শিং

।। কামরুল হাসান।।

অবশেষে তরুর কাছে ধরা পড়তেই হলো।

ঘটনা হলো‌— তরুর, ‘খুবই ব্যক্তিগত’ একটি ছবি, এক সপ্তাহ আগে অনলাইনে, দেশের বাইরের একটি ‘প্রাইভেট ফোরামে’ আপলোড করেছিলো দীপন— জানার জন্য, তার স্ত্রীর এ ছবি দেখে ফোরামের পুরুষ সদস্যদের, কী প্রতিক্রিয়া হয়।

সুপারশপের নাইট-ডিউটি সেরে রাত দুইটায় ঘরে ফিরে, হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে দীপন চুপিচুপি, ল্যাপটপে, প্রাইভেট ফোরামের সদস্যদের কমেন্টস পড়তো; সেসময় তরু, তাদের দুই বছরের পুত্রসন্তান অন্ত’র সাথে ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু কস্মিনকালেও দীপন ভাবেনি, ছবি আপলোড করার সপ্তমতম রাতে, সে যখন কমেন্টস পড়তে ব্যস্ত, তার ঠিক পেছনেই, তরু ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁড়াবে। টের পাওয়ামাত্রই দীপন তাড়াহুড়ো করে ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তরু সেটা করতে দেয়নি।

এখন দীপন ও তরু মুখোমুখি বসে আছে— পাশেই, টেবিলের উপর, ল্যাপটপের স্ক্রিণে, তরুর ওই ব্যক্তিগত ছবিটি জ্বলজ্বল করছে।

ছবিটি, হানিমুনে তোলা হয়েছিলো— কক্সবাজারে— সৈকতের পাশের, সবচেয়ে উঁচু হোটেলের ১০ তলার সুইটের বাথরুমে। ছবিতে দেখা যায়, কমোডে বসে আছে তরু; চুলগুলোর কিছুটা কপালের দু’পাশ বেয়ে, দু’চোখের ভুরুর কোণায় অগোছালো ঝুলে আছে; বাকিটা মাথার পেছনে অবিন্যস্ত খোঁপায় আটকানো। পরণের হালকা নীলাভ বাথরোবটি পিঠের মাঝ বরাবর নেমে এসেছে; ফলে, গ্রীবা হয়ে কাঁধ‌ বেয়ে কনুই পর্যন্ত— পুরোটাই নিরাভরণ তরুর। এরপর বাথরোবটি, সামনের দিকে বুকের অর্ধেক পর্যন্ত চওড়াভাবে মেলে আছে; ফলে, কণ্ঠনালী থেকে বুকের উপরিভাগ হয়ে তরুর দুই বাহু ও স্ফীত স্তন-বিভাজিকা স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়েছে। মাথাটা কিঞ্চিৎ পেছনে হেলে, চোখের মনিতে ঝিলিক মেরে, দু’চোখের নীচের পাপড়িতে লেপটানো কাজল মেখে, পাতলা ওষ্ঠ ও পুরু অধর পরস্পরের সাথে আলতো চেপে— স্মিত চাপা হাসি, মুখে ঝুলিয়ে রেখেছে তরু।

দীপন প্রথমে ভেবেছিলো, অনলাইনে তরু নিজের ছবি দেখে, চিত্কার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলবে‌— হয়তো দীপনকে কষে কিল-চড়ও মারতে পারে। কিন্তু তরু এসব কিছুই করেনি— তার কারণ হতে পারে যে, তরু কখনোই বিধ্বংসী মারমুখী টাইপ মেয়ে নয়; কোনোরূপ ঝগড়া ফ্যাসাদে তার অংশগ্রহণ থাকে না— তাই সে এখন মুখোমুখি বসে, শ্যেনদৃষ্টিতে দীপনের দিকে তাকিয়ে আছে। তরুর পরণে ম্যাজেণ্ডা রঙের স্লিভলেস নাইটি, যেটি হাঁটুর কাছাকাছি এসে শেষ হয়েছে— তরুর হাতে মোবাইল— ঠোঁট সরু করে দীপনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, তারপর চোখ নামিয়ে, মোবাইলে টাইপ করতে শুরু করে।

