রাজনীতি যখন জেনারেলদের আশ্রয়

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল পতিত সামরিক কর্তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্র। সম্ভবত সেই পথে রয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত জেনারেল মিন অং হ্লাং। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলো জেনারেল এরশাদকে তোষণের যে নীতি নিয়েছিল, তার দায় বইছে দেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের সুরক্ষায় রাজনীতিবিদদের দুর্বল অঙ্গীকারই জেনারেলদের সুযোগ করে দিয়েছে। লিখেছেন আলতাফ পারভেজ

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আঁচ–অনুমান শুরু হয়েছে। ভাঙাগড়া চলছে জোট-মহাজোটে। কিন্তু আপাতত কারও পক্ষে অনুমান করা সহজ নয়, তৃতীয় বৃহৎ দল জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনে কী অবস্থান নেবে। অন্তত ২১ অক্টোবর পর্যন্ত জেনারেল এরশাদ তাঁর বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আনবেন না। ওই দিন জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার পরবর্তী কার্যদিবস। সেদিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ধার্যকৃত দিন। এই মামলায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদ অন্যতম আসামি।

৩৭ বছর আগে জেনারেল মঞ্জুর মারা গেছেন। আর এই মামলার বয়স চলছে ৩৩ বছর। কবে এর মীমাংসা হবে কেউ জানে না। ৮৮ বছর বয়সী এরশাদকে বহু বছর যাবৎ নানারূপ মামলা-মোকদ্দমার সঙ্গে রাজনৈতিক কলাকৌশলের সমন্বয় করে চলতে হচ্ছে। রাজনীতি তাঁকে কারাভোগ থেকে রক্ষা করছে, নাকি মামলা তাঁর রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে, এ নিয়ে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মাঝে বিতর্কের শেষ নেই। সচরাচর জাতীয় নির্বাচন এলে এরূপ বিতর্কে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ মুহূর্তে এ রকম জেনারেল রয়েছেন আরও অন্তত তিনজন। এরশাদের মতোই কারাভোগ এড়াতে রাজনীতিকে আশ্রয় করে লড়ছেন পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফ এবং শ্রীলঙ্কার শরৎ ফনসেকা। অনেকের ধারণা, যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক প্রচার এড়াতে মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাংও রাজনীতিতে নামতে পারেন।

পারভেজ মোশাররফ: একাকী ক্রিকেট দর্শক
বয়সের বিবেচনায় আলোচ্য চার জেনারেলের মধ্যে বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদের পরই সিনিয়র হলেন পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফ। পাকিস্তানের শাসন ইতিহাসে ৩৩ বছরের হিস্যা রয়েছে সামরিক শাসকদের। এর মধ্যে পারভেজ মোশাররফের ভাগ প্রায় নয় বছরের। কিন্তু ২০১৬ সালের মার্চ থেকে পাকিস্তানের এই সাবেক সেনাপ্রধান দুবাইয়ে পালিয়ে আছেন। বয়স এ মুহূর্তে তাঁর ৭৫ চলছে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশটি শাসন করেন তিনি। ক্ষমতায় থেকে বিভিন্ন দলের দলছুটদের নিয়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় মুসলিম লিগ নামে একটি দল গড়ে তুলেছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। লন্ডনে কিছুদিন পালিয়ে ছিলেন তখন। ২০১০ সালে দেশে ফিরে পুরোনো দলটিকে আবার পুনর্গঠন করেন এবং এই দল তাঁকে বহুদিন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা থেকে রক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দল দুর্বল হয়ে যাওয়ামাত্র মোশররফকে পালাতে হয়। কারণ, মামলাটি সচল আছে। আলোচ্য মামলায় সাজা হতে পারে যাবজ্জীবন কারাভোগ বা মৃত্যুদণ্ড। তাঁর বিরুদ্ধে বেনজির ভুট্টো, নওয়াব আকবর বুগতিকে হত্যায় যুক্ত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার দিনগুলোতে চার তারকা জেনারেল পারভেজ মোশাররফ প্রায়ই তাঁর ‘কমান্ডো’ জীবনের সাহসিকতার গল্প শোনাতেন। কিন্তু সেনাবাহিনী, নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানের কাছে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মাত্র আদালতের সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছেন ওই কমান্ডো। আদালতে হাজির না হওয়ায় সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনেও তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। তাঁর দল ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে ৪২ আসনে প্রার্থী দিয়ে কোনো আসন জেতা দূরের কথা, জাতীয় ভোটের ১ শতাংশও পেতে ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদ যেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সহায়তায় কারাগারের বাইরে আসতে পেরেছিলেন, মোশাররফও সেভাবেই নওয়াজের দলের সহায়তায় দুবাই পালাতে পেরেছেন। কৌতুককর হলেও সত্য, নওয়াজকে উৎখাত করেই জেনারেল মোশাররফ ক্ষমতাসীন হন। পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনে করুণ ফলাফলের পরপরই কাকতালীয়ভাবে দেখা গেল রাজনৈতিকভাবে প্রায় নিঃস্ব এই জেনারেল দুবাই স্টেডিয়ামে বসে একাকী ক্রিকেট খেলা দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে তাঁর প্রায় হাজার হাজার অনুসারী থাকলেও তাঁর টুইটগুলোয় সামান্যই লাইক, কমেন্ট পড়ে ইদানীং।

