লন্ডন, ৩১ মার্চ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অনন্য অবদানের স্মারক হিসেবে সেন্ট্রাল লন্ডনে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে ‘বাংলাদেশ সেন্টার’। ১৯৭১ সালে এই সেন্টারেই বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস চালু হয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষেই বিলেত প্রবাসী বাঙালিরা গড়ে তুলেছিলেন এই সেন্টার। ইতিহাসের সাক্ষী এই সেন্টারের প্রতিষ্ঠা এবং এর কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নব গঠিত ম্যানেজমেন্ট কমিটি।
গত ৩১ মার্চ রোববার বিশাল আয়োজনের মধ্যদিয়ে সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার হাতে সম্মাননা তুলে দেন কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কমিনিউটির বিশিষ্টজন ও ছয় শতাধিক আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে- তুমুল করতালির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানানো হয়।
পূর্ব লন্ডনের সুবিশাল রয়্যাল রিজেন্সি হলে বাংলাদেশ সেন্টারের এই বর্ণাঢ্য আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। যাদের মধ্যে পাঁচজনকে মরনোত্তর সম্মাননা দেয়া হয়েছে। সম্মাননা পাওয়া বাকী পাঁচজন সরাসরি রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন।
গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে। নানা চড়াই-উতরাই মাড়িয়ে বাংলাদেশ সেন্টারও পাড়ি দিয়েছে সমান পথ। বাংলাদেশের বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটির নতুন নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানানোর মত অভিনব আয়োজনের মধ্যদিয়ে নিজেদের অভিষেক ঘটালেন। এই আয়োজন দীর্ঘ ৪৮ বছর পর সেন্টারের ইতিহাসে গৌরবের এক নতুন অধ্যায় যুক্ত করলো। এ কারণেই অতিথিদের বক্তৃতার পুরোভাগেই ছিল নতুন নেতৃত্বের প্রশংসা। দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার অবশেষে যোগ্য নেতৃত্বের হাতে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন সকল বক্তা। বক্তারা বলেন, অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশাল এই অনন্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে নতুন নেতৃত্বের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
সম্মননা পাওয়া ব্যক্তিরা তাঁদের আনন্দের অনভূতি প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার পক্ষে তাঁরা যখন রাস্তায় নেমেছিলেন তখন তাঁরা কোনো স্বীকৃতি বা সম্মাননা পাওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। তাঁদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার যে সম্মান দেখিয়েছে তাতে তাঁরা অভিভূত।
বাংলাদেশ সেন্টারের নব নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি মো: দেলোয়ার হোসেন এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি মাহবুব আহমেদ যৌথভাবে দীর্ঘ এই অনুষ্ঠান পরিচালনায় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনমত সম্পাদক নবাব উদ্দিন এবং দুই সহকারী কমিশনার- কাউন্সিলর আব্দাল উল্লাহ এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের কমার্সিয়াল কন্স্যুলার এস এম জাকারিয়া। তাঁরা একে একে মঞ্চে ঢেকে সেন্টারের নবনির্বাচিত ম্যানেজমেন্ট কমিটির কর্মকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর সেন্টারের ১৫ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটিকে পরিচয় করিয়ে দেন জেনারেল সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সহ সভাপতি মুহিবুর রহমান মুহিব।