মুক্তিযুদ্ধ-‘গৃহযুদ্ধ’ ও ধর্ষণ

১৯৭১ নিয়ে গবেষণার জন্য ইয়াসমিন সাইকিয়া এসেছিলেন বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে। বিদেশ থেকে যাঁরা ঢাকা আসেন ১৯৭১ নিয়ে গবেষণা করতে, তাঁদের অনেকেই আমার বা শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইয়াসমিনও করেছিলেন। তাঁর একটা সুবিধা ছিল, তিনি বাংলা জানতেন ও বুঝতেন। আসামে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইয়াসমিন তখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। তারপর আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। শুনেছিলাম তাঁর গবেষণা শেষ হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর বইটি প্রকাশিত হয়েছে। নাম উইম্যান ওয়ার অ্যান্ড দি মেকিং অব বাংলাদেশ : রিমেম্বারিং নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান, ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস বইটি প্রকাশ করেছে। ২০১৬ সালে যখন বেড়াতে যাই যুক্তরাষ্ট্রে তখন বইটি হাতে আসে।

ইয়াসমিন এ বই লেখার জন্য ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ঘুরেছেন। অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি নারী যেভাবে ভায়োলেন্সের সম্মুখীন হয়েছে ১৯৭১ সালে তাই তুলে ধরতে চেয়েছেন, তাঁর ভাষায়-

“Concentrating on the relationships between nation, history and women.”

ইনসানিয়াত কীভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল ১৯৭১ তার বিবরণই তিনি তৈরি করতে চেয়েছেন।

বিদেশিরা তাঁদের মতো করে লিখবেন সেটি স্বাভাবিক, তাঁদের ব্যাখ্যা আমাদের মনপূত নাও হতে পারে। কিন্তু, প্রতিটি দেশের ইতিহাসে কিছু বিষয় আছে, যা মৌলিক যাকে গৌণ করা উচিত নয়। বিদেশি ঐতিহাসিকদের একটি বড় অংশ এই ভুলটি করেন। এটি সবক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত তা নয়। যে দেশের ইতিহাস তারা লিখছেন সে দেশের ভাষার সঙ্গে তাদের পরিচয় নেই। তাঁদের রচনার কাঠামো নির্মিত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের লেখকদের রচনার ওপর।

ইয়াসমিন বাংলা জানেন; কিন্তু, প্রায় কোনো বাংলা বই-ই তিনি ব্যবহার করেননি তার কাঠামো নির্মাণে। তাঁর গ্রন্থপঞ্জির মধ্যে বাংলা বইয়ের সংখ্যা নগণ্য। আমার মনে হয়েছে এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির গরমিল হয়ে যায়।

ইয়াসমিনের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘দি টোল্ড অ্যান্ড আনটোল্ড স্টোরিস অব নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান’ এর প্রথম লাইনটিই বিশ্লেষণ করা যাক। লিখেছেন তিনি, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একাধিক যুদ্ধ শুরু হয়। এই একাধিক যুদ্ধ কী?

১. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বা সিভিল ওয়ার।

২. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ।

৩. বাঙালি ও বিহারির মধ্যে যুদ্ধ এবং

৪. পূর্ব পাকিস্তানের নারীদের বিরুদ্ধে একটি ‘জেন্ডার ওয়ার’।

এক এবং তিন নম্বর যে যুদ্ধের কথা বলেছেন, তাতেই আমাদের আপত্তি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বললে পরিস্থিতিটি বদলে যায়। গৃহযুদ্ধ হলে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা থাকে গৃহযুদ্ধ দমনে। এবং কেন্দ্রীয় শক্তি যখন তা দমনে হত্যা ও নিপীড়ন চালায় তখন তা মানবতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য নাও হতে পারে।

rohinga

যেমন, নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার যুদ্ধ যা গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ কোন অর্থেই গৃহযুদ্ধ ছিল না। ১৯৭০ সালে শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ তাতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সামরিক সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলি আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইচ্ছুক ছিল না।

আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন শুরু করে, একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। কিন্তু ২৫ মার্চে অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং সেই সিভিল কর্তৃত্বের অধীনে মুক্তিফৌজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সুতরাং এটি গৃহযুদ্ধ হতে পারে না।

বিহারি-বাঙালি যুদ্ধ হলো কখন? মার্চের আগেই বিহারিরা পাকিস্তানের সহযোগী শক্তি হিসেবে ভায়োলেন্সের সূত্রপাত করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙালিরা তা প্রতিরোধ করে, প্রতিশোধ নয়। কিন্তু, সবক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। কারণ, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সবাইকে সতর্ক করে দেন দাঙ্গার বিরুদ্ধে। দাঙ্গা ও যুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য আছে। ইয়াসমিন নিজেই লিখেছেন, পাকিস্তানপন্থী বাঙালি ও বিহারিরা আলবদর আলশামস নামে প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করে এবং “Raped, looted, killed and terrorized noncombatants in East Pakistan.”

আমি ২৫ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত ছিলাম মিরপুরের পল্লবীতে। তখনও আলবদর আলশামস শান্তি কমিটি কিছুই গঠিত হয়নি। আমি দেখেছি মিরপুরের বিহারিরা তখন কী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল ঐ এলাকায়, মুক্তিবাহিনী রাজাকার আলবদর যারা ছিল সশস্ত্র তাদের ওপর কখনও কখনও আক্রমণ চালিয়েছে এবং তা বিহারি বা বাঙালি বিবেচনায় নয়। এবং যুদ্ধের নয় মাস নিরস্ত্র বাঙালিরা এই সব আধা-সামরিক বাহিনী এবং বিহারিদের ভয়ে তটস্থ ছিল। যুদ্ধ হলো কখন?