কাউকে মেসেজ করছে তরু? কাউকে আসতে বলছে? বন্ধু, আত্মীয় নিয়ে বিচার-সালিশ বসাবে? কিন্তু সালিশে, ছবির প্রসঙ্গ কীভাবে তুলবে সে? বিচার চাইতে গেলে, ছবিটি দেখাতে পারবে তরু কাউকে? তরু মোবাইলে কী লিখছে— দীপনের পড়তে ইচ্ছে করছে খুব; কিন্তু সেটি মোটেও সমীচীন হবে না। বিয়ের পর থেকে ফেসবুক, ইমেইল‌, মোবাইল— পরস্পরের এসব একান্ত ব্যক্তিগত স্পেসগুলোতে নাক গলায়নি তাদের কেউই। এজন্যই, কোনো কিছু ‘পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড’ করে রাখার প্রয়োজনও হয়নি কারোরই। তরু, মোবাইলে এতোক্ষণ কী লিখছে, জানার আগ্রহ হলেও‌— দীপন জানে, তরু যদি এখন মোবাইল রেখে উঠে যায়, দীপন সেটা ছুঁয়েও দেখবে না; তবে পৃথিবী উল্টে গেলেও, তরু কখনোই তার মোবাইল কোত্থাও ফেলে যাবে না‌— মনের ভুলেও না। ওই সাত ইঞ্চি বেঢপ আকৃতির মোবাইল, তরুর হাতের তালুর সাথে মিশে থাকে সারাক্ষণ।

ভুরু কুঁচকে, মোবাইলে থেমে থেমে টাইপ করছে তরু— এতে বোঝা যাচ্ছে, সে কারো সাথে চ্যাট করছে। চুপচাপ বসে থাকায় দীপনের বিরক্তি লাগা শুরু হলো। এমন নিশ্চুপ পরিবেশে কাঁহাতক এভাবে বসে থাকা যায়! গাল-মন্দ যা করার ক’রে, বিষয়টির সুরাহা করছে না কেনো তরু? এ কেমন যন্ত্রণা! তরুর মোবাইল চ্যাটিং শেষই হচ্ছে না! অধৈর্য্য হয়ে দীপন ল্যাপটপে, তরুর ছবিটির দিকে আবার তাকায়।

ছবিতে, তরুর সুঢৌল স্তন-বিভাজিকায় মেলে থাকা বাথরোবটি, পেটের উপরিভাগে ফিতেয় বাঁধা পরলেও, নাভির কাছাকাছি পুনরায় প্রসারিত হয়ে, কোমরের দু’পাশ বেয়ে নিতম্বের পেছনে জমে আছে; ফলে, তরুর লম্বাটে গভীর নাভি, মেদহীন নিপাট তলপেট ও দুই মসৃণ উরু— নগ্ন-উন্মোচিত হয়েছে। কমোডে বসে থাকার ফলে, শরীরের উর্ধ্বাংশের চাপে, ভারি নিতম্বের ছড়ানো দু’পাশ ও উরুর সংযোগস্থল— কুঁচকিতে, গভীর খাঁজ তৈরি হয়েছে। তরুর উরু ফর্সা, সুগঠিত কিন্তু মাংসল নয়। বাথরুমের জানালা ভেদ করে সূর্যের আলো তীর্যক হয়ে, কমোডের দু’পাশে বিস্তৃত উরুর উপর এমনভাবে পড়েছে— যেনো একটি তীক্ষ্ণ ধারালো চিকচিকে রুপালি তরবারি, তরুর উরুর উপর আলগোছে ফেলে রাখা হয়েছে— যেনো সামান্য নড়লেই তরবারির আঁচড়ে, তরুর উরু চিরে যাবে। জানালা দিয়ে আসা উজ্জ্বল আলোর বাথরুমময় পরিভ্রমণে, তরুর উরুসন্ধির রহস্য খোলাসা হওয়ার কথা থাকলেও, সেটি সম্ভব হচ্ছে না— কারণ, তরু তার বাম হাতের তালু দিয়ে যোনীদেশ ঢেকে রেখেছে; আর ডান হাত সটান উপরে তুলে, হাতের পাঞ্জা পুরো মেলে, ক্যামেরাম্যানকে ছবি না তোলার অনুরোধ-ভঙ্গি করছে। তরুর ছবিটি দেখতে গিয়ে, এ পর্বে প্রচণ্ড আশাহত ও বেদনাক্রান্ত হতে হয়।

