ইমরান আহমেদ চৌধুরী।। পৃথিবীতে প্রত্যেক অঞ্চল বা এলাকায় জন্ম গ্রহণকারিরা ঐ এলাকার নামেই পরিচিত হয়ে থাকে সারা বিশ্বের কাছে। ওটাই ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠে ওদের জাতিগত পরিচয় এবং ঐ জাতিগত পরিচয়ই তাদের মুল পরিচয়। যেমন পারস্যে যারা জন্ম গ্রহণ করে তারা পার্সিয়ান বা ফার্সি এবং তাদের পরবর্তী হাজার বছর পরের প্রজন্মও সারা পৃথিবী তে সেই একই নামে পরিচিত হতে থাকবে । যেমন আমরা বংগে ( বাংলা) ( বাংলাদেশে) জন্ম গ্রহণ করাতে আমরা এবং আমাদের পরবর্তী হাজার বছর পরের প্রজন্ম ও ঐভাবে বাঙ্গালি হিসেবেই পরিচিত থাকবে ।
যেমন বনী ইসরায়েল সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রথম জন্ম গ্রহণ করেছিল জেরুসালেম কেন্দ্রিক প্রাগৈতিহাসিক দেশ ইসরায়েলে এবং তাই তারা ৫– থেকে ৬ হাজার বছর পরও ইসরায়েলী হিসেবেই পরিচিত, ঠিক তেমনিভাবে আজ থেকে খ্রিস্টের জন্মের ৩শ তার মানে আজ থেকে দুই হাজার তিনশ বছর যাবত কাশ্মীর উপত্যকার অন্যতম ( একমাত্র) জাতি হল কাশ্মীরি পণ্ডিতরা । সেই রাজা অশোকা থেকে বিশ্ববিজয়ী সেকান্দার বাদশা ( অ্যালেক্সজান্দার ) এর রাজত্ব কাল থেকেই প্রত্নতান্তিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত সত্য যে এই এলাকার আদিবাসীরা এই পণ্ডিতরাই ।
কালের বিবর্তনের মাঝেও এই আদিবাসীরা শতবাধা বিপত্তি, আগ্রাসন, অত্যাচার, অনাচার এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং শোষণ সহ্য করেই আসছিল গতকয়েক শত বছর যাবতই । কিন্তু এই নিরিহ, অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, শিক্ষিত (শতকরা ১০০ ভাগ ), পরোপকারী জাতিটি তাদের জন্ম ভূমিকে আঁকড়ে ধরে ছিল হাজার বছর ধরে । অশোকা থেকে জুলজু হয়ে জয়নাল আবেদিন থেকে সম্রাট আকবর এর রাজত্ব পাড় করে এসেছে এই সম্প্রদায়।
এরাই হল পর্বত অঞ্চলের আদিবাসি, পাহাড়ের চুড়া, হিন্দুকোষ পর্বত মালা, হিমালায়া, বরফ, তুষারপাত, বরফের সাদা চাদরে ঢাকা কাশ্মীর উপত্যকা শীত কালে আর গ্রীষ্মে সবুজ গাছের পাতা, নীল আকাশ এবং শত শত হ্রদ এর নীলজল বানায় কাশ্মীরকে ভূস্বর্গে আর সেই দেশের নিরীহ, মার্জিত, পর্বতের চুড়ার মত মহৎ মনের অধিকারী এই পণ্ডিত সম্প্রদায়। অত্যন্ত পরিশ্রমী এই জাতি, পাহাড়ের মতই এরা কষ্ট, বাধা, বিপত্তি, প্রতিকূলতা সহ্যশীল । কথায় জানি একটা মিলখুঁজে পাই আমার বাঙ্গালিত্তের সাথে ।
অনাদিকাল যাবত বসতি গড়ে তোলা এই সম্প্রদায়ের উপর আচমকা নেমে আসতে ক্রমশ এক রাজনৈতিক এবং গোত্রতান্ত্রিক ঝর , এক ভয়ংকর গোরা সাম্প্রদায়িক বিভাজন । শুরু হতে থাকে হিংসা, বৈষম্য, বিভেদ, উগ্রপন্থি আচরণ । ক্রমে ক্রমে ১৯৯০ সালে নেমে আসে সেই বাঙ্গালি জাতির উপর যেমন নেমে এসেছিল এক কুথসিৎকালো রাত সেই ২৫ মার্চ ১৯৭১ ঠিক তেমনি এক অন্ধকার নেমে আসতে থাকে এই নিরীহ, নম্র, পরিশ্রমী এবং অতীব শিক্ষিত পণ্ডিতদেড় উপড়ে।
