আমার স্বাধীনতা যুদ্ধ : ১১ বছরের বালক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি

                ॥ ইমরান আহমেদ চৌধুরী ॥

প্রথম পর্ব : আন্দোলন

আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি বেশ ভালো ছাত্র, যদিও লেখাপড়ায় মনোযোগ কম তবুও যে কোনকিছু কয়েক বার পড়লেই ঠোঁটস্থ হয়ে যেত নিমিষেই  ক্লাসের প্রথম কয়েক জনের কাতারেই থাকতাম সব সময়।বরাবরই ভালো রেজাল্ট করতাম পিতা মাতা দুজনের সরকারি চাকরির বদৌলতে এই বয়েসেই অনেকগুলো ভালকম ভালো ছোট  বড় স্কুলে পড়ে ফেলেছি ইতিমধ্যে কালীগঞ্জ (খুলনা ), খুলনা ( টি স্কুল ), রাজশাহী, লাতু (সিলেট) এবং সিলেট শহর (স্কুল এবং মাদ্রাসাখণ্ডকালীনপ্রাত সেশন  )  পড়াশুনা করে ফেলেছি আমরা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে থাকি ছোট বেলা থেকেই অনেকগুলো শহর , বন্দর নগরে থাকা হয়েছে গেছে   আমার ছোট দুই ভাই একজন এবং সবচে ছোট বোন ১৫ বছর । ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরটা হল সকল ধরনের রাজনীতির এক গরম বিছানা ; খুবিই সচেতন মানুষ এখানকার, প্রগতিশীল এবং শিল্প সাহিত্যানুরাগী, একটু বিপ্লবী ধরনেরএই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই জন্ম গ্রহণ করেছিল বাংলার বারো ভুঁইয়াদের দলপতি ঈশা খাঁ। যে বাংলার সুলতানাতের বারো জন জমিদারদের নিয়ে মোগলদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৪স খ্রিস্টাব্দে করেছিল বিদ্রোহ। ছিমছাম ছিল আমাদের পরিবারটা। বেশ সঙ্গীত অনুরাগী, সাহিত্য চর্চা চলত সব সময়। জ্যোৎস্না রাতে বাসায় বসতো গানের আসর। মানু আপা সবচে বড় বোন ; ঢাকায় হোস্টেলে থাকতো। ও আসলেই বসত গানের আসর। যে কোন শিল্পীর গলাই সে অতি নিমিষেই নকল করে ফেলত। সেলতা কিংবা নুরজাহান বা সামসাদ বেগম কিংবা ফেরদৌসি বেগম অথবা রুনা লায়লা আশপাশের বাসার সবাই এসে যোগ দিতো আমাদের বাসার গানের আসরে  ভাইজান, আমাদের বড়ভাই১৬ বছর বয়সী ১৯৭১ সালে এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা প্রার্থী অনেক লম্বা, দুটো দাঁত তার একটার উপর আরেকটা উঠাআঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে গেঁজ দাঁত  সিলেটে থাকে পড়াশুনার জন্যম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য  আমার সাথে তার সাপে নেউলে সম্পর্কআমি সুযোগ পেলেই ওকে খেপাতাম সারাক্ষণ আমাকে খেপাতো নয়ত হাস্যরহস্য করত ; ক্যারাম খেলায় আমাকে পার্টনার বানাত আর আমাকে শিখিয়ে দিত কিভাবে কোন গুটিটা কিভাবে মারতে হবে আর  আমি ফেলতে না পারলেই বকা দিত আর শুরু হত ঝগড়া। ভয় পেতাম ওকে খুব। আবার সারাক্ষণ কুস্তাকুস্তি চলত লেফট আউট পজিশনে ফুটবল খেলত বাম পায়ের শট ছিল দারুণ। সিলেটের পুলিশ লাইন মাঠে আমারা সিলেট থাকাকালীন সময় মাঠেই প্রাকটিস করতাম, ওই আমাকে ফুটবল খেলা শিখিয়েছে সে ছিল নিরামিষ ভোজনকারীশুধু ডিমটাই খেত

