করোনা ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি ও পার্শ্ববর্তী দেশের রাজনীতি

॥ ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব ॥

গত কিছুদিনের বেশ কিছু ঘটনা জনমনে খুব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। কুরবানী ঈদের আগের রাতে অবসর প্রাপ্ত মেজর রাশেদ মোহাম্মদ সিনহার হত্যা কান্ড, যা কিনা সেনাবাহিনীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি ঘটনা। বাংলাদেশ ইতিহাসে পুলিশ কর্তৃক কোন সেনা কর্মকর্তার এটি প্রথম হত্যা কান্ড। অন্যদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রীমতী রীভা গাঙ্গুলি দাশ বার বার চেষ্টা করেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষাৎ না পাওয়া যেন দিল্লিকে ভাবিয়ে তুলছে। পাশাপাশি চায়না কর্তৃক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার জন্মদিন ১৫ই আগস্টে শুভেচ্ছা প্রেরণ করা, আবার নেপাল কর্তৃক ভারতীয় সীমান্ত ঘেসে হেলিপ্যাড তৈরী করা, অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে আলাপ; ঠিক একই মুহূর্তে চায়না ও পাকিস্তানের উর্ধতন কর্তা ব্যাক্তিদের বৈঠক যেন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে।

চায়না ও বাংলাদেশের বর্তমানকার সম্পর্ক যেকোনো সময়ের চেয়ে খুবই ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে। চায়না যেমন একদিকে বাংলাদেশে বাণিজ্যের সম্প্রসার করছে অন্য দিকে বাংলাদেশকেও বাণিজ্য সম্প্রসারণে সুযোগ দিচ্ছে। চায়না বাংলাদেশের ৮২৫৬টি পণ্য বিনা শুল্কে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে, পদ্মা সেতুতে অর্থলগ্নি, সিলেটের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর উন্নয়নে অর্থ প্রদান বা পার্টনারশীপ গ্রহণ, পায়রা সমুদ্র বন্দর ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ, বরিশাল ও ভোলার মধ্যে ১০ কিঃমিঃ রাস্তা তৈরী ইত্যাদি। এ ছাড়াও ছোট বড় অনেক প্রকল্পে বাংলাদেশে আর্থিক সহায়তা প্রদান ও করোনাকালীন সময়েও ইকুইপমেন্ট ও মেডিকেল টীম দিয়ে সহায়তা দিল্লিকে যেন চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দিল্লি ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশ যেন তাদের হাতের কব্জা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যার সাথে দিল্লির কোনো রকম একতরফা নাম মাত্র বন্ধুত্ব আছে। ভারতের সীমান্তবর্তী দেশ যেমন পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চীন এমনকি দ্বীপদেশ শ্রীলংকাসহ কোনো দেশের সাথেই তাদের কোনো বন্ধুত্ব সম্পর্ক নেই, রয়েছে বৈরী সম্পর্ক, ইতিহাস এর সাক্ষী।

থাক সে কথা, ফিরে যাই আমাদের আজকের আলোচনায়। গত মঙ্গলবার হটাৎ করেই অনেকটা কোনো কিছু না জানিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীঙ্লা দিল্লী সরকারের গোপন বার্তা নিয়ে দ্বিতীয় বারেরমতো বাংলাদেশে এক ঝটিকা সফরে আসেন। যদিও দিল্লির বরাত দিয়ে এই সফরকে করোনা ভ্যাকসিনের সফর বলা হয়েছে। দিল্লি দাবি করছে তারা বন্ধু প্রতিম বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন প্রদান করবে। আসলেই কি তারা ভ্যাকসিন প্রদান করতে পারবে? বাস্তবতা কি বলে? আসুন একটু রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন উৎপাদন ও প্রেক্ষাপট দেখে নেই।

ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনিকার সহযোগিতায় গড়ে ওঠা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন ট্রায়াল ট্রায়েলের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে ভারত তার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশও অ্যাস্ট্রাজেনিকাকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশে তার ট্রায়াল পরিচালনার জন্য। পাশাপাশি ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটও এই সপ্তাহে ভারতে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করতে চাচ্ছে।

ভারত মূলত রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় করবে, পরে তা তাদের নিজের দেশে সরবরাহ করে অন্যান্য দেশেও রপ্তানি করতে চাচ্ছে। দিল্লির এই চাওয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা বিবেচনার ভার সচতেন মহলের উপর রইলো। যে ২০টি দেশ রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় করতে চাচ্ছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম। অপরদিকে রাশিয়া ইতিমধ্যে দাবি করেছে যে তারা বিশ্বের প্রথম COVID-19 ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিয়েছে, দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন মাত্র ৭৬ জনের মধ্যে পরীক্ষা করেই তা সফল বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনের দিকে হাটছে।