‘দীপন, কেনো তুমি ছবিটি অনলাইনে ছাড়লে?’ তরু ভাবলেশহীন স্বরে জানতে চায়।

চমকে উঠে দীপন। ছবির দিকে মনোযোগ থাকায় টেরই পায়নি তরু কখন চ্যাটিং থামিয়েছে। মোবাইল হাতে রেখে তরু, দীপনের মুখপানে পলকহীন চেয়ে আছে। দীপন অস্ফুটস্বরে বলে—

‘ছবির কম্পোজিশনটা এতো ভালো; আমি আসলে একটি ভালো ফটোগ্রাফ শেয়ার করেছি মাত্র।’

‘কিন্তু এ গুড কম্পোজিশন ছবির সাবজেক্ট— তোমার স্ত্রী। তুমি তোমার স্ত্রীকে শেয়ার করেছো?’

দীপনের মাথা হেঁট হয়ে আসে। কী উত্তর দিবে তরুকে? তরুর এ ছবির চেয়েও কামদ— বাংলাদেশের অনেক অভিনেত্রীর ‘হট পিক’ আন্তর্জালে সহজলভ্য; সেসব কোনো ছবিকে নিজের স্ত্রীর ছবি বলে, দেশের বাইরের ওই প্রাইভেট ফোরামে চালিয়ে দেয়া যেতো; কিন্তু দীপন তা করেনি।

‘তোমার নিজেকে বিকৃত মনে হচ্ছে না দীপন? নিজেকে অরুচিকর ভাবছো না? আমাকে আগলে রাখার, আমার গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলে তুমি।’ তরুর কণ্ঠে খেদ ঝরে পড়ে।

‘আমি আসলে হুট করে কিছু না ভেবেই, ছবিটি আপলোড করে দিই।’ আমতা আমতা করে দীপন।

‘হুট করে কতোদিন আগে আপলোড করেছো ছবিটি? সাত দিন? এতো দিনেও, হুট করে আপলোড করা ছবি সরিয়ে ফেলতে তোমার মনে চাইলো না?’ শীতলদৃষ্টিতে দীপনের দিকে তাকিয়ে থাকে তরু।

তরু এমন‌ই— এমন শান্তস্বরে কথার মারপ্যাঁচে ফেলবে যে সত্য না বলে উপায় থাকে না। হুট করে আপলোড করা ছবি যে অনলাইনে যত্ন করে সাতদিন পুষে রাখার কথা না, সেটা তরু বুঝে ফেলেছে। কিন্তু দীপন এখন সত্যটা বলবে কী করে তরুকে— হানিমুনের সবগুলো ছবি থেকে— বেডরুমের না, বিছানার না, সোফার না, বারান্দার না, বাথটাবের না— বাথরুমের এ ছবিটি, দীপন অত্যন্ত ধীরভাবে, শান্তমাথায়, ভেবেচিন্তে বেছে নিয়েছিলো। যাহোক, সত্যটাই বলবে ভেবে তরুর দিকে তাকাতেই দীপন দেখে, তরু আবারও মোবাইল চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আহ, তরুর প্রশ্নের উত্তর আপাততঃ দিতে হচ্ছে না দেখে দীপন হাঁপ ছাড়ে; ঘাড় ফিরিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিণে আটকে থাকা— হানিমুনে, রাতে দু’জনের মদ খেয়ে, পরদিন সকালের হ্যাঙওভারের ফসল— ওই ছবিটা আবার দেখতে থাকে।

