ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: থাইল্যান্ডে গুহায় আটকে পড়া ১২ জন কিশোর ও একজন কোচ গুহার অন্ধকার থেকে ফিরে এসেছেন আলোর জগতে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘গুহা থেকে ঠিকরে এসেছে আলো’ শিরোনামে সম্পাদকীয় খুব সকালেই সেদিন আমার মনে ছড়িয়েছিল অনাবিল প্রশান্তির আমেজ। সেই আমেজেই পা বাড়িয়েছিলাম অফিসের পথে। কিন্তু ধাক্কা খেলাম শুরুতেই যখন লিফটের ভেতরে মোবাইলের স্ক্রিনে নিবিষ্ট হয়ে থাকা কিশোর ছেলেটি আমার উপস্থিতির তোয়াক্কা না করেই লিফটের দরজাকে বন্ধ হওয়ার নির্দেশ দিল। লিফটের দরজায় হালকা ধাক্কা খেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। ছেলেটি এক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়েই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার মেসেঞ্জারের চ্যাট বক্সে। তার অভিব্যক্তিতে দেখিনি বিন্দুমাত্র কোনো অনুশোচনা বা অস্বস্তির অনুভূতি।
লিফট থেকে বেরিয়ে ছেলেটি ছুটে চলল তার স্কুলের পথে। তার পোশাকে সংযুক্ত স্বনামধন্য স্কুলের নাম আর তার বিশালাকার ব্যাগটি আমার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসছিল। তৎক্ষণাৎ মনে আসে কয়েকটি প্রশ্ন; বইয়ের জ্ঞান কি ব্যাগেই বন্দী করে ফেলছে আজকালকার শিশু-কিশোরেরা? এখনকার শিক্ষা কি সৌজন্যবোধ, সহযোগিতা আর সহমর্মিতার কথা বলে না? শিশুদের সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত করে তুলতে পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতার জায়গাটিই-বা কোথায়? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে না পেলে আলোর মাঝে থেকেও আমাদের অজান্তে গুহার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কদিন আগে লিখেছেন, ‘মানবসম্পদকে প্রকৃত সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য মানবের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জ্ঞানগত এবং পেশাগত দক্ষতা, কর্মসংস্থান—এ রকম নানা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উন্নতির প্রয়োজন। এসবের অভাব দেখা দিলে মানবসম্পদ আপদে পরিণত হতে পারে।’ ইদানীং প্রায়ই ভয় হয় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিণতির কথা ভেবে। একটি জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিণত করার প্রথম ও প্রধান শর্তটি হলো শিক্ষার বিকাশ ও তার প্রসার। কিন্তু আমাদের এই প্রথম শর্তটিতেই রয়ে যাচ্ছে গলদ। বর্তমান বাংলাদেশে পাসের হার বেড়েছে, বেড়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। কিন্তু শিশু-কিশোর ও তরুণদের আচরণে এবং জীবনযাপনে শিক্ষার সেই দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে না। তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে, দিন-রাত এক করে পড়ছে। কিন্তু এত পড়েও পড়ার বোঝা যেন কিছুতেই নামছে না তাদের পিঠ থেকে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাদের ওপর আমাদের সীমাহীন প্রত্যাশার চাপ। ওরা যেন বইয়ের বোঝা আর প্রত্যাশা পূরণের একেকটি বোধহীন যন্ত্রমানব। আনন্দহীন শিক্ষাই যেন শিক্ষার বাস্তবতা আজকের শিক্ষার্থীদের কাছে। সামান্য যেটুকু অবসর বিনোদন ওরা পায়, তা কাটানোর জন্যও ওদের নির্ভর করতে হয় টেলিভিশন, ইউটিউব, মোবাইল গেমস কিংবা বিভিন্ন অ্যাপসের ওপর। ওদের জন্য নেই কোনো খেলার মাঠ। ওরা দিগন্ত চেনে না, ওরা প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেখে না। আজকাল স্কুল থেকেও বাচ্চাদের অর্ধেক পড়িয়ে বলা হয় বাকিটুকু গুগলে সার্চ দিয়ে জেনে নিতে। ওদের প্রোজেক্ট ওয়ার্কগুলো পরিপূর্ণ ইন্টারনেট-নির্ভর ছবি আর তথ্যে। গৃহশিক্ষক বাড়িতে এসে ছাত্র পড়ান বটে, তবে তার চোখ থাকে ভাইবার, হোয়াটসআপ কিংবা মেসেঞ্জারের চ্যাট বক্সে।
দুই বছর আগে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর বারবার আলোচনায় আসে শিশুদের নৈতিকতা-মূল্যবোধ শিক্ষার বিষয়টি। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎপর হয়ে ওঠে কারিকুলামে কীভাবে বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেটি নিয়ে। আর স্কুলগুলোও চালু করে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার কিছু সনাতন পদ্ধতি। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়। এ বিষয়গুলোও মুখস্থনির্ভর হয়ে উঠেছে। ‘বিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষা’ শিরোনামে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট-২০১৭-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নৈতিকতা-মূল্যবোধ শিক্ষার বর্তমান রীতিটি নির্দেশাত্মক পাঠদান প্রক্রিয়াভিত্তিক। সেখানে শিক্ষার্থীর নৈতিক আচরণের চর্চা বা চিন্তাভাবনা প্রকাশের সুযোগ সামান্য।
আশার কথা হলো, এ প্রতিবেদন আমাদের আরও জানায় নৈতিকতা-মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয় হওয়ার অঙ্গীকারের বিষয়টি। তাই তাদের এ সংকল্পকে কাজে লাগাতে হবে। নৈতিকতা-মূল্যবোধ শেখার জন্য ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে; যেন শিশুটি নিজের অজান্তেই অর্জন করতে পারে এ যোগ্যতাসমূহ। শিক্ষা কখনো চাপিয়ে দিয়ে হয় না। শিশু-কিশোরের জন্য চাই নির্ভার শিক্ষাদান পদ্ধতি, যা তাকে বুকভরে নিশ্বাস নিতে দেবে, দেবে স্বস্তি আর অবসর। থাইল্যান্ডের অন্ধকার গুহায় আটকে পড়া শিশুরা বলেছিল পড়ার অতিরিক্ত চাপ কমানোর কথা। তাদের সেই আবেদন এসেছিল পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমাদের সন্তানদের অন্তরে যে কথা প্রতিধ্বনিত হয়, আমরা কি তা শুনতে পাই?