বিজয়ী হওয়ার পর কয়েকদিন বিহারি এবং সেই সব আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যা সব যুদ্ধেই হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ইয়াসমিন লিখেছেন, ‘এরপর বিহারিরা নাগরিক থেকে রাষ্ট্রহীন শরণার্থীতে পরিণত হয়।’ এটিও সঠিক পর্যবেক্ষণ নয়।

যুদ্ধের পর, বিহারিরা স্বইচ্ছায় দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ত্যাগের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের আলোচনায় স্থির হয়, যেহেতু বিহারিরা ইচ্ছুক নয় বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে, তারা পাকিস্তানের নাগরিক হতে ইচ্ছুক, সেহেতু পাকিস্তান যেন তাদের ফিরিয়ে নেয়। পাকিস্তান একদল বিহারিকে ফেরতও নেয়; কিন্তু তারপর তারা আর বিহারিদের ফিরিয়ে নেয়নি। তখন বাংলাদেশে থেকেই তারা আন্দোলন করে ফিরিয়ে নেয়ার।  স্বইচ্ছায় তারা থেকে যায়, সরকার ও রেডক্রস তাদের সহায়তা করে। এক সময় যখন তারা নিশ্চিত হয় যে তাদের পাকিস্তান ফিরিয়ে নেবে না তখন আন্দোলন থেমে যায় এবং তারা জীবনযাপনের জন্য চাকরি খুঁজে নেয়। তবে, এটা ঠিক, তারা বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল তা ভোলা সম্ভব ছিল না এবং বাঙালিরাও আর তাদের প্রতি মনোযোগ দেয়নি। সুতরাং মূল স্রোতধারায় তারা যুক্ত হয়নি যদিও যুদ্ধ পরবর্তী জেনারেশন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই বসবাস করছে। সুতরাং, ব্যাখ্যা যদি শুরুতেই ভুল হয় তাহলে পরিপ্রেক্ষিতও বদলে যায়।

আন্তর্জাতিক যুদ্ধ যে বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণ সে পর্যবেক্ষণও সঠিক নয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয়দের যৌথ কমান্ডের কাছে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা আত্মসমর্পণ করে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে যুদ্ধ হয় তা আলাদা যুদ্ধ কারণ, পাকিস্তান বাহিনী কেন্দ্র থেকে আর ঢাকায় আসতে পারেনি। দু’টি আলাদা যুদ্ধ। এবং দু’টি যুদ্ধের একটিতে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্থন করে। অন্যাটিতে যুদ্ধবন্ধের চুক্তির ফলে যুদ্ধ বন্ধ হয়।

ইয়াসমিন উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ভিন্ন ভিন্নভাবে চিত্রায়িত হয়েছে এবং তা স্বাভাবিক। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিতার সমাপ্তি হয় এই যুদ্ধের মাধ্যমে। ঠিকই আছে, কিন্তু ‘coloniaslism’ শব্দটি তিনি উর্দ্ধকমায় রেখেছেন। এটি নিয়ে সন্দেহ আছে তার। পাকিস্তান ঠিকই বাংলাদেশকে কলোনি হিসেবে বিবেচনা করেছে। ভারতে দেখা হয় এটিকে ১৯৪৭ সালের প্রতিশোধ হিসেবে অর্থাৎ দেশ বিভাগের জন্য পাকিস্তান আন্দোলনকারীরাই দায়ী। এটিও ইতহাসের বাস্তব ব্যাখ্যা নয়। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ মিলেই ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত করেছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তার মন্তব্য সঠিক, পাকিস্তান এই যুদ্ধকে স্মরণ করতে চায় না কারণ এই যুদ্ধে তারা লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে সব আচরণ করেছিল তা ঠিকই বর্ণিত হয়েছে। একটি ছাড়া।

তিনি বলেছেন, ভারত প্রণোদনা যুগিয়েছে বাঙালিদের- “Interfere and support of India in motivating the Benglis to secede from Pakistan” (পৃষ্ঠা-৪)

দুই

১৯৭১ ইয়াসমিনের বিষয় বটে কিন্তু কেন্দ্র হচ্ছে নারী কথন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নারীরা নির্যাতিত হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছেন, নিশ্চুপ থেকেছেন। এই নীরবতা তাকে পীড়িত করেছে এবং এই নীরবতা ভেঙ্গে নারী সত্ত্বা উন্মোচন করে ইতিহাসের দায় মেটাতে চান। লিখেছেন তিনি এ পরিপ্রেক্ষিতে-

“I highlight the internal capacity for developing an ethical memory that I hope will initiate multiple tellings of 1971, and through repetition the new probing we can grasp and understand the forgotten,as well cultivate a site for the divided people of South Asia, in India, Pakistan and Bangladesh, to contemplate a different self and other relationship.”

এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন কমিশন’ এর কথা আলোচনা করেছেন। এবং যুক্তিযুক্তভাবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ইতিহাস নির্মাণে তা যথেষ্ঠ নয়। যারা বেঁচে গেছেন তাদের সমষ্টিগত স্মৃতি যুক্ত হয় বর্তমান ইতিহাসের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের ভায়োলেন্সকে বিচারের এটি আরেকটি মাধ্যম এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন হলো সরকারি জাতীয় ইতিহাস সম্পর্কে। তার মতে, এভাবেই ঘাতক ও ভিকিটমকে মানবীয় করা যায় এবং সাধারণের ইতিহাস সৃষ্টি করা যায়- “The result is the creation of a new narrative that humanises victims and perpetrators, the people of South Asia, and reclaims a people history.” নারীর স্মৃতি মানবিকতা উদ্ধার করে।

ইয়াসমিন একটি কথা ঠিকই বলেছেন, বাংলাদেশে নারীদের এই ব্যক্তিগত বিবরণ- “constituted a public act of nationalism for men as well as ‘shame’ for the nation that is hidden.”  (পৃষ্ঠা-১১)

তাঁর মূল বক্তব্য, নারী নির্যাতনের সমষ্টিগত স্মৃতি, শুধু নারী নয়, পুরুষদের মধ্যেও মানবিকতার সৃষ্টি করতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের অনেক লেখকের বক্তব্যের আলোকে ‘মানবিকতা’ প্রত্যয়টি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনটি দেশের ‘অফিসিয়াল হিস্ট্রি’ বা সরকারি ইতিহাস আলোচনা করেছেন। এ সব বিষয়কে একত্র করে তিনি তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছেন। আসলে ১৯৭১-এর আলোকে এই তত্ত্ব খানিকটা নির্বস্তুক ও অস্পষ্ট। ভিকটিম ও ঘাতককে এক পাল্লায় মাপাটা দুঃসহনীয়। বৈপরীত্য বোঝা যেতে পারে এভাবে যে, এদেশে ঘাতকদের বিচারের পর প্রাণদণ্ড দিলে পাশ্চাত্য তার প্রতিবাদ করে কেননা তা ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’। কিন্তু হলোকাস্টের সঙ্গে  জড়িতদের বিচারের প্রাণদণ্ড হলে সে বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৭১ এর ঘাতকদের প্রাণদণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে ঘাতকদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। ভিকটিমদের মানবাধিকার-এর প্রশ্ন কখনও ওঠে না। মানবিকতা আসলে সেভাবে নির্ণিত হয় না।

ইয়াসমিন লিখেছেন তার এই গ্রন্থে তিনটি বিষয় বিবৃত হয়েছে

১. বীরাঙ্গনা হিসেবে শুধু নয়, বাংলাদেশ সৃষ্টিতেও নারীদের সজীব ভূমিকা রয়েছে।

২. নীরবদের মৌখিক কথনের শক্তি সৃষ্টি করেছে নতুন কাহিনীর যা “located im peoples experiences of their humanization in violence” (পৃষ্ঠা-১৫)

৩. সরকারি ইতিহাস ভরাট করবে জনগণের স্মৃতির টেক্সট।

ইয়াসমিন তিনটি দেশের ইতিহাস চর্চার বিষয়ও বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার বিষয়ে তার ধারণা সঠিক নয়।

তিনি লিখেছেন,  বাংলাদেশের ইতিহাস প্রাক ১৯৭১ সালে পাকিস্তান প্রসঙ্গে মোটামুটি নিশ্চুপ, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ‘exploitation’ এর কথা ছাড়া। এর ফলে ‘skewed history’ এর সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশিরা একটি বিষয় জানে ‘কলোনাইজেশন’। কিন্তু কে ঔপনিবেশিক প্রভু ব্রিটিশ না পশ্চিম পাকিস্তানের তা গুলিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ ‘liberated’ হওয়ার পর  ‘true history’ এর শুরু।

এটি ঠাট্টার মতো। বাঙালি তা হলে দীর্ঘ ২৫ বছর সংগ্রাম করল কার বিরুদ্ধে? পশ্চিম পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে বলেই তো মুক্তিযুদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। এখানে ইতিহাসে পড়ানো হয় প্রাচীন আমল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পড়ানো হয় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে। অতি তাত্ত্বিকতা অনেক সময় ভুল ধারণার সৃষ্টি করে। তথ্য দিয়ে তত্ত্ব সৃষ্টি এক বিষয়, তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তথ্যের সৃষ্টি অন্য বিষয়।

১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট জিন্নাহ পাকিস্তান কনস্টিটিউন্ট এসেম্বলিতে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন অনেকে তা তুলে ধরেন জিন্নাহর ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্য। তার জীবনচর্চাকেও এর উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, আমাদের রাজ্জাক স্যার প্রায়ই জিন্নাহকে ধর্ম নিরপেক্ষ হিসেবে তুলে ধরতেন। আয়েশা জালাল তো এর ওপর বিরাট বই লিখে আদৃত হয়েছেন। আমার বন্ধু শাহরিয়ার কবিরও জিন্নাহর এই উদ্ধৃতি উদ্ধৃত করেন।

ইয়াসমিনও তাই করেছেন। এবং মন্তব্য করেছেন- “The collective consciousness of the Muslims that led to the creation of Pakistan, it seems from Jinnah’s speech, ceased to be the states focus in independent Pakistan, and the state decided against publlicy flaurenting a Muslim identity. During this initial period, the Muslim did not deem the other-Hindu-as its enemy; at least this was not publicy annaunced.” (পৃষ্ঠা-৩৫)

প্রথম কথা জিন্নাহকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক কীভাবে বলি? তিনি স্যুট পরতেন, হ্যাম স্যান্ডউইচ খেতেন তাই বলে কি? আমরা ভুলে যাই কেন তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনই তো ছিল ধর্মভিত্তিক। তা একজন ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন কী ভাবে? ১৯৪৭ সালের পর জিন্নাহ পাজামা শেরওয়ানি আর টুপি পরা শুরু করেন। তার টুপির নাম হয়ে যায় ‘জিন্না ক্যাপ’। কংগ্রেসও তাই করেছে। কিন্তু এ কথা কেউ বলেন না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। একই সঙ্গে রায়ট থামাবার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে বেলেঘাটা গেছেন এবং ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান আন্দোলন ত্যাগ করেছেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় তিনিই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন।