শরৎ ফনসেকা: যুদ্ধাপরাধের দায় এড়াতে লড়ছেন
৬৮ বছর বয়সী শরৎ ফনসেকা পারভেজ মোশাররফের মতো অতটা বিবর্ণ অবস্থায় পড়েননি এখনো। তবে দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক জেনারেলদের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ডমার্শাল তিনি। তাঁর সামরিক নেতৃত্বে দেশটি ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং তামিল বিদ্রোহ থেকে মুক্তি পায়। ফলে সিংহলিদের মাঝে ফনসেকার বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। তবে তামিলরা বরাবরই তাঁর বিরুদ্ধে নিরপরাধ বেসামরিক মানুষকে হত্যার অভিযোগ আনছে। তাদের হিসাবে, ২০০৯-এ যুদ্ধের শেষ মাসগুলোয় প্রায় ৪০ হাজার তামিল নিহত হয় শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর আক্রমণে। হাসপাতালগুলোতেও সে সময় বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল। সরকার এরূপ নিহত মানুষের সংখ্যা নয় হাজার বলছে। এলটিটিই নেতা প্রভাকরণকে জীবিত অবস্থায় আটকের পর মৃত পাওয়া যাওয়ায় তামিলরা তার জন্যও ফনসেকাকে দায়ী করছে। ২০০৯–পূর্ববর্তী গৃহযুদ্ধকালে ফনসেকা পরিচালিত সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের পূর্ণ আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি এই মুহূর্তেও জীবন্ত। এসব কারণে অবসর গ্রহণের পরই রাজনীতির আশ্রয় নেন এই জেনারেল। ডেমোক্রেটিক পার্টি নামের একটি দল গঠন করেন। প্রথমে ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে। এরপর থেকে রাজাপক্ষবিরোধীরা তাঁকে ব্যবহার করে চলেছে। তিনিও তাদের ব্যবহার করে চলেছেন।

ফনসেকা বরাবরই তামিলবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের কর্তৃত্ব নিতে চাইলেও যুদ্ধাপরাধের জন্য প্রধানত তখনকার প্রতিরক্ষাসচিব (মাহিন্দা রাজাপক্ষের ভাই) এবং সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ তাঁর নির্দেশে হলেও যুদ্ধাপরাধের দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে সচেষ্ট তিনি। বর্তমানে বিক্রমাসিংয়ে সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যেহেতু রাজাপক্ষবিরোধী শিবিরে তামিল রাজনীতিবিদেরাও রয়েছেন, সে কারণে ফনসেকার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের আন্দোলন আগের মতো আর সোচ্চার নেই এখন। ধারণা করা যায়, এভাবেই নিজেকে কারামুক্ত রাখতে দেশটির তামিল সমর্থনপুষ্ট রাজাপক্ষবিরোধী ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি প্রতি তাঁর সমর্থন থাকবে।