ছবিতে, তরুর দুই হাঁটু— মাটিতে অনেকক্ষণ গেড়ে বসে থাকলে যেমন হয়— তেমন লালচে হয়ে আছে। হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত, লম্বাটে ঈষৎ বাঁকানো পা’তে— অতিক্ষুদ্র অল্প অল্প সোনালি রোম— খুউব খেয়াল করলে তবেই বোঝা যায়— ইচ্ছে করে হাত বুলিয়ে দিতে। পায়ের, প্রতিটি আঙুলই লম্বাটে, ডগাগুলো ফুলো ফুলো, লালচে ফর্সা; যেনো প্রত্যেকেই কালোজামের রস ভরপেট খেয়ে, রঙিন হয়ে, ঘুম-আলস্যে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। আঙুলের নখগুলো পরিপাটি করে ছাঁটা— দু’টো বুড়ো আঙুল এমন টসটসে হয়ে আছে; যেনো মুখে নিয়ে দাঁত দিয়ে আলতো চেপে ধরলে, টাস করে ফেটে মুখগহ্বর রসে টইটুম্বুর হয়ে যাবে। আঙুলগুলো থেকে চোখ সরিয়ে, তরুর ডান গোড়ালিতে তাকালে দেখা যায়, সেখানে অপরাজিতা ফুলসদৃশ নীল রঙের একটি নূপুর জড়িয়ে আছে— বাম গোড়ালি খালি।

ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা, পায়ে নূপুর পরার ক্ষেত্রে, মূলতঃ সৌন্দর্য্যবর্ধন ও প্রদর্শনের বিষয়টি খেয়ালে রাখলেও— পাশ্চাত্যের কিছু দেশে ‘বিবাহিত নারীদের বেলায়’, শুধু ডানপায়ে, নূপুর বা এ্যাঙ্গলেট পরার একটি গুঢ় অর্থ আছে। অর্থটি হলো‌— ওই বিবাহিত নারীটি, তার স্বামীর জ্ঞাতসারে ও উত্সাহে, অন্য ব্যক্তির সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে, যে কোনো প্রচেষ্টা, উদ্যোগ বা আহবানে, দ্বিধাহীন সাড়া দিতে উন্মুখ থাকে— এক পায়ে নূপুর আমার, অন্য পা খালি …

কিন্তু দীপন খুঁজেপেতেও, তরুর নূপুর পরা ছবি, দু’টির বেশি পায়নি। এমনিতে, তরু নিজের ছবি তুলতে বেশ পছন্দ করে— নার্সিসিস্ট বলা যেতে পারে— ফেসবুকে তরুর সেলফিগুলোতে, সবাই ‘লাভ’ বেশি, ‘লাইক’ রিঅ্যাক্ট কম দেয়। এতে দীপনের ভালোই লাগে— এমন অপরূপা বউ ক’জনের ভাগ্যে জুটে! তরুর মুখশ্রী অপূর্ব— দীঘল কুন্তল, পদ্ম ললাট, আয়ত নেত্র, টিকালো নাসিকা, প্রশস্ত কপোল, রক্তিম চঞ্চু, শুভ্র দন্ত, লাস্যময় হাস্য— যতো প্রশংসা সে তরুর উদ্দেশ্যে শোনে, ততোই তরুর প্রতি প্রেম-ভালোবাসা বেড়ে যায়। তরুর কারণে, বন্ধুদের ও পরিচিতজনদের ঈর্ষা, দীপনের অহংবোধকে প্রচণ্ড তাতিয়ে রাখে; আর এ অহংবোধ থেকেই এক অদ্ভুত অভিপ্রায়, মাথাপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় দীপনের— তরু বাইরে এতো শোভাময়, অথচ পোশাকের অন্তরালের, রমণীয় তরুর সন্ধান তো কেউ পেলো না!

খট করে শব্দ হওয়ায় দীপনের ভাবনায় ছেদ পড়ে— চেয়ে দেখে, তরু টেবিলের কোণায় মোবাইল রেখে, পায়ের উপর পা তুলে, পিঠটান করে সোজা হয়ে বসে, দীপনের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; তরুর চোখে চোখ রাখতে আড়ষ্ট হচ্ছে দীপন, সেটি থেকে মুক্তি দিতেই বোধহয় তরু মুখ খুললো—

‘এ‌বার বলো দীপন, আমার ছবিটি দেখে কী কী মন্তব্য এলো?’