জিন্নাহ জাতিদ্বেষী ছিলেন। বাঙালিদের কখনও মানুষ মনে করেননি। কিন্তু, বাঙালিরা পাকিস্তানের মোহে তাকে ‘কায়েদে আজম’ বানিয়েছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস যেখানে সেই পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহর রাজধানী হতো। জিন্নাহর জন্মস্থান বলে করাচি হয়। বাংলার রাজনীতিবিদ এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দীকে কখনও তিনি গুরুত্ব দিতে চাননি। ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবও মানেন নি। ১৯৪৭ সালেই পাঞ্জাবে ধর্ম-দাঙ্গা হয়। জিন্নাহ বা নেহেরু কিছুই করেননি। করার কিছুই ছিল না। কারণ তারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছিলেন। হিন্দুদের হত্যা ও দেশ ত্যাগ ঠেকাতে জিন্নাহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এমন কোনো উদাহরণ নেই।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে উপেক্ষা করেন। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপ্রধান অনেক কিছু ঘোষণা করতে পারেন; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কী করছেন তা বিবেচ্য। ইয়াসমিন যে লিখেছেন, মুসলিমরা হিন্দুকে শত্রু মনে করেননি, অন্তত পাবলিকলি তাও ভুল। হিন্দুরা ব্যাপকভাবে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেছেন? মুসলমান বাঙালিও এসেছেন পূর্ববঙ্গে। কিন্তু হিন্দুদের দেশ ত্যাগের ওপর আমরা যতটা গুরুত্ব দিই মুসলমানদের দেশ ত্যাগের ওপর ততটা নয়। কেন তারা নিজ নিজ দেশ ত্যাগ করেছেন? ভয়ে, এটি বাস্তব।

ইয়াসমিন যে বক্তব্য তুলে ধরতে চেয়েছেন এ পটভূমিকায় তা হলো-

“It was not religion but ethnicity that became the site of conflict between. East and West Pakistan even at the early stages of building the new nation.” (ঐ)

এ বক্তব্য আংশিক সত্য, জাতিদ্বেষ যেমন ছিল তেমনি ধর্মও বিষয় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষজন কখনই বাঙালি মুসলমানকে সম্পূর্ণ মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করেননি। আমি ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক ছিলেন [এমন কী বেনজীর ভূট্টোসহ] তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি বই লিখেছি সেই সব পাকিস্তানি। ১৯৭১ সালে যারা বাঙালি হত্যায় যুক্ত ছিলেন সে সব জেনারেলদের আত্মস্মৃতি নিয়ে লিখেছি পাকিস্তানি জেনারেলদের মন। দুপক্ষই স্বীকার করেছেন জাতিদ্বেষ ছাড়াও তারা বাঙালিদের মুসলমান মনে করতেন না। আধা হিন্দু ভাবতেন যারা ভারতীয় হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত। এবং সাধারণ সৈনিকদের বলা হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ তারা কাফের নিধন করতে যাচ্ছ।

ইয়াসমিন লিখেছেন- “Language riots marked the 1950 with violence.”

এ মন্তব্যও সঠিক নয়। কেননা ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল না, সামগ্রিকভাবে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ যে কারণে, ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয় পূর্ববঙ্গে এবং তারপর থেকে সামরিক শাসন ব্যতীত মুসলিম লীগ আর কখনও পূর্ববঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এবং ভাষা আন্দোলন ‘রায়ট’ [Riot]  ছিল না। ছিল ‘প্রটেস্ট’ [Protest] বা প্রতিবাদী আন্দোলন। রায়ট বা দাঙ্গা বললে তাকে খাটো করা হয়। ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের গুলি করেছিল বাঙালি পুলিশ, বাঙালি অধিকর্তার হুকুমে যিনি নির্দেশ পেয়েছিলেন বাঙালি শাসকের কাছ থেকে।12_Shadhinata+Stambha

ইয়াসমিন কিন্তু পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে যা আমি উল্লেখ করেছি তাই বলেছেন বিস্তারিতভাবে। সে ন্যারেটিভ সঠিক কিন্তু দুটি রেফারেন্স বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ দুটি রেফারেন্স তিনি দিচ্ছেন ভারতীয় আর্কাইভস থেকে। একটিতে বলছেন, পাকিস্তান সেনাদের যখন আনা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে তখন সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী, গুপ্তচর ও ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের অনুপ্রবেশ ঘটছিল।

[Intrusive incursions of the Indian security forces, Indian spies, and troublemakers into East Pakistan, which obviously worsened the situation for People in East Pakistan.]

গুপ্তচর থাকবেই কিন্তু তার সংখ্যা কত? নিরাপত্তা বাহিনী হয়ত সতর্কতার জন্য সীমান্ত এলাকায় থাকতে পারে; কিন্তু সারা বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটছিল এটি অবিশ্বাস্য। তাই যদি হতো তাহলে প্রাথমিক প্রতিরোধে তো তারা অংশ নিত। বাংলাদেশে গত ৪৫ বছরে কোনো ন্যারেটিভে, এমন কী ভারতীয় ন্যারেটিভেও এ তথ্য পাওয়া যায়নি। ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীর অর্থ কী? ধরা যাক তার ভাষ্য অনুযায়ী এই তিনধরনের লোকের ‘অনুপ্রবেশ’ না ঘটত তাহলে কি অবস্থার উন্নতি হতো?

