রংপুর সিটি নির্বাচনে প্রাপ্তি – অপ্রাপ্তি

। । বিভুরঞ্জন সরকার। ।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকাডুবি হয়েছে। আওয়ামী লীগ পরাজয়ের জন্য প্রস্তুত থাকলেও এমন শোচনীয় পরাজয় হবে – সেটা হয়তো তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।

২০১২ সালে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে যিনি ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছিলেন, তাকেই এবার আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিল হয়তো এই আশায় যে, পাঁচ বছর মেয়রগিরি করে, উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে এবার আওয়ামী লীগকে আবার বিজয় উপহার দেবেন। কিন্তু হায়! এ কি হাল হলো সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর? এভাবে তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা ডোবালেন? পাঁচ বছর তবে তিনি কি করলেন? জাতীয় পার্টির ভোট বাড়ালেন?

গত নির্বাচনে সরফুদ্দিন ঝন্টুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবারের বিজয়ী মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। ভোট পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫। এবার তিনি ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। গতবার তিনি ছিলেন জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী। এবার মূল প্রার্থী তিনি। মোস্তফা যে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি তা এবার প্রমাণ হয়েছে। রংপুর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামানের অবস্থান তৃতীয়। ভোট পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৫। আগের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৩৫ ভোট। তিন নম্বরে স্থান পেলেও বিএনপি এটা ভেবে স্বস্তি পেতে পারে যে, আওয়ামী লীগের যেখানে ভোট কমেছে, বিএনপির সেখানে ভোট বেড়েছে। এই দুর্মূল্যের বাজারে এটাইবা কম কি!

রংপুরে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটাররা ভয়ভীতি ও প্রভাবমুক্ত পরিবেশে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছেন। বিএনপি নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠালেও রংপুরের মানুষের কাছে সেসব হাস্যকর বলেই মনে হচ্ছে। রংপুরের একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ মলয় কিশোর ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচনকে সুন্দর ভোটের একটি মডেল হিসেবে মনে করছি। প্রার্থীরা ক্ষমতা ও পেশিশক্তির প্রয়োগ করেননি। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের আয়োজন ছিল চমৎকার। সব মিলিয়ে একটা ভালো নির্বাচন হয়েছে।’

একটি ভালো নির্বাচন করতে পারার কৃতিত্ব নির্বাচন কমিশন অবশ্যই দাবি করতে পারে। তবে এটা শুধু নির্বাচন কমিশনের সাফল্য নয়, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনেরই এতে ভূমিকা আছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দল ইতিবাচক ভূমিকা পালন করাতেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে।

এ থেকে প্রমাণ হলো যে, চাইলে বিদ্যমান অবস্থাতেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়। নির্বাচনে জয়-পরাজয় স্বাভাবিক ব্যাপার। এক পদে একজন প্রার্থীই জিতবেন। সেক্ষেত্রে সবাই যখন জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, ঝামেলা বাধে তখনই। রংপুরে সব পক্ষ সংযত থাকায় এবং নির্বাচনী প্রচারণাতেও খুব একটা কাদা-ছোড়াছুড়ি না করায় নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছে।

প্রশ্ন আসছে, রংপুরের মতো নির্বাচন কি সব জায়গায় হবে? উত্তরে বলা যায়, কেন নয়? রংপুরে পারলে অন্য জায়গায় পারা যাবে না কেন? রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যারা করেন ব্যক্তিগত ভাবে তারা যদি সংযম দেখাতে সক্ষম হন, তাহলে তো নির্বাচনে গোলযোগ হওয়ার কোনো কথা নয়। দুঃখের ব্যাপার হলো, ভালো দৃষ্টান্ত আমরা তৈরি করি কম। অনুসরণ একেবারেই করতে চাই না। খারাপ উদাহরণগুলো সামনে এনে খারাপ হওয়ার প্রতিযোগিতা না করে আমরা কি রংপুরের অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যতের জন্য অনুসরণীয় করে তুলতে পারি না?

সেটা যে পারবো না তা বোঝা যাচ্ছে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য থেকেই। বিএনপি নেতারা বলছেন, রংপুরে যা-ই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। তারা তাদের সহায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসতে রাজি নন। বিএনপির এই রাজনীতিকে জেদের রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

রাজনৈতিক কৌশলে নমনীয়তা না দেখাতে পারলে রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া যায় না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে যারা ‘আপোষহীন’ নেত্রী বানিয়েছেন, তারা আসলে তার উপকার না করে অপকার করেছেন। আপোষহীন হতে হয় নীতি বা আদর্শের প্রশ্নে। কৌশলের ক্ষেত্রে হতে হয় নমনীয়। বেগম জিয়ার অবস্থান উল্টো। তিনি নীতির প্রশ্নে আপোষ করে কৌশলে থাকছেন আপোষহীন।

বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মানুষ তাদেরই ভোট দেবে। রংপুরে তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হয়েছে, তাতে বিএনপির অবস্থান তৃতীয়। বিএনপি বলবে, আওয়ামী লীগ তো হেরেছে। মানুষ যে আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে সেটা তো দেখা গেল। হ্যা, আওয়ামী লীগ হারলেও তার বৈরী দল না জিতে মিত্র দল জিতেছে। এই বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
রংপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল থেকে বিএনপিকে এটাও বুঝতে হবে যে, জামায়তে ইসলামী আর তাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র নেই। জামায়াত সঙ্গে থাকলে ভোটের বাজারে সুবিধা হবে বলে এতদিন বিএনপি মনে করে এসেছে। কিন্তু রংপুর সিটি নির্বাচনে জামায়াতকে পাশে পায়নি বিএনপি। ধারণা করা হয় যে রংপুর সিটিতে জামায়াতের ৩০ হাজারের মতো ভোট আছে। জামায়াত নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি। তাই তাদের ভোট মিত্র শক্তি হিসেবে বিএনপিই পাওয়ার কথা। বিএনপি প্রার্থী ৩৫ হাজার ভোট পাওয়া থেকেই বোঝা যায় জামায়াতি ভোট তারা পায়নি।

রংপুর সিটি নির্বাচনে জামায়াতের ভোট কোথায় গেল সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠেছে। জামায়াত যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি এটা নিশ্চিত। হয় তারা ভোট দানে বিরত ছিল অথবা জাতীয় পার্টিকে ভোট দিয়েছে। জামায়াত অত্যন্ত কৌশলী দল। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে তারা সেয়ানা। তারা ভোট দানে বিরত থাকবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকানোর জন্য তারা জাতীয় পার্টির লাঙলেই হয়তো ভোট দিয়েছে। আর, প্রায় লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জাপা প্রার্থীর জয়লাভের কারণ সম্ভবত সেটাই। বিএনপির এখন জামায়াত নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে মাখামাখির সম্পর্ক রাখবে বলে মনে হয় না। ভোটের রাজনীতিতে লাভের আশায় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি কৌশলগত ঐক্য করেছে বলে দাবি করে থাকে। সে লাভ যখন হচ্ছে না, তখন এই কৌশলগত ঐক্য রেখে বদনামের ভাগীদার হওয়া কেন?

রংপুরে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী ২৪ হাজার ভোট পেয়েছেন। বিষয়টি মোটেও গুরুত্বহীন নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যে জমিন পাচ্ছে, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই ভোটগুলো সরকারবিরোধী। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? রংপুরে আওয়ামী লীগের ভোট এবং আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট সমান সমান। রংপুরে নাকি প্রায় ৬০ হাজার সংখ্যালঘু ভোট। এই ভোটেরই বা খবর কি? তারা কি তাহলে দল বেঁধে নৌকায় ভোট দেননি? নাকি তাদের কেউ কেউ ভোট দিতেই যাননি? রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে বিষয়গুলো ভাবতে হবে।

রংপুরে আওয়ামী লীগের তথা নৌকার ভোট কমেছে। এটা খারাপ লক্ষণ। আওয়ামী লীগ মনে করছে, ক্ষমতায় থেকে তারা দেশের এতটাই উন্নতি করেছে যে কোনো দলই আর তাদের সাথে পেড়ে উঠবে না। কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় আশার বাণী শুনিয়েছিলেন যে জরিপ থেকে জানা গেছে, সারাদেশে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তাহলে রংপুরে কি হলো? একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরেছে বলে আওয়ামী লীগের আর কোনো আশা নেই, তা অবশ্যই নয়। তবে রংপুরের ভুলভ্রান্তিগুলো মূল্যায়ন-পর্যালোচনা করে সামনে এগুলে হয়তো সুফল পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হলো, সেটা করা হবে কি না? ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রথা আমাদের রাজনীতিতে নেই। রাজনীতিতে বরং আমরা দেখি ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে। আমরা আশা করবো, কল্পনার ফানুশ না উড়িয়ে সবাই বাস্তবের কঠিন জমিনে পা রাখবেন।

রংপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মারাত্মক বিতর্ক শুরু না হওয়া একটি অতি উত্তম ঘটনা। দুএকটু বাদ-প্রতিবাদ, মান-অভিমান সত্ত্বেও ফলাফল মনে নেওয়ার কথা বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীর। এটা অবশ্যই শুভ লক্ষণ। এই ধারা যদি বজায় থাকে, অব্যাহত থাকে তাহলে রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে যাবে। তবে এখনই বড় আশাবাদ নয়, দেখা যাক হাওয়া কোন দিকে যায়।

Advertisement