দীপন মিনমিন করে বললো— ‘কী বলবো, সবাই তোমার সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করেছে।’

‘কীরকম প্রশংসা করেছে? খুলে বলো দীপন।’

‘ওই যে … ছবিতে তোমার চাপা হাসি, নাক, ঠোঁট … ‘’

‘… আমার উদোম উরু, আমার স্তন পছন্দ করেনি কেউ?’ দীপনকে থামায় তরু— পা দু’টো আগের মতো একটির উপর আরেকটি রেখে, এবার হাঁটুর উপর কনুই এনে, হাতের তালুতে থুতনি ঠেকিয়ে, আঙুলগুলো গালে চেপে, মুখ এগিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে তরু; তার স্লিভলেস ম্যাজেণ্ডা রঙের নাইটির ফাঁক দিয়ে স্তন-বিভাজিকার আভাস পাওয়া যায়। তরু বলতে থাকে—

‘যদিও ছবিতে আমার স্তনের গড়ন ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না।’ তরুর কণ্ঠে হতাশা ঝরে— ‘তুমি বললে, ছবি তোলার সময় বাথরোবটা আমি নামিয়ে দিতে পারতাম, দীপন।’

তরুর চালাকি বুঝতে পেরে মৃদু অপদস্থ বোধ করে দীপন। তরুর কণ্ঠস্বর কোমল; কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না, কটু কথা বলে না, কিন্তু তরু বাকপটু— সপ্তাহান্তে মশিউল ভাইদের নিয়মিত সাহিত্য আড্ডার পাঠচক্র থেকেই, তরুর বাগ্মীতার অভ্যেস গড়ে উঠেছে বলে দীপনের ধারণা। কথার মারপ্যাঁচে, কাউকে বিব্রত করতে হলে, এমন নম্রভাবে খেলিয়ে তাকে ডাঙায় তুলবে যে একদম টেরই পাবে না— তবে দীপনের বেলায় যেনো একটু সরাসরিই আক্রমণ করে তরু। সেবার তরুর জন্মদিনে, ফেসবুকে ওর ছবির নীচে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েক ছত্র টাইপ করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলো দীপন— প্রতিমন্তব্যে তরু লিখেছিলো— ‘অন্যের জিনিস তো আমি নিজেই ধার নিতে পারি, পারলে তুমি নিজে কিছু লিখে দেখাও’। তরুর ওই কমেন্টে সবাই হাহা রিঅ্যাক্ট দিয়েছিলো; দীপনও দিয়েছে— মনোঃকষ্ট হলেও, ফেসবুকের মতো পাবলিক স্ফিয়ারে— স্বামীপ্রবরকে হিউমিলিয়েশন‌— তরুকে প্রচণ্ড ভালোবাসে বলেই, বিষয়টা ভুলতে সময় নেয়নি— দীপন এটিকে তরুর সোজাসাপ্টা সরলতা ভেবে উপভোগই করেছিলো।

দীপন যখন এসব ভাবছে, তরু তাকিয়ে আছে দীপনের দিকে— হাতে আবারও মোবাইল উঠে এসেছে। তরুর দিকে তাকিয়ে দীপন কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

‘দীপন চুপ করে থেকো না। আমাকে বলো, আর কী কী কমেন্ট এসেছে আমার ছবিতে।’

দীপন ধারণা করতে পারছে না— সে এখন যা বলবে তা তরু সহ্য করতে পারবে কিনা— কিন্তু ওই বিশেষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে, নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুঝেছে; হিমালয়সম তরুপ্রীতি নিয়ে, দিনরাত অস্থির থেকেছে।

বড় করে শ্বাস নিয়ে দীপন বলেই ফেললো— ‘সবাই তোমাকে ন্যুড দেখতে চেয়েছে তরু। তোমার পরের ছবিটি যেন ফুল-ন্যুড আপলোড করি সেই অনুরোধ বারবার করেছে।’