দ্বিতীয় ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে ভারতীয় এজেন্টরা বাঙালিদের বিশেষ করে হিন্দুদের বলছিল বাংলাদেশ ত্যাগ করতে। তিনি তথ্যসূত্রে জানাচ্ছেন, এ ধরনের ছবির অ্যালবাম তিনি নতুন দিল্লির সামরিক আর্কাইভসে দেখছেন। জেনারেল জ্যাকব, এবং স্বপন চক্রবর্তী ও আর বদ্রিনাথ যারা শরণার্থী পুনর্বাসনে ছিলেন তারাও বলেছেন। মেগাফোনে তারা সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের শান্তিপূর্ণ এলাকায়, ভারতীয় ক্যাম্পে আসতে বলা হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘোষণা করত, পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য। আমার মনে হয় এখানে খানিকটা বিভ্রান্তি আছে। গণহত্যা শুরু হলে কেউ কোন ঘোষণার ধার ধারেনি, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভারতীয় সীমান্তের দিকে এগিয়েছে। জানুয়ারি ১৯৭১ থেকে এ ধরনের ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি অবাস্তব। তাহলে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে খবরটি আসত। সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘোষণা হতে পারে; কিন্তু কবে থেকে? সীমান্ত এলাকা আর সারা বাংলাদেশ এক নয়।

হ্যাঁ, ভারতীয় বাহিনীর মুখপাত্র যেমন আত্মসমর্থনের কথা বলেছে, পাকিস্তান বাহিনীও তা বলেছে। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু, যা লিখেছেন ইয়াসমিন তা হুবহু পাকিস্তানি ধারণা বা ন্যারেটিভের অংশ। বিশেষ করে জানুয়ারিতে দেশ ত্যাগ করতে বলা অবাস্তব কারণ, তখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান ফ্রেমে কথা বলছেন, পাকিস্তানও এবং আমরা যারা তরুণ ছিলাম তারা স্বাধীনতার কথা বললেও জানুয়ারিতেই ভারত যেতে হবে বা এ পর্যায়ে গণহত্যা হবে সেটি কেউ ভাবেনি। যে ভিস্যুয়াল এভিডেন্সের কথা বলছেন, তা কোন স্থানের, তারিখ এবং কী পরিমাণ সেটি উল্লেখ না করলে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তিনি আবারও ‘পূর্বপাকিস্তান’ ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলেছেন যা ইতিহাসের দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে যা বলছেন তাও শব্দ ব্যবহারে অগ্রহণযোগ্য। তিনি লিখছেন, পাকিস্তান বাহিনী আলবদর ও আল শামস এবং বিহারি মিলিশিয়া নিয়ে-

“Committed widesprend violence against the nationalist Bengalis.”

‘ন্যাশানালিস্ট বেঙ্গলিজ শব্দটি আপত্তিকর। তারা ভায়োলেন্স সংগঠিত করেছে বাঙালিদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগকে যদি ‘ন্যাশনালিস্ট’ বেঙ্গলিজদের দল বলা হয়, তাহলে বলতে হবে, তারা ছাড়াও আরো বাঙালি ছিলেন। যারা আওয়ামী লীগ সমর্থক নয় কিন্তু গণহত্যার শিকার হয়েছেন। এর বিপরীতে-

“The nationalist Bengalis with the assistance of the Indian Army, created local militia called Mukti Bahini and wreaked havoc in communities deemed enemies of the nationalist Bengalis.” (পৃষ্ঠা-৪০)

মুক্তিবাহিনী গঠনে ভারত সহায়তা করেছে কিন্তু তা ‘লোকাল মিলিশিয়া’ ছিল না। যারা ট্রেনিং নেয়ার পর বিভিন্ন সেক্টরে নিয়মিত যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন। গেরিলারা, তারাও বিভিন্ন সেক্টরের অন্তর্গত। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ২১টি প্রতিরোধ যোদ্ধার দল গড়ে উঠেছিল যাদের সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টরের কোন যোগাযোগ ছিল না। কখনও কখনও তারা ভারত থেকে অস্ত্র পেয়েছে সব সময় নয়। সুতরাং, কোন অর্থেই তারা লোকাল মিলিশিয়া ছিল না যে অর্থে আল শামস্ বা আলবদররা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়েছে, রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

কিন্তু  ‘wreaked have in communities’ -এর কথাটা সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে ইয়াসমিন ব্যবহার করেছেন পাকিস্তানি উর্দু সংবাদপত্র। কিভাবে তিনি আশা করেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান উর্দু সংবাদপত্র সঠিক সংবাদ দেবে?

বিহারিদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এ বলে যে- “Biharis were targeted as the supposed enemy of Bengalis.”

কারা টার্গেট করেছিল সে উল্লেখ নেই বটে। তবে, ধরে নিতে পারি তিনি বলছেন বাঙালিদের টার্গেট ছিল বিহারিরা। এবং ‘সাপোজড এনিমি’ নয় ‘এনিমিই’ ছিল। ইয়াসমিন বাঙালি বিহারিদের সঙ্গে যে বৈরিতার  কথা বলছেন তা সত্য। তবে লেখা এক জিনিস, বাস্তব অন্য। আমরা বিহারিদের সঙ্গে বড় হয়েছি। বাঙালিদের ডিঙিয়ে স্বল্প শিক্ষিত বিহারিদের বন্দর ও রেলে নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলা বলতে কখনও তাদের শুনিনি এবং তাদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে হতো। এবং ক্ষমতার দাপটও ছিল দেখার মতো। ১৯৭১ সালে, অনেক বিহারি যেমন বাঙালিকে বাঁচিয়েছেন, তেমনি ১৯৭১-এর পর অনেক বাঙালি বিহারিকেও বাঁচিয়েছেন।  ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই বিহারি-বাঙালি দ্বন্ধের সূত্রপাত এবং সৈয়দপুর বা এ ধরনের বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় সংঘর্ষ হতে থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চের পর বিহারিরা প্রকাশ্যে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নামে। শান্তি কমিটির নামে তারা প্রচুর বাঙালি পরিবারকে উৎখাত করে। আমার লেখা- মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র-এ এর অনেক উদাহরণ আছে। পাকিস্তানে বিহারি ‘নির্যাতন’ সংক্রান্ত যেসব দলিলপত্র, সেগুলি আমি দেখেছি। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদ/দলিল প্রাক ২৫ মার্চ সংঘর্ষের, যেখানে বিহারি-বাঙালি দু পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এক পক্ষ নয়।

