ঋণ খেলাপীদের বিচার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হোক

:ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী:

সম্ভবত গত ২২ তারিখের যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম ছিল ঋণ খেলাপি। এর খবরটির শিরোনাম ছিলো“শীর্ষ ১শ ঋণখেলাপির তালিকা,২১ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত, রাঘববোয়ালরা নেই তালিকায়, খেলাপির বিপরীতে আদালতের স্থগিতাদেশ,ব্যাংকাররা বলছেন প্রভাবশালীদের কাছে তারা অসহায়, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বিচারের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।

খবরটি আসলে আমরা যত সহজে পড়ছি ঠিক তত সহজ নয়। এটা শুধুমাত্ৰ একটি দুঃসংবাদ ও নয় বরং বিশ্লেষণ করলে এটি একটি মারাত্মক এবং ভয়ানক খবর।

যদিও আমরা শুনতে শুনতে খুবই অভ্যস্ত হয়ে গেছি আর সেজন্য বোধ হয় আমাদের মনে আর এরকম কোন খবর তেমন দাগ কাটেনা।

খবরটির শিরোনামের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় বিশ্লেষণ যোগ্য।

প্রথমত বলা হয়েছে, ১০০ ঋণ গ্রহীতার কাছে খেলাপি ঋণের পরিমান ২১ হাজার কোটি টাকা আর খবরের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমান ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। প্রিয় পাঠক একটু চিন্তা করুন ৮০ হাজার কোটি টাকা ঠিক কত টাকা? আর বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি কি এই দখল সামলে উঠা কি খুব সহজ? এখানে আরেকটি বিষয় সন্নিবেশিত করা হয়েছে, “রাঘব বোয়ালরা বাহিরে। ” অর্থাৎ তাদেরকে ইচ্ছা করে বাহিরে রাখা হয়েছে আর যে কারণেই হোক তাদের নাম এই লিস্টে এখনো আসে নাই। প্রশ্ন হলো তাদের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমান কত? উত্তরটা খুব সহজ ৬০ হাজার কোটি টাকা।
দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে খেলাপি ঋণ তুলতে গিয়ে বাধা হলো আদালতের নিষেধাজ্ঞা। অর্থাৎ এখানে পরিষ্কার ভাবে প্রতীয়মান যে আইনের দুর্বলতা রয়েছে। তৃতীয়ত ব্যংকাররা বলছেন প্রভাবশালীদের কাছে তারা অসহায়। বিশেষ আদালতের মাধ্যমে এদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার আহবান করেছেন। এখানে আরো উল্লেখ করার মতো হলো বেশিরভাগ খেলাপি ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে সরকারি ব্যংক গুলো।


এই খেলাপি ঋণ আর পরিমান শুনে সত্যি গা শিউরে উঠে। আমার মনে আমার সাথে আপনারা একমত হবেন এই খেলাপিরাই দেশের অর্থিনীতির গলাটিপে ধরে আছে। এরা দেশের উন্নয়ন চালিকার প্রধান প্রতিবন্দ্বক। কারণ এই তালিকাভুক্ত ১০০ জনের টাকা দিয়ে আমরা আরেকটি পদ্মা সেতু বানাতে পারি। আর সর্বোপরি এই খবর আমাদের ব্যংকিং খাতের ভয়ানক এক অস্থিরতার চিত্র তুলে ধরেছে। ব্যংকিং খাত হলো অর্থনীতির চালিকার মূল শক্তি আর এই খাত যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে এর প্রভাব পড়বে ঘোটা অর্থনীতির উপর। আর এর নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণ।
এখন দেখা যাক এই ঋণ খেলাপি কারা? আর দৌরাত্মই কতটুকু?
আসলে ঋণ খেলাপিরা হলেন, সাধারণত সমাজের খুব উঁচু শ্রেণীর লোক। ভীষণ ক্ষমতাধর। সরকার ও ভয় পায়। কারণ প্রায় সকল সরকারের মধ্যেই তাদের বসবাস। তারা রাজনীতির নামে সরকারকে মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আর এ জন্যই সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু তাদের পরিবর্তন হয়না। এরা ঠিকে থাকে যুগের পর যুগ। এদের কোন নীতি কিংবা আদর্শ নাই। অর্থই হলো এদের নীতি কিংবা আদর্শ অথচ এরাই আবার গরীবের বন্ধু, দানবীর, আইন প্রণেতা, ভোটের মাঠের তারকা। জনগণের কাছে ও তারা প্রচন্ড ভাবে গ্রহণযোগ্য, আস্থাবান, নিষ্টাবান কিংবা দ্বায়িত্বশীল। ভাবতে অবাক লাগে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে সেই টাকা জনগণের মধ্যে বিতরণ করে তারা হয় দানবীর। কেউই তাদের বিরুদ্বে বলেনা। জনগণের মতো মিডিয়া হাউস গুলো ও চুপ। কারণ অধিকাংশ মিডিয়া গুলো তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবেই চলে যায় দিনের পর দিন।

নির্বাচন এলে ব্যংকে কিছু টাকা দিয়ে তাদের খেলাপি ঋণ নবায়ন করে, এই শেষ। কারণ আইনের ফাঁকফোকর তাদের খুব ভালো করে জানা। জনগণ ও তাদের সাদরে গ্রহণ করে।
এই খেলাপিদের তালিকা একদিনে তৈরী হয়নি।

দিনের পর দিন সরকারি ছত্র ছায়ায় এরা লালিত এবং পালিত। যে কারণে এদের সাহস এখন দুঃসাহসে পরিণত হয়েছে। এরা ধরে নিয়েছে ব্যংক থেকে টাকা নিলে আর পরিশোধ করতে হবে না। খেলাপি ঋণের নামে যুগ যুগ ধরে ব্যংক নিঃস্ব করার প্রতিযোগিতা কি কখনো বন্দ্ব হবে না? তাই এই ঋণ খেলাপিদের দৌরাত্ম যদি এই মুহূর্তে বন্দ্ব করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে অর্থিনীতির জন্য এক মারাত্মক এবং ভয়ানক ব্যধি আকারে প্রকাশ পাবে। যা রাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
আমি বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বদিচ্ছা এবং সাহস রয়েছে। অনেক অসাধ্যকে ও তিনি সাধ্য করেছেন। দেশ গঠন এবং উন্নয়নে তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

কিন্তু উনার সকল অর্জন এই হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের জন্য বিসর্জন হতে চলেছে। রাজনীতি কিংবা পেশিশক্তি দিয়ে দেশের অর্থনীতির গলাটিপে যারা ধরে রেখেছে তাদের বিরুদ্বে একমাত্ৰ মাননীয় প্রধামন্ত্রী পারেন ব্যবস্তা নিতে। এতিমদের টাকা আত্মসাত করার বিচার যদি বক্শিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে প্রকাশ্যে করা যায়, তাহলে দেশের টাকা লুন্টনকারীদের বিচার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে করা যাবেনা কেন? আর সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিনীত অনুরোধ, এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসুন, আইন সংশোধন করে এদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন।

লেখক:ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
প্রিন্সিপাল সলিসিটার,কেসি সলিসিটর্স,ইউকে,
পরিচালক,সেন্টারফরব্রিটিশ-বাংলাদেশীপলিসি ডায়ালগ
সাবেক সাধারণ সম্পাদকওসহসভাপতি দি সোসাইটি অব ব্রিটিশ-বাংলাদেশী সলিসিটর্স

Advertisement