কেন ডলার-সংকটে বাংলাদেশ

মিজানুর রহমান খান :: একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে গিয়েছিলাম। একজন জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার বললেন, আমরা ডলার–সংকটে আছি। সহজে এলসি খুলতে পারছি না। শুনলাম, পেট্রোবাংলার এলসি খোলে অগ্রণী ব্যাংক। তারাও এলসি খুলতে পারছে না। গত বছর আগস্টের ১৭ তারিখ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘বিনিময় মূল্য বেঁধে দেওয়ার পরও ডলারের সংকট কাটছে না। সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমদানির ঋণপত্র খোলায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ডলার সংগ্রহে তারা দেশে-বিদেশে মনোযোগ বাড়িয়েছে। শুধু বেসরকারি ব্যাংক নয়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও পড়েছে একই সমস্যায়।’ ছয় মাস পরও দেখছি, অবস্থা অপরিবর্তিত।

নির্বাচনের আগেই আমরা জেনেছিলাম, গত সাত বছরের মধ্যে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নেতিবাচক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে ৩২০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল, সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৮৫ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি হয়েছে। বাংলাদেশ সবশেষ ঘাটতি দেখেছে ২০১০-১১ সালে, সেটা ছিল
৬৭৬ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানির থেকে আমদানির ফারাক বাড়ায় কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের ঘাটতি বেড়েছে। চার বছরের মধ্যে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে ঘাটতি ২০১৬-১৭ সালে প্রথম ঘটল। কেন এই অবস্থা?

আমরা জানি আমদানি বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে না। ২০১৭-১৮ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী গত অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ হারে। রপ্তানির চেয়ে আমদানি চার গুণ বেশি।

এই পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ছয় লাখ কোটির বেশি কোটি টাকা পাচার বিষয়ে জিএফআই রিপোর্ট। এই রিপোর্ট তৈরি করা হয় প্রধানত আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস (বেশি দাম দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েস (কম দাম দেখানো) বিবেচনায় নিয়ে। এর বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে কী ঘটতে পারে, তা যেকোনো সচেতন পাঠক অনুমান করতে পারেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে শুধু ২০১৭ সালেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে।

ডলারের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি এবং টাকার মূল্যমান হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্কের বিষয়টি উপেক্ষা করার সুযোগ আছে কি?

এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারত, যদি প্রবাসীদের আয়ে বিরাট বৃদ্ধি না ঘটাত। প্রবাসী আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে। আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসী আয় সাড়ে ১৪ শতাংশ হারে কমেছিল। এরপর প্রবাসী আয় ধনাত্মক হলেও রপ্তানি খাত থেকে আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় ঢের বেশি হওয়ায় চলতি লেনদেন ভারসাম্য বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স আরও খারাপ হয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঋণাত্মক ৯ হাজার ৭৮০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই ঋণাত্মক ঘাটতি ছিল মাত্র ১ হাজার ৩৩১ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ঋণাত্মক ঘাটতির মাত্রা সাত গুণের বেশি তীব্রতায় আঘাত হেনেছে। আশ্চর্যের বিষয়, এ বিষয়ে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আদৌ একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার মনে করলেন না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রতিবেদনে (২০১৭-১৮) অবশ্য উদ্বেগটা চাপা দেয়নি। সেই রিপোর্টের ভাষ্য হলো: ‘সার্বিক ব্যালেন্স অব পেমেন্ট উদ্বৃত্ত থাকার চিত্র পাল্টে গিয়ে ২০১৭-১৮ সালে ৮৮৫ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা গেল। অথচ ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ৩ হাজার ১৬৯ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।’ এখন প্রশ্ন হলো, রেমিট্যান্স বাড়ার পরও ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এমনভাবে নিম্নমুখী হলো?