১৯৭১ সালের পর বিহারিরা ‘Stateless’ রিফিউজি হয়ে গেলেন। বর্তমানে ২,৫০,০০০ বিহারিরা বাংলাদেশে রিফিউজি ক্যাম্পে আছে জানিয়েছেন ইয়াসমিন- ‘Without basic human right’। দূর থেকে দেখে বা শুনে এ ধরনের মন্তব্য করা যায়। কিন্তু ১৯৭২-৮২ সাল পর্যন্ত কাগজপত্র দেখতে বলি।

02_National+Memorial_0002বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল, যেসব বিহারি পাকিস্তান যেতে চান তাদের পাকিন্তানে ফিরিয়ে নেয়া হবে। একবার দুবার কিছু বিহারিকে ফেরত নেয়া হয়। মূল বিষয় সেটি নয়। বিহারিরা ঐ সময় নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে স্বীকার করেনি, দাবিও করেনি। বরং তারা বলেছে, পাকিস্তানে তাদের ফেরত নিতে হবে কারণ তারা পাকিস্তানের নাগরিক।  সে কারণে তারা রিফিউজি ক্যাম্পে রয়েছে। নতুন জেনারেশন উপলব্ধি করেছে, পাকিস্তান তাদের নেবে না, ভারতও নয়। বাংলাদেশেই থাকতে হবে। সুতরাং, তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব মেনে নিয়েছে। তবে, এটা ঠিক ১৯৭১ সালের স্মৃতি এত তিক্ত যে, বিহারিরা আর মেইনস্ট্রিমে আসতে পারেনি।  ‘বেসিক হিউম্যান রাইটস’ এর সংজ্ঞা পাশ্চাত্যে এক রকম, আমাদের মতো দেশের এক রকম। তাদের বেসিক হিউম্যান রাইটার্সের প্রত্যয় একমাত্র নিরিখ হতে পারে না। তবে, এটা ঠিক বিহারিদের কারণেই বাঙালিরা তাদের বিষয়ে নিস্পৃহ। কিন্তু তাদের জীবন ধারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে কেউ বাধা দিচ্ছে তা নয়।

ইয়াসমিনের গ্রন্থে সমস্যাটা হচ্ছে, যেমন একটি বিষয় শুরুর আগে তিনি যে শব্দ চয়ন  বা বাক্য বিন্যস্ত করেন তখন তার অর্থ দাঁড়ায় একরকম। পরে, যখন তা বর্ণনা করেন তা দাঁড়ায় অন্যরকম।   এরপর ‘যুদ্ধ শুরু’ ধ্বংসলীলা ও শেষের যে ন্যারোটিভ তৈরি করেছেন যে তথ্যগতভাবে সঠিক।

তিন.

‘ভায়োলেন্স অন দি মাইন্ড: ওয়ার অন ননকম্ব্যাটান্টস’ অনুচ্ছেদটি ধরা যেতে পারে ইয়াসমিনের বইয়ের মূল উদ্দেশ্য বা তিনি আসলে গবেষণা কী দেখাতে চেয়েছেন। এর শুরুটা গোলমেলে যেখানে তত্ত্ব আলোচনা করেছেন। কারণ তথ্যের সঙ্গে তত্ত্ব মেলে না। শেষের দিকে তত্ত্বের খোলস ফেলে যখন লিখেছেন, তখন বিবরণটি বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়।

তাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি তিনটি প্রসঙ্গ লিখেছেন। ১. ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ নিজেদের ইতিহাস জয়ের ইতিহাসে গুরুত্ব দিয়েছে, ফলে অনেক সত্য চাপা পড়ে গেছে। ২. বাংলাদেশে যে মানুষ হত্যা করা হয়েছে তা কি ‘গণহত্যা’? ৩. এই যুদ্ধে বেসামরিক লোক মারা গেছে, নারীরা ধর্ষিত হয়েছে তাদের বিষয়টি কেউ গুরুত্ব দেয়নি।

প্রথমটি সম্পর্কে তিনি কী বলেছেন দেখা যাক। যখন ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরু হলো, পাকিস্তান বাহিনী আলশামস, আলবদর, হানাদারদের অস্ত্র সরবরাহ করল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের নির্মূল করতে। অন্যদিকে, ভারতীয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করল পাকিস্তানি ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

এই বিভক্ত সশস্ত্র গ্রুপগুলি পরস্পরের বাড়ি বাড়ি ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আর গৃহযুদ্ধে শুরুর আগে বাঙালি-বিহারি পরস্পরের বিরুদ্ধে একই কাজ করল। এক্ষেত্রে ফুটনোটে ৩ মার্চ, ১৯৭১ সালের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ঐ দিন ময়মনসিংহে বাঙালি-বিহারি রায়ট বাধে। বিহারিদের বাড়িঘর আক্রমণ করা হয় এবং অনেককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। যেখানে একটি ‘ব্লাডবাথ’ হয়েছিল। এটি বোঝা যায় এর কয়েক দিন পর ঢাকা থেকে আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই ইসলামের প্রতিনিধিরা ময়মনসিংহ গিয়েছিলেন এবং সেখানে ৩০ জন অনাথকে পেয়েছিলেন যাদের বয়স ছয় মাস থেকে ১৪।

তারা রেডক্রসের আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। ইয়াসমিন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং মন্তব্য করেছেন-

‘‘They have been suppressd and never shown in public space because the under the conventional Bangladeshi position as the victim community.”