বাকি সব নিরামিষ বাসায় আমরা সারাক্ষণ কেবল আড্ডা, গল্প। ফুর্তি, পড়ার সবাই পড়া রোববারে দুপুরে খাবার দাবার তাড়াহুড়া করে শেষ করে সবাই ঘসা মাজা ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে রেডিওতে শুনতাম সানডে ম্যাটিনি নাটকরবি ঠাকুরের ডাক হরকরা, ফটিক কিংবা খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন আম্মা বেশ সুন্দর গান গাইত সারাক্ষণ গুন গুন করে একটা গান লিখো  আমার জন্য, না হয় আমি ছিলাম তোমার কাঁছে অতি নগণ্য অথবা, ”তুমি যে গিয়াছো বকুলো বিছান পথে, নিয়ে গেছো হিয়া কি নামে ডাকিয়া ……দাদীর বাবাদের বাড়ির অনেক লোকজন আসতেন আমাদেরকে দেখতে ওনাদের নিকতম প্রধানশহর এটা অনেক মানুষ প্রায় এসে আমাদের খোঁজ খবর নিত। আমাদের আব্বা ছিল দাদীর পরিবারের সবচে বড় ছেলে। তাই খোকা ( আমাদের পিতার ডাকনাম) চৌধুরী ছিল সবার প্রিয়। অকপটেই আমি রপ্ত করে ফেললাম ওনাদের গ্রাম্য এক্সেন্ট ( উচ্চারণ) ওরা চলে গেলেই দেওয়া শুরু করতাম ওদের কথা বলার স্টাইল এবং হুবুহু উচ্চারণ আর সবাই হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পরত আমার নাটকীয় স্টাইলে ওদেরকে নকল করা দেখে কয়দিন পর পর ঢাকা যেতাম আমার সাথেতখনকার নিউ মার্কেট, বাইতুল মোকাররম, জিন্নাহ এভেনুই আর ঝকমকে নিওন সাইনগুলো পড়তে পড়তে আমার সময় কেটে যেত যখন আম্মা, মানু আপা বা টুলু আপা সওদা করতে ব্যস্ত

সেই তখন থেকেই আজও আমার সাইনবোর্ড পড়া আর ওগুলো মুখস্ত করা আমার অভ্যেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া পিটি আই স্কুলের মাঠে থুখোর ক্রিকেট খেলোয়াড়ডান হাতি ব্যাটস ম্যান এবং মাঠের সবচেনির্ভরশীল উইকেট কিপার ছিলাম আমি । আব্বা সব সময় পড়তে দিতেন মাও সে তুং এর লাল বই বাংলা অনুবাদ, চেগুভারার বলিভিয়ার ডাইরি অথবা ওর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা ম্যাগাজিন বৃষ্টির দিনে আম্মা আমাদেরকে পড়ে শুনাতেন ট্রোজান ওয়ার বিখ্যাত একেলিস এরগল্প, নয়ত মাইকেল মধুসূদনের মেগনাদ বদ কাব্য অথবা এলেক্সান্ডার এর বিশ্ব বিজয়ের গল্প কিংবা হেলেনিক ওয়ার এর গ্রীক মাইথোলজির গল্প বলা ; ব্রাহ্মণ বাড়িয়া ঘোড়াপট্টির আব্দু মামার দোকানে যেয়ে ছানার মুড়কি কিনে এনে বসে বসে ওনার ছেলে আশরাফ এর সাথে খেতাম আমি আর দুলাল। চোখ ধাদানো ব্যায়াম করতেন আর আমরা বসে বসে দেখতাম হেলাল ভাইকে ; বিকালে সবাই চলে যেতাম এয়ান্ডারসন ক্যেনাল এর পারে হাটতে, নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে , ব্রাহ্মনবাড়িয়া রেলস্টেশনের পাশে ইরানী মানুষেরা তাঁবু গেড়ে আস্তানা বানাত আর চশমা, তাবিজ এবং বিভিন্ন জিনিস রকমারি ফেঞ্চি আইটেম  বিক্রি করত ; সম্পূর্ণ পরিবার এক সাথে যেয়ে সিনেমা দেখা আমাদের শেষ ছবি ছিল, যে ছবিতে রঙ্গিলা গরুর গাড়ী চালাতে চালাতে গেয়েছিল , আরে গা মেরেমনোয়া, গাতা জ্যারে আপানানা নাগরিয়া ছে দূর এই ছিল জীবনের খুঁটিনাটি। কি সুন্দর ছিল সময়টা আম্মা এবং আব্বা দুজনেই চাকরি করতেন বেশ প্রাচুর্য ছিল, অভাব ছিলনা তেমন কোনকিছুর, বেশ সুন্দর পরিচ্ছন ছিল জীবন জীবিকা, আনন্দ, ফুর্তি, পরিপাটি সব সুন্দর করে ঘর বাড়ী ঘুছানো এবং সাংস্কৃতিক ভাবে উভয় প্রাচ্য এবং পশ্চিমা ধাঁচেই এগিয়ে যাচ্ছিল জীবনটা । আমাদের পরিবারটা খুবিই সেকুয়ালার ছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং ক্রিস্টিয়ান সব ধরনের পারিবারিক বন্ধুদের সাথে আমাদের উঠা বসাছিল একতা নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার

আব্বা এবং আম্মা দুজনেরই শৈশব থেকে যুবক সময়ের জীবনটা কেটেছে কলকাতায় ; সারাক্ষণ ওনাদের মুখে কলকাতা ; স্বপনের শহর কলকাতা , প্রাচ্যের লন্ডন নামে খ্যাত কলকাতাআর কলকাতাসব  ওনাদের মুখে মুখে শুনে শুনেই কেমন জানি চিনে ফেলেছিলাম এসপ্ল্যানেড, চৌরঙ্গী, ফোরট উইলিয়াম, ইয়াসিন মোল্লার টেইলার সপ, গ্র্যান্ড হোটেল, পার্ক সার্কাস, সেক্সপিয়ার স্মরণি, গড়ের মাঠ, ইডেন ক্রিকেট মাঠ, গড়ি হাট আর চিনতাম বেহালা থেকে সারা কলকাতার বিভিন্ন ট্রাম স্টপ এর নামগুলো আব্বা বলতেন আমাদের দাদা চাকরি করতেন কলকাতার প্রসিদ্ধ এবং সবচেদামী গ্র্যান্ড হোটেলেসেই ১৯২৫ সাল থেকে বিলাত থেকে ফেরত আসার পর থেকেই ; রবিবারে স্যুট কোট পরে সে নাকি কলকাতা রেসকোর্সে জেতেন ঘোড় রেস দেখতে এবং ঘোড়ার উপর বাজিও ধরতেন আম্মা কোন কোন ট্রাম স্টপের পাশের গাছে তার  নাম ডলিলেখেছে চাকু দিয়ে কেটে কেটে। আম্মা বলত সবাইকে নিয়ে কলকাতা যাব একবার তোমাদেরকে দেখানোর জন্য আম্মা ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম রায়ট এর সময় কলকাতায় ভিক্টিমদের শুশ্রুষা করার জন্য ভলেন্টিয়ার নার্স হিসেবে যোগ দিয়েছিল  সেই ১৫১৬ বছর বয়েসেই। বাড়িরসবচেছোট ছিল তাই তার সাত খুন মাফ ছিল;  বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার সিলেটের হবিগঞ্জ  থেকে করিমগঞ্জদিনাজপুরের হিলি হয়ে কলকাতা অব্দিবিস্তৃত ছিল পারিবারিক ব্যবসা এবং শিক্ষকতা পেশা ১৯৪৯ সালে সে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ইন্ডীয়া তে নব প্রতিষ্ঠিত ক্যমুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে এবং কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং ঘেরাও মার্চে থেকে এরেস্ট হয়েছিল একবার তারপর ওনার রাজনীতিতে ইস্তেফা এবং পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তানে এসে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে পাকিস্তান সি এন্ড ল্যান্ড কাস্টমসে অফিসার হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন কিন্তু, এসবের পরও আমাদের পিতামাতা ছিল খুবিই ভীষণচুপচাপ ; চাকরী এবং পরিবার নিয়েই তারা সারাক্ষণ ব্যাস্ত সময় কাটাত