শুরু হয় অত্যাচার, হত্যা এবং আক্রমণ এবং সেই প্রতিবেশী দেশের মদদপুষ্ট উগ্রপন্থীরা একে একে দখল করে নিতে থাকে এই পণ্ডিতদের ব্যবসা, জায়গা, ঘর, বাড়ি এবং এদের সহায় সম্পত্তি । আরম্ভ হয় তদানীন্তন প্রাদেশিক বা উপরাষ্ট্রীয় সরকারের নীরব উদাসীনতা এবং ভোটের রাজনীতিতে ভোট ব্যাঙ্ক রাজনীতির অঙ্কে পণ্ডিতরা নগণ্য বিবেচিত হয়েছিল কি না তা আজও না জানা এক অধ্যায় কিন্তু একথা বলা অত্যন্ত প্রযোজ্য যে তৎকালীন কাশ্মীরি সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার এর উন্নাসিকতার জন্য উগ্রপন্থীরা ক্রমান্বয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে আর অত্যাচার, জীবন, জান, মাল ও মান সম্ভ্রমের ভয়ে ঠিক আমাদের মতই ওরাও শসস্ত্র বছরের নিবাস থেকে গৃহহীন হয়ে প্রায় ৩ লক্ষ পণ্ডিতরা নিজের দেশেই রিফুজিতে পর্যবসিত হয় ।
নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! একদার প্রতিবেশী, একদার সহপাঠী, একদার মহল্লার নাগরিক, একদার ছাত্র, একদার ডাক্তারের রোগী রূপান্তারিত হয় শত্রুতে ; পরাক্রমশালী বর্বর শত্রু যে নাকি ধারালো তরবারি হাঁতে সদা সর্বদা প্রস্তুত আঘাত হানতে । মান, সম্ভ্রম, ইজ্জত, লজ্জা এবং বৃদ্ধ সহ শিশুদেড় জীবন বাঁচাবার জন্য ঐ পণ্ডিত সম্প্রদায় কাশ্মীর ত্যাগ করে বিভিন্ন এলাকায় এমনকি ওদের হাঁতে বানানো শহর জম্মু ও শ্রীনগরের খেলার ময়দানে তাবুতে আশ্রয় গ্রহণ করে হাজার হাজার পণ্ডিত পরিবার । যার পরনে যা ছিল তাই নিয়েই তারা গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সব স্মৃতি, ধন দৌলত, ছবি, সংসারের সকল কিছু যে জিনিশ যে ভাবে আছে সেই ভাবেই ফেলে রেখেই গৃহত্যাগ করে তারা ।
একবিংশ শতাব্দীর এক না জানা অধ্যায় হিসেবে রয়ে যায় এই না জানা ইতিহাস। লিখতে যেয়ে কেন জানি বার বার আমার নেত্র অশ্রু সিক্ত হয়ে পরছে তা বুঝতে পারছি না – না চাইলেও কেন যে বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে আমার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই মর্মান্তিক ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা – যখন ১৭ ই এপ্রিল ১৯৭১ এ ঠিক এভাবেই সবকিছু ফেলে জানের ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম– সে ছিল এক অগস্থ যাত্রা ।
যা নাকি আজও আমাকে বার বার নিপীড়ন এক মনোস্তাতিক যাতনা দেয় প্রতিদিন । সেই ১৯৭১ এর মৃত্যু ভয়ের দিন গুলো, ১১ বছর বয়েসে ৫ জন এর একটা পরিবারের আমি ই একমাত্র পুরুষ সদস্য – বাবা ও অগ্রজের যুদ্ধে যোগদান এবং আমার না খেয়ে থাকা ভারতের রিফ্যুজিক্যাম্পের সেই দিনগুলো আজ বার বার মনের চোখের পর্দায় ভেসে উঠে ।