স্বাগত বক্তব্যে মুহিব বলেন, বাংলাদেশ সেন্টার নানা প্রতিকূল সময় পার করে বর্তমানে প্রবাসীদের কাঙ্খিত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ভঙ্গুর দশা থেকে এই সেন্টারকে তুলে আনার সংগ্রামের কথা বলেন তিনি। তিনি জানান, ইতিমধ্যে হাজার হাজার পাউন্ডের দেনা কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেন্টার। আর চলমান সংষ্কার কাজ শেষ হলে এই সেন্টার একটি শক্ত অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাড়িয়ে যাবে। সেইসঙ্গে কমিউনিটির শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক নানা আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এটি।সেন্টারের প্রধান উপদেষ্টা নবাব উদ্দিন তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অংশ হিসেবে লন্ডনে বাংলাদেশ সেন্টার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরেন। এই সেন্টারকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য গৌরবের স্মারক হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ সেন্টার নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেন্টারে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কার্যক্রমের সূচনা হয়। বর্তমানে যে ভবনটিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন অবস্থি, সেই ভবন ক্রয়েও যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অবদান আছে। কিন্তু হাইকমিশনের কোথাও প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়া নেই। এটা দুঃখজনক।
বিশেষ অতিথি চ্যানেল এস- এর চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি বলেন, নতুন কমিটির অভিষেক আয়োজনিই তিনি অভিভূত। বিসিএ’র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াকুব বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মননা দিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার অনন্য নজির স্থাপন করবো। বিসিএ’র সাবেক প্রেসিডেন্ট পাশা খন্দকার বলেন, শুরুতেই চমক দেখিয়েছে সেন্টারের নব নির্বাচিত কমিটি। নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেন্টার সত্যিকার অর্থে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বক্তারা। সেন্টারের নব নির্বাচিত কমিটির কাজের প্রশংসা করেন বাংলাদেশ হাইকমিশনের পলিটিকেল কন্স্যুলার ড: শ্যামল কান্তি চৌধুরী । এছাড়া বক্তব্য রাখেন বিলেতে প্রথম ব্রিটিশ বাংলাদেশী জজ মিস স্বপ্নারা খাতুন, সুইনডন বারা কাউন্সিলের মেয়র কাউন্সিলার জুনাব আলী, মোলব্যালী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হক, লন্ডন বারা টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র সিরাজুল ইসলাম, স্পীকার আয়াছ মিয়া,মাহমুদ হাসান এমবিই,লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী,সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল আহমদ, ইউকে বিবিসিসি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুকিম আহমদ, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ইউকে’র ডাঃ আলাউদ্দিন আহমেদ এনটিভি’র সিও সাবরিনা হোসেন।
জেনারেল সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন জানান, ক্রমান্বয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা দেয়ার আয়োজন করবে বাংলাদেশ সেন্টার।
অনুষ্ঠানে জমজমাট ভোজ আয়োজনের পাশাপাশি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সংস্কৃতিক পর্বের পরিচালনা করেন সংগঠনের নব নির্বাচিত কমিটির কালচারাল সাব-কমিটির আহবায়ক শওকত মাহমুদ টিপু। বাংলাদেশ সেন্টারের চলমান সংস্কার কাজ তুলে ধলে একটি প্রমাণচিত্র দেখানো হয় অনুষ্ঠানে। অতিথিদের হাতে তুলে দেয়া হয় সেন্টারের সামগ্রিক তথ্য সংবলিত স্মারক ম্যাগাজিন।মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন সাব-কমিটির আহবায়ক আলী আহমেদ বেবুল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আহমদ এটি সম্পাদনা করেন।
