লন্ডন মেয়র নির্বাচন : ফলাফলের স্টিয়ারিং ক্যাব ড্রাইভারদের হাতে

কামাল মেহেদী ।। করোনা মহামারীতেই আগামী ৬মে অনুষ্ঠিত হচ্ছে লন্ডন মেয়র নির্বাচন। লন্ডনের প্রায় ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ভোটার এবার ২০ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে লন্ডন মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করবেন।
সরাসরি ভোটে লন্ডন মেয়র নিবাচন শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন কেন লিভিংস্টোন। তখন অবশ্য তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। আর লেবার দলের প্রার্থী ছিলেন কেমডেনের প্রয়াত এমপি ফ্র্যাঙ্ক ডবসন। পরে কেন লিভিংস্টোন লেবারে ফিরে আসনে এবং ২০০৪ সালে লেবার দলের প্রার্থী হিসেবে পুনরায় লন্ডন মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লন্ডন মেয়র ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ২০১৬ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হননি। কনজারভেটিভের প্রার্থী ছিলেন জ্যাক গোল্ডস্মীথ এবং লেবার পার্টির প্রার্থী হন সাদিক খান। এশিয়ান এবং মুসলিম প্রার্থী হিসেবে এই কমিউনিটির মানুষের বেশি সমর্থন ছিল সাদিক খানের প্রতি। তারপরেও কিন্তু সাদিক খান প্রথম রাউন্ডের ভোটে জয়ী হতে পারেননি। কোনো প্রার্থী প্রথম রাউন্ডে অন্তত ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে দ্বিতীয় রাউন্ডের (সেকেন্ড প্রেফারেন্সের ভোট) গণনা করা হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে (প্রথম প্রেফারেন্সে) ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন সাদিক খান। সেকেন্ড প্রেফারেন্স বা দ্বিতীয় রাউন্ড মিলে ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটে লন্ডনে লেবার পার্টির দ্বিতীয় মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন সাদিক খান। অন্যদিকে প্রথম এবং দ্বিতীয় রাউন্ড মিলে ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক গোল্ডস্মীথ।
এবার কনজারভেটিভের প্রার্থী হয়েছেন শন বেইলি। বর্তমানে লন্ডন এসেম্বিলী মেম্বার শন বেইলির প্রতি কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটির সমর্থন একটি বেশী থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও কৃষাঙ্গ কমিউনিটি থেকে স্বতন্ত্রসহ আরো তিনজন প্রার্থী রয়েছেন এবার। অন্যদিকে বর্তমান মেয়র সাদিক খান এবারো শক্তিশালি অবস্থানে। কিন্তু তাঁর কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বিশেষ করে করোনা মহামারী শুরুর পর বেইল আউটের শর্ত হিসেবে কনজেশ্চন চার্জ এবং সময়-সীমা বৃদ্ধির বিষয়টি সবচাইতে বেশি সমালোচিত। শুধু তাই নয়, লন্ডনের বাসলেনের উপর (রেড-রুট) অন্তত ৫০ মাইল জুড়ে ২৪ ঘন্টার জন্যে পার্কিং এবং গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন তিনি। এই অক্টোবর থেকে বাড়বে ইউলেজের পরিধিও। আর আগামী বছর থেকে লন্ডন বাউন্ডারী চার্জ আরোপের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।
কনজেশ্চন চার্জ এবং সময়-সীমা সপ্তাহে সাতদিন বাড়ানোর ফলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লন্ডনের ক্যাব ড্রাইভাররা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লন্ডনের ছোট্ট এবং মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমন কি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপরেও প্রভাব পড়েছে। বাস লেন ব্যবহার বন্ধের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্যাব ড্রাইভার এবং ব্যবসায়ীরা। ক্যাব ড্রাইভার এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সাদিক খানের দুটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হয়েছে জোড়ালোভাবে। প্রস্তাবিত বাউন্ডারী চার্জ আরোপেরও সমালোচনা করেছেন কনজারভেটিভ পার্টির বেশ কয়েকজন এমপি।