২০১৪ সালে আমরা একতরফা নির্বাচন নিয়ে তর্ক করলাম। আর ওই বছরেই ৭৩ হাজার কোটি টাকা (জিএফআই রিপোর্ট) পাচার হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান গত বছরের ৩১ জুলাই তথ্য দিয়েছিলেন, রপ্তানির নামে চার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে মানুষ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে টাকা কেন সরিয়ে নিচ্ছে? সবশেষ যে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হলো, সেটা কি এত দিনকার অবস্থা বদলে দেবে? জাতীয় সংসদে বিরোধী দলকে প্রথমবারের মতো সরকারি হিসাব কমিটির কর্ণধার করা হয়েছে। আমরা বাহবা দিচ্ছি। কিন্তু ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ঘাটতি, পাচার ইত্যাদি নিয়ে উত্তপ্ত না হোক, হিমশীতল আলোচনাও কি আশা করা যায়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই একই প্রতিবেদনে (চ্যাপ্টার ১, পৃষ্ঠা ৪ ও ৫) বলা হয়েছে, ‘মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির সঙ্গে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অনুপাত গত অর্থবছরের ২৩ দশমিক ১ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশে স্থির রয়েছে।’ প্রায় এক দশক ধরেই কিন্তু এটা ২৩–এর ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে আমরা বিশেষজ্ঞ না হয়েও খালি চোখে দেখছি, ব্যক্তি খাতে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না, বরং পাচার ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টসে টানাপোড়েন দেখা দিলেই বিশ্বের দেশে দেশে বেইল আউট কথাটি সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে যার যত বেশি ঘনিষ্ঠতা, এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাকে তত বেশি তাদের কাছে শশব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সম্প্রতি আমরা ওই দুটি দেশে ভোঁ দৌড় দিতে দেখেছি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে আইএমএফের কাছেই ধরনা দিতে হয়েছে।

ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঋণাত্মক অবস্থায় পড়া দেশগুলো বেইল আউটের জন্য অনেক সময় আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। আমরা যখন আইএমএফের কাছ থেকে সর্বশেষ (আট বছর আগে) ঋণ নিয়েছিলাম, তখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকেও নিচে নেমে ছিল। শেখ হাসিনার টানা শাসনামলের গোড়ায় আইএমএফের এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি বা ইএসএফের অধীনে সর্ববৃহৎ ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। এরশাদ আমলে একই সংকটে পড়েই বাংলাদেশকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়। তখন কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির নামে বাংলাদেশকে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার মেনে নিতে হয়েছিল।

এখন যেতে হলে রূপপুর আণবিক প্রকল্প ও পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং খাত বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির মতো বিষয় নিয়ে হয়তো প্রশ্ন তুলবে। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গত মে মাসে বলেছিলেন, ‘রূপপুর, মেট্রোরেলসহ বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির জন্যই এমন ঘাটতি। তবে আমদানির বিল ফরেন এইডে মিটছে।’ বাস্তবে রূপপুর ও পদ্মার কলকবজা তো বটেই, খাদ্য আমদানিতেও বিশাল অঙ্ক নিজস্ব ডলারে বাংলাদেশ শোধ করছে, তাই এতটা টান। বাজেটে রাজস্ব আয় ও ফরেন এইড ইচ্ছা করেই মোটাতাজা করার মন্দ অভ্যাস এখনো চালু, যার অনেকটাই বাস্তবে উবে যায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য না হয়ে বাজেটের শীর্ষ খাত এখন বিদেশি ঋণের সুদ-আসল শোধ।

সরকার থেকে কেউ বলুক, এমনটা কেন ঘটছে। আর কত দিন চলবে। এর সম্ভাব্য বিপদগুলো কী হতে পারে। কেউ বলুক, গণতান্ত্রিক ও সুশাসনের ঘাটতির ক্ষতি টাকার অঙ্কে পরিমাপযোগ্য হয় না। কিন্তু মোটা দাগে ঘাটতি ও পাচারের টাকার পরিমাণ দিয়ে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায় কি না? আমি আমার ব্যাংকার বন্ধুকে বললাম, আগের থেকে এবার ভিন্ন কী আছে? তিনি বললেন, বৃহৎ প্রকল্পগুলো সব নিজের টাকায় হচ্ছে, আর সেগুলো বাস্তবায়নের পর্যায়ে আছে। সুতরাং আগের সংকট ও তা থেকে উতরানোর সঙ্গে এবারের চ্যালেঞ্জকে মেলানো যাবে না।

ডেইলি স্টার-এর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের নিবন্ধের একটি অভিমত প্রণিধানযোগ্য: ‘ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি সামষ্টিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ায় এবং তা এসডিজি অর্জনে বাধা তৈরি করে।’

Advertisement