‘ওয়াও, তুমিও কি চাও আমার ন্যুড ছবি আপলোড করতে?’ তরুর কণ্ঠে শ্লেষ ঝরে পড়ে।

‘তোমার কোনো ন্যুড ছবি নেই আমার কাছে।’ দীপন সহজ স্বীকারোক্তি দেয়।

‘থাকলে আপলোড করতে?’ তরুর চোখ ছলছল করে উঠে।

‘আমি জানি না। তবে তোমার যোনীদেশ দেখতে না পেয়ে, হতাশা প্রকাশ করেছে সবাই।’

তরুর চোয়াল ঝুলে গেলো দীপনের কথা শুনে— এ কোন অচেনা দীপন বসে আছে তার সামনে! বিস্মিত হলেও, নিজেকে কোনোভাবে শক্ত রেখে জিজ্ঞেস করে তরু— ‘আর কিছু?’

‘তোমাকে কাছে পেলে, কীভাবে সঙ্গম করবে, সে বর্ণনা দিয়েছে অনেকে।’ দীপনের যে কী হলো নিজেই বুঝছে না, গড়গড় করে সব বলে দিচ্ছে।

‘তোমার ভালো লেগেছে সেসব বর্ণনা পড়তে?’ তরু ভাঙা গলায় জানতে চায়।

দীপন কথা বলে না, চুপ থাকে; তরুর চোখ চিকচিক করছে, জানতে চায়— ‘আমাকে সামনাসামনি দেখতে চায়নি কেউই?’

‘চেয়েছিলো, কিন্তু ওরা তো দেশের বাইরে থাকে। কীভাবে সম্ভব?’

‘আহা, আশাহত হলে তুমি?’ তরু অবিশ্বাসের চোখে দীপনকে মাপে। দীপন চুপ থাকে; তরু আর কিছু জিজ্ঞেস না করে, ফের মোবাইলে টাইপ করতে শুরু করে। এবার দীপনের মেজাজ খারাপ হলো— এ পরিস্থিতিতে এতো কীসের চ্যাটিং, কার সাথে চ্যাটিং? কিন্তু মেজাজ খারাপ হলেও, পরমুহুর্তেই দীপন নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো; তরুর উপর সে কোনোদিন রাগেনি— সে প্রবৃত্তিই দীপনের নেই— ভবিষ্যতেও রাগতে পারবে না; তরুকে এতোটাই ভালোবাসে যে তার কোনো ইচ্ছেতেই কখনো বাধ সাধেনি।

দীপন সিদ্ধান্ত নিলো, তরুকে স্যরি বলবে— তার মনে তরুকে হারানোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তরুকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনোরুপ মানসিকতা দীপনের কোনোকালেই ছিলো না, কিন্তু এক্ষেত্রে জোর করবে যেনো তরু কখনোই দীপনকে ছেড়ে না যায়— যে শাস্তিই দিক, মাথা পেতে নিয়ে— তরুর ভালোবাসায় নিয়ন্ত্রিত হয়ে— তরু আর অন্তকে নিয়ে সামনের দিনগুলো একসাথে কাটাতে চায় সে; তরুকে পাশে রাখতে যে কোনো ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত থাকবে দীপন— এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে মাথা উঁচু করতেই দেখে, তরু অপলক চেয়ে আছে তার দিকে। দীপনের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো; তরু কি তার মনের কথাগুলো পড়ে ফেলছে? পড়ুক, তরুকে প্রাণাধিক ভালোবাসে বলেই তো এসব ভাবতে পারলো দীপন— সাহস সঞ্চয় করে, গলাখাঁকারি দিয়ে দীপন বলে—

‘আমি খুবই দুঃখিত তরু। আমাকে ক্ষমা করে দাও। ওই ছবি আমি এখনই ডিলিট করে দিচ্ছি।’

‘খবরদার।’ তরু হিসহিসিয়ে উঠে। ‘ক্ষমা? এতো সহজে তুমি ক্ষমা পাবে মনে করেছো?’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি তরু। প্লিজ আমাকে সুযোগ দাও আরেকবার।’ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় দীপন।

‘তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে দীপন।’ শান্ত অথচ প্রচণ্ড রাগী লাগছে তরুকে।

‘সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো।’ মিনতি করে দীপন। ‘অন্ত-র কসম কেটে বলছি, তোমার কোনো সিদ্ধান্তেই আমি না করবো না।’