তিনি আবার তাহমিনা আনামের ২০০৮ সালে লন্ডনের গার্ডিয়ানের এ বিষয়ক প্রবন্ধের সূত্র উল্লেখ করেছেন। এ রকম অবস্থায় [volatile scene of ethnic warfare]

পাকিস্তান বাহিনীর হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলে। এসব কারণে বেসামরিক নাগরিক ও মহিলারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

Leaders and followers than reduced their enemies into abstract numbers and demographic units, categorizing us and them.” [L. 46]

আমার মনে হয় সমস্যাটা হচ্ছে তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। যেহেতু তিনি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত, মার্কিন অ্যাকাডেমিয়ার প্রভাব থেকে মুক্তি না পাওয়ায় স্বাভাবিক। আর তত্ত্ব একটি নির্মাণ করে তা প্রমাণে তথ্য ব্যবহার করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতেই পারে।

ইয়াসমিন ১৯৭১ কে দেখছেন গৃহযুদ্ধ হিসেবে। আমরা ২৬ মার্চ থেকে তা দেখছি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে। ১৭৭৬ সালের মার্কিন স্বাধীনতার যুদ্ধকে কি ইয়াসমিন গৃহযুদ্ধ বলবেন? তাহলে কনফেডারেট ও ইউনিয়নের যুদ্ধটাকে কী বলবেন? মার্কিন যুদ্ধের সময় যা ঘটেছে বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। কিন্তু [দুটি তুলনীয় নয়]  সেটিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা হবে কেন? ১৯৭১ কে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ বলব, গৃহযুদ্ধ নয়, তাহলে বিষয়টি সরল মনে হবে।

তিনি তার বিবরণে বাঙালি-বিহারি দ্বন্দ্বের ওপর জোর দিতে চেয়েছেন। হিন্দু মুসলমান রায়টতো কম হয়নি বাংলাদেশে। সেখানে দুপক্ষের মানুষই মারা গেছে, তাহলে এটি কীভাবে বিচার্য?  বাঙালি-বিহারি সংঘাতকে তিনি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে মূল বিষয় বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ গুরুত্বই পায়নি। বিহারি-বাঙালি সংঘর্ষ কেউ লুকিয়ে রাখতে চায়নি, চাইও না। চট্টগ্রাম, সৈয়দপুরের মতো কিছু কিছু এলাকা বিহারি অধ্যুষিত থাকায় সংঘাত হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তা মিটেও গেছে।

তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে সব। বিশেষ করে বিহারি এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরাও দৃষ্টি রেখেছিল। সেখানে ‘হাউস টু হাউস র‌্যামপেজের’ ঘটনা কীভাবে ঘটে তার ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। যেসব পত্রিকা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেছিল ধরে নিলাম, তারা এসব ঘটনা চেপে গিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানপন্থী সংগ্রাম, পয়গাম বা মর্নিং নিউজ, কী অবজারভার কেউ সংবাদগুলি ছাপল না এমন কী পশ্চিম পাকিস্তান বা বিদেশি কাগজগুলিতেও? ২২ খণ্ডে সমাপ্য গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ আমি সম্পাদনা করেছি, কোন কাগজে এসব ঘটনার উল্লেখ পেলাম না কেন? তখন প্রচুর পরিমাণ বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন বাংলাদেশে।

এতসব সংবাদ তাদের চোখ এড়িয়ে গেল কী ভাবে? ময়মনসিংহের ঘটনাটি এখন শুনলাম। এত বড় ঘটনা, ত্রিশ জন নিহত হওয়া যা তা ব্যাপার নয়। কিন্তু পরদিন পাকিস্তানি বা বিদেশি কোন সংবাদপত্র কোন খবর দিল না! দাঙ্গা সমর্থন যোগ্য নয়, বিহারি-বাঙালি দাঙ্গাও নয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের আগে সংঘাত হয়েছে কিন্তু তা এত সামান্য যে, তখনকার গণমাধ্যমে তা গুরুত্ব পায়নি। হুমকি ছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের পর বাঙালিরা আরো সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের সৈন্যদের গুলিতে প্রায় ৩০০ জন বেসামরিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর নয়। যুদ্ধ যখন চলছে তখন বেসামরিক মানুষজন ভিকটিম হবে, সেটিই স্বাভাবিক। যা এখনও চলছে। সেটিকে তাত্ত্বিক ফ্রেমে এনে লাভ কি?