আমি মনে হয় সেই দিক থেকে অনেক ভাগ্যবানই ছিলাম বলতে হয় যখন আমি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন ভারতবাসীরা, ভারতের সরকার আমাদের যে কি পরিমাণ সাহায্য করেছে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না এবং মৃত্যুর হাত বাঁচবার জন্য আশ্রয় দিয়েছে তার জন্য আমি আজীবন ভারতের নিকট কৃতজ্ঞ থাকবো ।
আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে এই পণ্ডিত সম্প্রদায়, প্রায় ৩০ বছর যাবত কেউই তাদের পৈত্রিক ভিটায় ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা কেউ কেউ এখনো তাদের মাতৃভূমি পৃথিবী ভূস্বর্গ বলে খ্যাত নিজের কাশ্মীরেও যেতে পারে নাই ।
হওত সহসা একদিন ওদেরও সুদিন ফিরে আসবে – আপন গৃহে তারাও ফিরে যাবে ; ফিরে যাবে সেই ওদের ছোট গ্যায় লতায়, পাতায় ঢাকা সবুজ কাশ্মীর উপত্যকায় । কিন্তু, সবচে’ অনুতাপের বিষয় হল যে আমরা মাত্র ২৫০০ মাইল দুরে বসবাস করেও ঘুণাক্ষরেও জানি না বা আমাদের পত্র পত্রিকায় কোন দিনও একটি বাক্যও উচ্চারিত হতে দেখি নাই বা পড়ি নাই । ঘর, বাড়ি, আপন মায়ের ভূমি ফেলে অন্য কোন স্বর্গও কোনদিন আত্মতৃপ্তি দিবে না বা দেয় না কাউকে। আমার মা ছোট বেলা শিখিয়েছিলেন, ‘‘জননী জন্মভূমি স্বর্গ্যাদোপী গরীয়সী ‘‘ অর্থাৎ বাংলায় মানে হল মা এবং জন্ম গ্রহণকারী দেশ যে কোন স্বর্গ থেকেও মহত্ত্বর ।
প্রাসঙ্গিক ভাবে কেন জানি বার বার আমার মনের আকাশের ঈশান কোণে একটা প্রশ্ন উকি মারছে তা জানি না, সেটা হচ্ছে, প্রায়শই পত্রিকায়, রেডিওতে, টেলিভিশনে দেখি বা পড়ি কিংবা শুনতে পাই যে, আমাদের দেশেও নাকি এক ধরনের ভুল এবং নীতিভ্রস্থ গোড়া ধর্মীয় নামধারী দল বা গোষ্ঠী আমাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দেড়কেও নাকি একই ধরনের প্ররোচনা বা উস্কানি দিচ্ছে – আমি সকলকে আবারও অনুরোধ করব যেন আমাদের সজাগ সুশীল সমাজ এবং দেশের আপামর জনগণ যাতে একত্রিত হয়ে এই ধরনের কোন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হওয়া প্রতিরোধ করে ।
একদা একজন নিপীড়িত, গৃহহীন, রিফ্যুজি , এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অনুজ এবং নিজেও একজন সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কায়মনো প্রাণে প্রার্থনা করি যাতে করে কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের গৃহত্যাগ এবং নিজের দেশে ফিরে যাওয়া তরান্বিত হয় এবং সাথে সাথে আমি এটাও প্রার্থনা করি যাতে করে আমার জন্মভূমি বাংলা মায়ের বুকে সকল ধর্ম, বর্ণ এবং সকল মতাবলম্বী মানুষ সুখে, শান্তিতে এবং সমৃদ্ধি বসবাস করতে পারে এবং সকলকে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে যাতে করে আমাদের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র সকল সময় সুদৃঢ় ভাবে বজায় থাকে ।
লেখক : ইমরান আহমেদ চৌধুরী। প্রতিষ্ঠাতা এবং চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, সিপিপিপি ডট অর্গ, ইউকে।