বলেই দীপন চেয়ার ছেড়ে উঠে তরুর পা জড়িয়ে বসে পড়ে। তরু ঝাঁকি দিয়ে পা ছাড়াতে যাবে, তখনই পাশের রুমে অন্ত কেঁদে উঠে। দীপনকে পা দিয়ে ঠেলে উঠে দাঁড়ায় তরু— দীপন ফ্লোরে বসে যায়— ক্রুদ্ধ চাপাকণ্ঠে তরু বলে—

‘বসে থাকো, অন্তকে ঘুম পাড়িয়ে আসছি। আজকেই তোমার সাথে বোঝাপড়া শেষ করতে হবে।’

দীপনকে ফ্লোরে ওই অবস্থায় রেখে, অন্ত’র রুমের দিকে দু’পা এগিয়েই, তরু আবার ফিরে এসে টেবিলে মোবাইল রেখে, ফের অন্ত’র রুমের দিকে চলে যায়— চোখের পলকে তড়িৎ গতিতে কাজটি করে তরু। তরুর লাথি খেয়ে লজ্জিত না হলেও, বিস্ফোরিত নয়নে তরুর গমনপথে অবাক তাকিয়ে থাকে দীপন— তরু মোবাইল রেখে গেছে; এও কী সম্ভব! ফ্লোর থেকে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় দীপন।

প্রতিরাতে, ঠিক এ সময়টিতে জেগে উঠে অন্ত— তরু তখন কোলে নিয়ে ৫ মিনিট হাঁটলেই, অন্ত ক্যাঁ কুঁ করে আবার ঘুমিয়ে যায়, সেসময়েও তরুর হাতে মোবাইল থাকে। অন্ত’র জেগে উঠা, দীপনের জন্য ঘুমোতে যাওয়ার সংকেত— সুপারশপ থেকে ফিরে, ল্যাপটপে ব্রাউজিং কিংবা টিভিতে নেটফ্লিক্স দেখে অপেক্ষা করতে থাকে কখন অন্ত কেঁদে উঠবে, দীপন ঘুমোতে যাবে।

কিন্তু মোবাইল রেখে যাওয়ার মতো মহাভুল তো তরুর করার কথা না! দুষ্টুবুদ্ধি চাড়া দিলো দীপনের মাথায়— দেখবে নাকি তরু এতোক্ষণ কার সাথে চ্যাট করছিলো? নাহ, থাক, অন্যের প্রাইভেসিতে ঢোকা ঠিক হবে না— দীপন নিজেকে সামলে নিতে চাইলেও, এক অজানা রহস্য উদঘাটনের প্রলোভনে, প্রলুব্ধ হতে থাকে দীপন— সকল প্রকার বিধিনিষেধ ভাঙতে ইচ্ছে করছে আজ। তরুর প্রাইভেসির সর্বনাশ তো দীপন করেই ফেলেছে ছবি আপলোড করে, শাস্তি যা পাওয়ার তাতো পাবেই, অনুমতি না নিয়ে মোবাইল দেখার শাস্তিতে আর কীই-বা যোগ হবে। মাত্র কয়েক মিনিট সময়— অন্ত ঘুমিয়ে গেলেই তরু ফিরে আসবে; তরুর মোবাইল ঘেঁটে কিছু দেখতে চাইলে এখনই উপযুক্ত সময়।

ভীরু হৃদয়ে, কম্পিত হাতে, তরুর মোবাইল তুলে নেয় দীপন— জানে, পাসওয়ার্ড নেই— স্ক্রিণে ডাবলটাচ করতেই, ডিসপ্লে আলোকিত হয়ে উঠে— একটি হোয়াটসআপ চ্যাটবক্স ওপেন করা— মেসেজের নীচে টাইমিং দেখে বোঝা যাচ্ছে, এখানেই এতোক্ষণ চ্যাট করছিলো তরু।