নব নির্বাচিত কমিটি পদাধিকার বলে বাংলাদেশ সেন্টারের চেয়ার পারসন বাংলাদেশের বর্তমান হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। সহ সভাপতি যথাক্রমে মুহিবুর রহমান মুহিব, শাহানুর খান, আশরাফ উদ্দিন, কবির উদ্দিন, মো: নিজাম উদ্দিন, মানিক মিয়া এবং গুলনাহার খান।
জেনারেল সেক্রেটারি মো: দেলোয়ার হোসেন। জয়েন্ট সেক্রেটারি যথাক্রমে মাহবুব আহমদ, ফয়সাল আহমদ এবং তারাউল ইসলাম। চিফ ট্রেজারার মো: মামুন রশিদ। জয়েন্ট ট্রেজারার যথাক্রমে সিব্বির আহমদ, আক্তার আলী ও এ কে এম আবদুল্লাহ।
সাব-কমিটিগুলোর মধ্যে মেম্বারশিপ সাব-কমিটির আহবায়ক জবরুল ইসলাম, হেরিটেইজ সাব-কমিটির আহবায়ক দিলোয়ার হোসাইন ও যুগ্ম আহবায়ক করিম মিয়া শামীম, ইনফরমেশন অ্যান্ড এডভাইস সাব-কমিটির আহবায়ক জাকির হোসাইন ও যুগ্ম আহবায়ক মো: শহিদুর রহমান। ফাইন্যান্স অ্যান্ড ফাণ্ডরেইজিং সাব-কমিটির আহবায়ক এনাম উল হক চৌধুরী ও যুগ্ম আহবায়ক মো: আব্দুল আলিম রশিদ ফজলু। এডুকেশন সাব-কমিটির আহবায়ক জাহাঙ্গির খান এবং যুগ্ম আহবায়ক মো: নিজাম উদ্দিন। মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন সাব-কমিটির আহবায়ক আলী আহমেদ বেবুল। কালচারাল সাব-কমিটির আহবায়ক শওকত মাহমুদ টিপু। আইসিটি সাব-কমিটির আহবায়ক মো: শামীম আহমদ। হেলথ কেয়ার অ্যান্ড এলডারলি সাব কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মো: মিসবাবুল বর (লুকু)। ইয়ুথ অ্যান্ড স্পোর্টস সাব-কমিটির আহবায়ক সাদিক রহমান এবং যুগ্ম আহবায়ক ফখরুল ইসলাম। মেম্বারশীপ সাব-কমিটির যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার আলী।
এছাড়া বাংলাদেশ সেন্টারের চারটি কর্পোরেট মেম্বার- বাংলাদেশ হাইকমিশনের পলিটিকেল কন্স্যুলার শ্যামল কান্তি নাথ, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের ড. আলাউদ্দিন এবং হাউজিং এসোসিয়েশন টিওফ ও সোনালী ব্যাংকের একজন করে প্রতিনিধি কমিটিতে রয়েছেন। সংগঠনের চীফ এক্সিকিউটিভ হিসেবে আছেন এস এম মোস্তাফিজুর রহমান।
উপদেষ্টা কমিটি প্রধান উপদেষ্টা নবাব উদ্দিন। অন্যান্য উপদেষ্টারা হলেন যথাক্রমে আশুক আহমদ আশুক, এম এ মুনিম, খালেদ চৌধুরী, ড. হালিমা বেগম আলম, লোকমান হোসাইন, নুরুল করিম, নুরুল ইসলাম মাহবুব, হাজী আব্দুল শফিক, মো: আফাজ উদ্দিন, প্রফেসর ড. নুরুন নবী, আব্দুল বারী, মাহবুব রহমান, হেলাল উদ্দিন খান ও ড. সানাওয়ার চৌধুরী।
সম্মাননা পেয়েছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন আলহাজ্ব মিম্বর আলী(মরনোত্তর), বেণু ভূষণ চৌধুরী (মরনোত্তর), মিসেস মুন্নি রহমান (মরনোত্তর), মোহাম্মদ তৈয়বুর রহমান (মরনোত্তর), আলহাজ মোহাম্মদ আবদুল রকিব (মরনোত্তর), সামসুল আলম চৌধুরী, আলহাজ খন্দকার ফরিদ উদ্দিন, আতাউর রহমান খান, হাফিজ মজির উদ্দিন, সুলতান মাহমুদ শরীফ, আলহাজ শামসুদ্দিন খান, মাহমুদ রউফ, কবির উদ্দিন, মোহাম্মদ জিল্লুল হক ও ফেরদৌস রহমান।
রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন লোকমান হোসাইন, আতিকুর রহমান খান (আনা মিয়া), খলিলুর রহমান কাজী ওবিই, ড. নজরুল ইসলাম এবং মতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশ সেন্টারের ব্যবস্হাপনায় এবং অনুসন্ধানী টিভি সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়ের সার্বিক তত্বাবধায়নে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে চারু শিল্পী আব্দুস সামাদ বাংলাদেশ সেন্টারের জন্য নিজের অংকন করা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি প্রতিকৃতি তুলে দেন বাংলাদেশ সেন্টারের ম্যানেজমেন্ট কমিটির নিকট।