জ্ঞ্যান অর্জন কর, শিক্ষিত হও, নিজে স্বাবলম্বী হও, ভাল মানুষ হওটাকা পয়সার পিছনে দৌড়াইও না, বিপদে যারা তাদের সহায়তা কর, সামাজিক উন্নয়নে সকল সময় অবদান রেখ, তোমার থেকে কম ভাগ্যবানদের সকল সময় সহায়তা করএইসব ছিল আমাদের জীবনকে গঠন করার ছবক বিরক্ত লাগত যদিও আর আব্বা ছিলেন একজন অঙ্ক জিনিয়াস, জ্যামিতিতে ছিল সে বেস্ট শিক্ষক ; একদম অতি সহজেই এলযেব্রা এবং ঐকিক নিয়মের অঙ্ক স্ফটিক এর মত স্বচ্ছ ভাবে বুঝিয়ে দিতেন ১৯৪৬ সালে উনার জীবনটা ওলট পালট হয়ে যায় চোখের পলকে তখন সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক এর আগেই নেমে এলো হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা ; হাজার হাজার মানুষ চতুর্দিকে ঘর বাড়ী হারাচ্ছে , হচ্ছে নিহত, হাজার হাজার আহত মানুষের হাহাকার ওনার প্রিয় কলকাতায়যে নগরীকে সে মনেক রতো পৃথিবীর অন্যতম সভ্য নগরী তাদের বাড়ির আসে পাশের প্রায় সব বাড়িগুলো থেকেই সবাই রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে তারপর, একদিন ওনারা চারজন, আমার দাদা, দাদী, আবার ছোট ভাই আব্বাদাদীর তিনটা শাড়ি দিয়ে বানানো দড়ি বেয়ে নিচে নেমে পালালো কলকাতা থেকে দিনের পথ ওনাদের আসতে লাগল ২৪ দিন সর্বস্বান্ত প্রায় কপর্দকহীন, এককাপড়ে পালিয়ে জান বাঁচালো তারপর শুরু হল এক ভিন্ন জীবন, পরিবারে নেমে এলো অনেক অভাব ব্রাহ্মনবাড়িয়া কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হল তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উনি কাটিয়েছেন তার ছাত্র জীবনের একটা মূল্যবান সময়। তারপর আর লেখা পড়া চালানো সম্ভব ছিলনা অর্থনৈতিক কারণে তাই বাধ্য হয়েই অনেকটা চাকরী ঢুকতে হল ভীষণ পড়ুয়া মানুষ ছিলেন আব্বারবিবারে সে সাত দিনের ইংলিশ এবং বাংলা পত্রিকাগুলো একদম প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে

আর তার প্রিয় পড়ার সাবজেক্ট ছিল মার্ডার মিস্ট্রি মাও সে তুং, লেনিন, কার্ল মার্ক্স , চে গুভারা, ফিডেল ক্রাস্ট্রো, আবুল হোসেন ভট্টাচার্য, নিহাররঞ্জন সহ বাংলা বা ইংরেজি  বই পড়া ছিল ওনার নিত্য দিনের রুটিন পৃথিবীর বিভিন্ন রাজ বংশ , বাংলাদেশের জমিদার, পুরা ভারতের বিভিন্ন রাজবংশ এবং রাজবংশের শাসন আমলের ইতিহাস প্রায় সবটাই ওনার ঠোটঅস্ত আব্বা ছিলেন এক বিশাল জোকার সারক্ষন একটা না একটা কৌতুক তার বলতেই হবে ।এই ছিল আমাদের পরিবারের জীবন যাপন  – ওই আমলেই আমারা বেড়াতে যেতাম সিলেটের বাল্লা তেখাসি পাহাররের সৌন্দর্য দেখতে, খোয়াই নদীতে ছোট নৌকা ভ্রমণে , তেলিয়াপারা, বড়লেখা, ছোটলেখা, কুমারশিল, সাতগাঁ চা বাগান দেখতেকিভাবে চা পাতা আহরণ করে ট্রাক্টর করে ফ্যাক্টরি তে এনে বাছাই, ড্রাই এবং চা পাতা বানানো থেকে শুরু করে পেটীতে ভরে হাতীর উপড়ে পেটীগুলো বেঁধে নিকতম লাতু (শাহবাজপুর) স্টেশন এনে ট্রেনে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতএসব জানার জন্য ; আব্বার সাথে সুন্দরবন যাওয়া সিলেটের সারেরপার ( লাতুর নিকট) হাওড়ে শীত কালের ভোরে উঠে পাখি মারতে যাওয়াএই সব মিলিয়ে জীবনটা বেশ অভিযাত্রীসুলভ। একটা পরিছন্ন এবং সুন্দর জীবন ছিল আমাদের পরিবারের। সম্প্রীতি, স্নেহ, আদর ভালবাসা এবং অগ্রগতিশীলতায় পরিপূর্ণ একটা জীবন ব্যবস্থা ছিল আমাদের ।(চলবে)

Advertisement