অন্ত’র কান্না ক্ষীণ শোনাচ্ছে, সময় খুবই কম। দীপন অতিদ্রুত স্ক্রল করতে করতে— একদম শুরু থেকে পড়ার জন্য— চ্যাটবক্সের উপরে উঠতে থাকে। দীপনের বুক ধুকপুক করছে— বুঝতে পারছে যে, এ চ্যাটিং শুধু আজকের রাতের না, দীর্ঘদিনের ইতিহাস— উত্তেজনায় দীপনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে— চ্যাটবক্সের মেসেজ পড়া বাদ দিয়ে, দীপন দেখতে চাইলো কোন ব্যক্তির সাথে চ্যাট হচ্ছিলো— দেখলো, Wolf নামে সেভ করা আছে কন্ট্যাক্টটা। ভিউ কন্ট্যাক্টে গিয়ে নম্বরটি চিনতে পারলো না দীপন— এ যুগে মোবাইল নম্বর কে মনে রাখে? কিন্তু চকিতে একটি উপায় ভাবলো দীপন— মোবাইল নম্বরের শেষের চার ডিজিট 8760— অতিদ্রুত নিজের মোবাইলের কী-প্যাডে টাইপ করতেই, কললিস্টের একটি নাম সাজেশন হিসেবে উঠে এলো— মশিউল ভাই।

মশিউল আলম— দীপন-তরুর সামাজিক বড়ভাই, বন্ধু। বিয়ের পরপরই, অপরিচিত দু’জনের পছন্দ-অপছন্দের সমঝোতা, রুচির তারতম্য, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ইত্যাদি নিয়ে সংসার জীবনের প্রথমদিকে তরু প্রায়ই অসন্তুষ্ট থাকতো; মশিউল সেসব শুনে দু’জনের মাঝে আপস করে দিয়েছিলেন। ওইসময়েই, দীপনের জন্য সুপারশপের নাইট-শিফটের চাকরিটিও তিনি যোগাড় করে দেন। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী কিন্তু সাহিত্যরসিক, সঙ্গীতপিয়াসু, মিষ্টভাষী মশিউল, সপ্তাহের ছুটির দিনে সাহিত্য আড্ডা আয়োজন করেন, যেখানে তরু নিয়মিত অংশ নেয়— সেই মশিউল আলমের নাম, তরু মোবাইলে Wolf নামে সেভ করবে কেনো?

মশিউল! … মশিউলফ! … উলফ? … উফ্‌!

দীপনের মনে পড়ে— মশিউল একদিন বাসায় এলে, আড্ডার ফাঁকে হানিমুনের ছবিগুলো তাকে দেখিয়েছিলো দীপন। আইপ্যাডে ছবিগুলো দেখাতে গিয়ে, তরুর বাথরুমের ওই ছবিটি, দীপনের বেখেয়ালে স্ক্রিণে চলে আসে। তখনই মাথায় দুষ্টুমি চাপে— মশিউলকে বিব্রত করতে, দীপন অনেকক্ষণ ছবিটি ধরে রেখেছিলো মশিউলের চোখের সামনে; যেনো সুপারশপের চাকরি ও সংসার টিকিয়ে দেয়ার প্রতিদান দিচ্ছে দীপন— আর মিটিমিটি হেসে আড়চোখে মশিউলের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছিলো।

অন্ত’র কান্না এখন শোনা যাচ্ছে না— কতোক্ষণ সময় গেলো? ৫ মিনিট হয়ে গেছে? তরু ফিরে আসতে পারে যে কোনো মুহুর্তে। কোনো মেসেজই ঠিকমতো পড়তে না পেরে, দীপন অতিদ্রুত স্ক্রল করে হোয়াটসআপ চ্যাটবক্সের একদম নীচে চলে এলো—শেষ দুটো মেসেজ কোনোমতে পড়তে পারলো দীপন—

Toru : Anyway, my RIGHT TIME has come to make him FULLY READY.

Wolf : Hahaha. For him, I will gift you a pair of horns.

ভ্যাবাচাকা খায় দীপন— মেসেজ পড়ে কিছুই বুঝতে পারে না— কিন্তু হুট করে একটা চিন্তা মাথায় এলো তার— ছবিটা যে সাতদিন আগে আপলোড করেছিলো দীপন, তা তরু বুঝলো কী করে!

১৭ জুলাই ২০২২।। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড

 

 

Advertisement