মিন অং হ্লাং: বিশ্বের অন্যতম খলনায়ক
মিয়ানমারের মিন অং হ্লাংয়ের ক্ষেত্রেও ফনসেকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আরাকানে রোহিঙ্গা নিধনাভিযানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ও প্রকাশ্য সমর্থন যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করার জন্য আন্তর্জাতিক দাবি উঠেছে। ২৭ আগস্ট জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নিপীড়নের যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে জেনারেল মিনের বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্তের মতো বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাবলির উল্লেখ রয়েছে। হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এই বিষয়ে তদন্তের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখারও ঘোষণা দিয়েছে। যদিও আপাত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে সহযোগিতা করার দায় নেই মিয়ানমারের। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর ইমেজ ক্ষুন্নœকরছে।

মুসলমানবিরোধী ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে ফেসবুকের পাশাপাশি রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ভিকে’ও মিন অং হ্লাংয়ের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে সম্প্রতি। তাঁর অ্যাকাউন্ট বন্ধের জন্য টুইটার কর্তৃপক্ষের ওপরও চাপ আছে। জাতিঘৃণা ছড়ানোর দায়ে বর্তমান বিশ্বে অন্যতম নিন্দিত ব্যক্তি উচ্চাভিলাষী এই জেনারেল। কিন্তু দেশটির উগ্রবাদী বৌদ্ধরা তাঁর অনুরাগী। ফেসবুকে তাঁর অ্যাকাউন্ট বন্ধের পর তিনি ভিকে ব্যবহার শুরু করেন। মিয়ানমারের ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ ফেসবুকে রয়েছে। মিন অং এত দিন ফেসবুক ব্যবহার করেই দেশটির উগ্রবাদীদের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু একের পর এক সামাজিক মাধ্যমে তাঁর অ্যাকাউন্ট বন্ধ হওয়ায় সশস্ত্র বাহিনী রাজনৈতিক সরকারকে দোষারোপ করছে। জেনারেলরা মনে করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপের পেছনে ক্ষমতাসীন এনএলডির হাত রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গুঞ্জন ডালপালা মেলছে, সশস্ত্র বাহিনী ত্যাগ করে ভবিষ্যতে মিন অং হ্লাং দেশটির রাজনীতিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। অন্তত ২০২০ নাগাদ তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে চাইবেন। এ রকম গুজবও রয়েছে সুচিকে সরিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারে। আরাকানের ঘটনাবলির তদন্তে সু চি যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন, তাতে একজন বিদেশিকে রাখায় সশস্ত্র বাহিনী আপত্তি তুলে ক্যুর হুমকি দিয়েছিল বলে থাইল্যান্ডের সুপরিচিত ব্যাংকক পোস্টে খবর প্রকাশিত হয়েছে গত মাসে। এরূপ শঙ্কা আপাতত অবিশ্বাস্য মনে হলেও নেপিডোতে কান পাতলেই সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কে টানাপোড়েন টের পাওয়া যায়। মিন অং হ্লাংয়ের কর্মের দায় নিয়ে বিশ্বে সু চির ইমেজ ভূলুণ্ঠিত। দেশেও মিন অং ও তাঁর সামরিক সহযোগীদের সঙ্গে আপস করতে গিয়ে নির্বাচিত হওয়ার তিন বছর পরও অং সান সু চি গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলো এগিয়ে নিতে পারেননি।

মূলত, সামরিক বাহিনীর ছদ্ম প্রভাবের সঙ্গে আপস–রফা করতে গিয়ে সু চি যে রাজনৈতিক ভোগান্তির মুখে পড়েছেন, তার সঙ্গে মিল রয়েছে পারভেজ মোশাররফ ও শরৎ ফনসেকা অধ্যায়ের। বাংলাদেশেও সামরিক শাসনের বিরোধিতাকালীন রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো ভুলে মূলধারার দলগুলো জেনারেল এরশাদকে তোষণের যে নীতি নিয়েছিল, তার দায় বইছে এখন সমগ্র দেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের সুরক্ষায় রাজনীতিবিদদের দুর্বল অঙ্গীকারই জেনারেলদের সুযোগ করে দিয়েছে জবাবদিহি থেকে রেহাই পেতে।

Advertisement