গত ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে কনজারভেটিভ পার্টির লন্ডন মেয়র প্রার্থী শন বেইলির একটি স্বাক্ষাতকার নিয়েছিলাম চ্যানেল এসের জন্যে। সেখানে শন বেইলি খুব পরিস্কারভাবে বলেছেন, তিনি মেয়র নির্বাচিত হল কনজেশ্চন চার্জ পুরোপুরি বাতিল করবেন। বাতিল করবেন ২৪ ঘন্টার বাসলেন ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা এবং বাউন্ডারী চার্জ আরোপের সিদ্ধান্ত। কিন্তু ইউলেজের পক্ষে তিনি। তবে এর পরিধি বাড়াবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই ইস্যুতে গত মার্চে স্বাক্ষাতকার নিয়েছিলাম লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টির লন্ডন মেয়র প্রার্থী লুইসা পোরিটের। কেমডেনের মেয়ে এবং কেমডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর লুইসাও বলেছেন, আগামী ৬ মে’র নির্বাচনে লন্ডন মেয়র নির্বাচিত হলে কনজেশচন চার্জ, ইউলেজ এবং বাউন্ডারী চার্জ বাতিল করে একটি পে-এস-ইউ-গো স্কীম নিয়ে আসবেন তিনি। অর্থাৎ এটা স্থায়ী হবে না, গাড়ি কতোক্ষন অবস্থান করবে এবং গাড়ির ভেতরে যাত্রীর সংখ্যানুপাতে নির্ধারণ করা হবে কনজেশ্চন চার্জ। এছাড়া ২৪ ঘন্টা বাস লেন ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিল এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও জানান তিনি। দুর্ভাগ্য হল এসব ইস্যুতে বর্তমান মেয়র সাদিক খানের স্বাক্ষাত পাওয়া যায়নি। যদিও সাদিক বলেছেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত টিএফএলকে রক্ষা করতে সরকারের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন পাউন্ডের বেইল আউটের শর্ত হিসেবেই সাময়িকভাবে তিনি কনজেশ্চন চার্জ বাড়িয়েছেন। ফ্রিডম পাস এবং শিক্ষার্থীদের ফ্রিস বাস পাসও শর্তমূক্ত হতে পারেনি! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গরিবের উপর আরোপিত সব শর্ত তিনি মেনে নিবেন কেন?
অন্যদিকে শন বেইলি এবং লুইসা পোরিট নিশ্চিত করেছেন, তারা চ্যানেল এসকে যা বলেছেন তা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সমানভাবে রাখবেন। এখন তারা যদি এসব ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তন করেন এটা তাদের নৈতিকতার ব্যাপার! কিন্তু ভোটের দিন ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ক্ষতিগ্রস্তদের।
লন্ডনে ক্যাব ড্রাইভারের সংখ্যা কম-বেশি হলেও প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজারের ভেতরে। বর্তমান মেয়রের সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাব ড্রাইভার এবং ব্যবসায়ীরা চাইলে এবার নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারন করতে পারেন।
লন্ডনের ২০ বারায় বাস লেন ব্যবহারের উপর ২৪ ঘন্টার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে আন্দোলন-প্রতিবাদ হয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটসেও। এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন, এমন একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম লন্ডন মেয়র নির্বাচন নিয়ে। তিনি খুব দৃঢ়তার সাথে বললেন, “জুইশ লবিং এক হলে কেউ সাদিক খানকে আটকাতে পারবে না।” আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “ তাঁকে আটকানোর জন্যে আপনারা যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই সব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এক হয়েছেন কি না?” এর উত্তর তিনি দিতে পারেননি! আমরা আগে কিছু ভাবি না। সমস্যা হলে বা ক্ষতির মুখে পড়লে আমাদের টনক নড়ে।
বাস রুট, কনজেশ্চন চার্জসহ ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডন সংক্ষেপে টিএফএলের সব সার্ভিস পুরোপুরি লন্ডন মেয়রের নিয়ন্ত্রণে। ১৭ বিলিয়ন পাউন্ডের বাজেট নিয়ন্ত্রণ করেন লন্ডন মেয়র। তিনি চাইলে কনজেশ্চন চার্জ বাতিল করে দিতে পারেন, চাইলে বাস রুট ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারেন। বিকল্প উপায় বের করে বাতিল করতে পারেন ইউলেজ বা ইউলেজের চার্জ কমাতে পারেন। এগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত নয়, লন্ডন মেয়রের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। এ কারণে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিগুলো দেখে শুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এবং ক্যাব ড্রাইভারদের ভোট দেওয়া উচিত। এখানে পার্টির সমর্থন হিসেব করে লাভ নেই। এখানে রুটি-রুজিকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ধরে নেন, জুইশরা লবিং করবে। কিন্তু ভোট তো আপনাদের হাতে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা জানা নেই। কিন্তু ১ লাখ ২৪ হাজার ক্যাব ড্রাইভারের ঘরে স্বামী-স্ত্রী বা পরিবারে সদস্য মিলে তিন থেকে চারটি ভোট থাকতে পারে। এখাতে শতভাগতো আর জুইশ না! ৮০ শতাংশ ক্যাব ড্রাইভারও যদি প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রেফারেন্সের ভোট থেকে সাদিক খানকে বঞ্চিত করেন তা হলে অবস্থা কি হবে একটু ভাবুন!
