।অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্ত্বে ছাড় পেলে বাংলাদেশও বিপুল পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম।ভাষণে, বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বহুপাক্ষিকতাবাদ ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক হিসেবে বাংলাদেশ এই সংকটকালে জাতিসংঘকে আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখে। সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের অবশ্যই ‘অভিন্ন মানবজাতি’ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে, সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য আবারও এক সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে।
মহামারি করোনা মোকাবিলার পাশপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন তিনি। ফিলিস্তিন এবং আফগান সমস্যাও তার আলোচনায় উঠে আসে। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে পুনরায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।দুঃখজনক হলেও এই মহামারি আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, এই অভিন্ন শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন।প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবে বলেন, কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। গত বছর এ মহতী অধিবেশনে আমি কোভিড-১৯ টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বিশ্বনেতাদের অনেকে তখন এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেছিলেন। সে আবেদনে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। জরুরিভিত্তিতে এ টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারবো না। সবার জন্য সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে আবারও আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ‘ইন্টারগর্ভানমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ এর প্রতিবেদনে আমাদের এ গ্রহের ভবিষ্যতের এক ভয়াল চিত্র ফুটে উঠেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। ধনী অথবা দরিদ্র কোনো দেশই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদ নয়। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং ভালনারেবল-২০ গ্রুপ অব মিনিস্টারস অব ফাইন্যান্স-এর সভাপতি হিসেবে আমরা ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা- দশক ২০৩০’ এর কার্যক্রম শুরু করেছি। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের জন্য জলবায়ুকে ঝুঁকির কারণ নয় বরং সমৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে পরিণত করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।মহামারির প্রকোপে শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, স্বাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জনগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানান।মহামারিকালে প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারাও সম্মুখ সারির যোদ্ধা। তবুও তাদের অনেকে চাকুরিচ্যুতি, বেতন কর্তন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই সঙ্কটকালে অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য পঞ্চম প্রস্তাবে তিনি আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা আশা করি। মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে তাদের সাময়িক অবস্থানকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে বলপূর্বক কিছু সংখ্যক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে ভাষানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। আশ্রয় শিবিরে কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তাররোধে টিকা লাভের যোগ্য সবাইকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, রোহিঙ্গা সংকটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ নিতে হবে।শেষ করার আগে, প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বে শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার এই মহান সংস্থার সামনে বিগত প্রায় ৪৬ বছর আগে তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার বিয়োগান্তক অধ্যায় তুলে ধরেন।প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর একরকম জোর করেই দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করে বলেন, দেশে ফিরে আমি মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করি। জাতির পিতার স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যে আজও আমি কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকবো, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাব, ইনশাআল্লাহ।