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ গণহত্যা। এখানেও সেই বিভ্রান্তি। তার মতে,

“The multiple actors and perpetrators complicate the picture, and it is almost impossible to distinguish victims and perpetrators.” (পৃষ্ঠা-৫৭)

সুতরাং, এটিকে গণহত্যা বলা যায় না যেমন বলেছেন বিদেশি  অনেক গবেষক। তবে, নাজিরা ইহুদি নিধন করেছে সেটিকে গণহত্যা বলা যায়, দারফুর, বসনিয়া সব কিছুকে গণহত্যা বলা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের হত্যাকে গণহত্যা বলা যায় না। এক জায়গায় লিখেছেন ১০ লাখ নিহত হয়েছে। ৩০ লাখ কখনও স্বীকার করেননি। হুতু-টুটসিদের সংঘাত গৃহযুদ্ধ নয় কেন? আর গৃহযুদ্ধে হলে গণহত্যা হবে কী ভাবে? গণহত্যা না করার কারণ হল- “No single group had a monopoly on committing violence.”

অর্থ হলো, পাকিস্তানিরা মেরেছে। পাঞ্জাবিরাও মেরেছে। কিন্তু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের সঙ্গে লড়াই করেছে, দুপক্ষেই মারা গেছে, রাজাকার আলবদার পেলে হত্যা করা হয়েছে, কখনও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ৩০ লক্ষের বিপরীতে যদি মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সময় ১০ হাজার হানাদার, রাজাকার বা বিহারি হত্যা করতে পারত যে তাহলেও তত্ত্বে  পৌঁছানো যেত। কিন্তু তাতো হয়নি। তখন ইয়াসমিন মোটামুটি পৌঁছেছেন ৩০ লাখ [তার মনে হয় ১০ লাখ] মারা যায়নি তখন এ নিয়ে তর্ক করা বাতুলতা। তিনি মনে করেন,

“obviously the misguided ethnocentric and political interests to the participants- Pakistani, Bengali, Bihari and even Indian led to mass violence.” [P. 51]

ধর্ষণের নানা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এবং তার আলোকে যা বলেছেন তা নিয়ে তর্ক নেই। শুধু কয়েকটি পর্যক্ষণ।

১. বীরাঙ্গনা নামটি বঙ্গবন্ধুর দেয়া নয়। [পৃ. ৫৫] বঙ্গবন্ধু আসার আগে নারীনেত্রীরা এই নামটি দিয়েছিলেন।

২. গর্ভপাত করার জন্য ‘chilling mandate’ দিয়েছে মুজিব সরকার। [পৃ. ৫৯] গর্ভপাত মহিলারা নিজেরাই করিয়েছিলেন। যারা সন্তান রাখতে চেয়েছিলেন বা বাধ্য হয়েছেন তাদের গর্ভপাত করানো হয়নি। এবং গর্ভপাত ধর্ষিতারাই করাতে চেয়েছিলেন। ডাক্তারেরা এতে আইনগত বাধার উল্লেখ করেছিলেন। সে কারণে, সরকার গর্ভপাত করাতে আইনগত বাধা নেই বলে ঘোষণা করেন। এটি ‘চিলিং ম্যান্ডেট’ নয়।  সন্তান হওয়ার পর সামাজিক কারণে অধিকাংশ মাতা সন্তান রাখতে চাননি। তাই তাদের দত্তক প্রেরণ করা হয় আইনগত ভিত্তি দিয়ে। জাতি, জারজ পাকিস্তানিদের রাখতে চায়নি, এ ধরনের মনোভাব কারো কারো থাকতে পারে কিন্তু পুরো জাতি এটি ভেবেছিল আমার অন্তত সেটি মনে পড়ে না। ইয়াসমিন তথ্যপঞ্জিতে জানিয়েছেন, মহিলা পুনর্বাসনে দায়িত্বে নিয়োজিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহাঙ্গীর হায়দার ‘পাকিস্তানি জারজ’ শব্দটি ব্যবহার করেন, পুনর্বাসন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন রেহমান সোবহান। ঐ সময় জাহাঙ্গীর হায়দার নামে কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন না। রেহমান সোবহানও পুনর্বাসন কমিশনের প্রধান ছিলেন না।

ইয়াসমিন সাইকিয়ার গ্রন্থটির শিরোনাম- উইম্যান ওয়ার অ্যান্ড মেকিং অব বাংলাদেশ: রিমেমবারিং ১৯৭১। বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে তিনি যুদ্ধের পটভূমি, বাংলাদেশ চর্চা বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের কথা আলোচনা করেছেন। তিনি আসলে নারীদের অবস্থান কী ছিল মেটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন। সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে  তিনি মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং এই আলোকেই তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন। গৃহযুদ্ধ বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে, ইন্ধনের যোগানদাতা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক ও ভারত। এবং বিহারিদের তিনি এই ন্যারেটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেন। সারা দেশে বিহারিদের সংখ্যা যত ছিল সেটি বিবেচনায় নিলে, গৃহযুদ্ধেও তারা প্রতিপক্ষ হয় না।

নারী ও যুদ্ধ নিয়ে তিনি যা লিখেছেন তাতে বিভ্রান্তি কম। সেখানেও বিহারি নারীদের প্রসঙ্গ এসেছে। স্বাধীনতার পর তাদের অসহায়ত্বের কথা এসেছে। এবং  সেগুলো যে ইতিহাসে সমালোচিত থেকে গেছে সে নিয়েও বিতর্ক নেই। ইয়াসমিন এ কাজটি করেছিলেন এ শতকের প্রথম দিকে। আজ প্রায় দু’দশক পর বলা যেতে পারে, নারী ও যুদ্ধ নিয়ে এখন অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে, আলোচনাও হচ্ছে। ইয়াসমিন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

আমি শুধু ইয়াসমিনের প্রথম পর্বের পদ্ধতিগত বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে আলোচনা করতে গিয়ে বাস্তব। ইতিহাস থেকে তারা দূরে সরে গেছেন। ফলে, তাদের বই ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়াই বাঞ্চনীয়।

Advertisement