তবে কনজেশ্চন চার্জ, বাস লেন ব্যবহারে ২৪ ঘন্টার নিষেধাজ্ঞা, ইউলেজ এবং বাউন্ডারী চার্জের ব্যাপারে সাদিক খানের অবস্থান এবং টোরি ও লিবডেম প্রার্থীর প্রস্তাবের ব্যাপারে বিশ্লেষকদের মতামত একটু ভিন্ন। কারো কারো মতে, ক্যাপিটাল সিটি লন্ডনকে পুরোপুরি সংরক্ষিত করার জন্যে যে কাজগুলো করার প্রয়োজন, ইস্টাবলিশমেন্টরা সাদিক খানকে দিয়ে সেই কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে বা করিয়ে নেবে। তাই জুইশ লবিং বলেন আর ইস্টাবলিশমেন্ট বলেন, তাদের সুনজর সাদিক খানের প্রতি থাকতেই পারে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাব ড্রাইভার এবং ব্যবসায়ীদের ভোটের প্রভাবে ফলাফল পুরোপুরি না বদলালেও ভোট কমবে সাদিক খানের। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এবং ক্যাব ড্রাইভাররা যদি প্রথম প্রেফারেন্স এবং দ্বিতীয় প্রেফারেন্সের দুটি ভোট থেকেই সাদিক খানকে বঞ্চিত করেন তাহলে কিন্তু সাদিক খান পরাজিত হতে পারেন বলেও ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
মনে রাখতে হবে গত নির্বাচনে সাদিক প্রথম প্রেফারেন্সের ভোটে জয়ী হতে পারেননি। দ্বিতীয় প্রেফারেন্সের ভোট মিলে তিনি সর্বমোট ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। এটা হবে প্রতিবাদের ভোট। তাই প্রথম প্রেফারেন্সের ভোট অন্য কাউকে দিয়ে দ্বিতীয় প্রেফারেন্সের ভোট যদি সাদিক খানকেই দেন, তাহলে আর প্রতিবাদ থাকলো কোথায়?

এক নজরে দেখে নিন এবারের লন্ডন মেয়র নির্বাচনের প্রার্থীদের নাম।
এবারের লন্ডন মেয়র নির্বাচনে সর্বমোট ২০জন প্রার্থী হয়েছেন। লেবার দলীয় প্রার্থী বর্তমান মেয়র সাদিক খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কনজারভেটিভ পার্টির শন বেইলি, লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টি থেকে লুইসা পোরিট, গ্রিনপার্টি থেকে সায়ান বেরি, রিনিউ’র কাম বেলায়েভ, স্বতন্ত্র প্রার্থী কাউন্ট বিনফেইস, বার্নিং পিংকের ভ্যালেরিয়া ব্রাউন, লেট লন্ডন লাইভের পিয়ার্স করবিন (সাবেক লেবার নেতা জেরেমি করবিনের বড় ভাই), স্বতন্ত্র প্রার্থী ম্যাক্স ফশ, রিক্লেইম পার্টির লোরেইন্স ফক্স, ইউকিপের পিটার গ্যামন্স, রিজয়েন ইইউ’র রিচার্ড হিউসন, এনিমেল ওয়েলফেয়ার পার্টির ভানেসা হাডসন, সোসাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির স্টিভ ক্যালাহার, হ্যারিটেইজ পার্টির ডেভিড কুর্টেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারাহ লন্ডন, স্বতন্ত্র প্রার্থী নিমস ওবুঙ্গা, স্বতন্ত্র প্রার্থী নাইকো ওমিলানা, উইমেন্স ইকুয়ালিটি পাটির ম্যান্ডু রিড, লন্ডন রিয়েল পার্টির ব্রায়ান রোস।

লেখক : সম্পাদক, ব্রিটবাংলা২৪ ডট কম এবং হেড অব নিউজ, চ্যানেল এস।

Advertisement