তবে রাশিয়ার উৎপাদিত ভ্যাকসিন নিয়ে ইতিমধ্যে নানান কথা শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী, কারণ কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কী পরীক্ষার মাধ্যমে ভ্যাকসিন উৎপাদন করেছে তার কোনো পরিষ্কার জবাব মস্কো এখনো পর্যন্ত দেয় নি। জাতিসংঘও তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনকে এখনো পর্যন্ত অনুমোদন করেনি। মস্কোর উৎপাদিত ভ্যাকসিন আদৌ নিরাপদ কি-না, এ নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সংশয়।

বিজ্ঞানীরা সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে রাশিয়ার দিকে। কেননা তারা এতো তাড়িতাড়ি করে কি ভাবে ভ্যাকসিন তৈরী করলো, যেখানে এই ভ্যাকসিন তৈরির কোলা কৌশল, মেথডোলজি ও এর উৎপাদন প্রক্রিয়া কোথাও প্রকাশ করা হয়নি । বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা তাৎক্ষণিকভাবে মস্কোর গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি দ্বারা নির্মিত এই ভ্যাকসিনকে অচল এবং অনুপযুক্ত বলে নিন্দা করেছেন, কারণ গামালিয়া ভ্যাকসিন এখনও একটি পরীক্ষাও শেষ করতে পারেনি এবং এখনো পর্যন্ত তারা প্রমান করতে পারেনি যে এই ভ্যাকসিন বিশাল গোষ্ঠীর লোকেদের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর। এছাড়াও রাশিয়ার দিকে রয়েছে ভ্যাকসিন উৎপাদনের গবেষণা লব্ধ তথ্য উপাত্ত হ্যাক করার অভিযোগ।

মস্কোর উৎপাদিত ভ্যাকসিন নিয়ে খোদ রাশিয়াতেই সমালোচনার ঝড় বইছে। এমনকি রাশিয়ার কেউ কেউ এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জও করেছে। রাশিয়ার ক্লিনিকাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান, আইনজীবী স্বেতলানা জাভিদোভা (Svetlana Zavidova) মস্কোর উৎপাদিত ভ্যাকসিনকে “এটি হাস্যকর” বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেন – “আমি আমাদের দেশের জন্য কেবল লজ্জা বোধ করি।” আর তাই পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ না করে, মান যাচাই না করে হটাৎ করে ভ্যাকসিন উৎপাদন বাজারজাত করণকে স্থগিতের জন্য সে একটি আবেদন করেছেন। Council on Foreign Relation-গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামের ডিরেক্টর টমাস বোলকি বলেছেন, “রাশিয়া যে পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন উৎপাদন করেছে, নিশ্চিতভাবেই এ ক্ষেত্রে শর্টকাট পথ বেছে নেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও বলেছেন যে “ভ্যাকসিন তৈরি করা কোন কঠিন কাজ নয়। বরং ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং কার্যকর তা প্রমাণ করা বড় বেশী কঠিন কাজ। যদিও প্রেসিডেন্ট পুতিন জোর দিয়ে বলছেন যে প্রয়জনীয় সমস্ত পদক্ষেপ ও পরীক্ষা উত্তরণের মধ্য দিয়ে এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয়েছে।

কেন রাশিয়ার এত তারা করে ভ্যাকসিন উৎপাদনের চেষ্টা? এর উত্তর পাওয়া যায় আমেরিকার জর্জিটাউন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ আইন বিভাগের অধ্যাপক লরেন্স গোস্টিন কথা থেকে। তিনি বলেছেন, “আমি কখনই চিকিত্সা পণ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা এতটা তীব্র হতে দেখিনি।” “কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনটি এ জাতীয় রাজনৈতিক প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করার কারণটি হ’ল পরাশক্তিরা ভ্যাকসিনটিকে তাদের বৈজ্ঞানিক দক্ষতা হিসাবে দেখছেন এবং বাস্তবে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিকে উচ্চতর হিসাবে বৈধ করেছেন।” মূলত পরাশক্তিগুলো নিজ নিজ ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ও অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবেই ভ্যাকসিন উৎপাদনকে বেছে নিয়েছে। যারা সর্ব প্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে তারাই সবচেয়ে বেশী লাভবান হবেন, আর এই লাভের জন্যই সবাই দৌড়াচ্ছে । World Health Organisation এর মতে চায়না, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি ভ্যাকসিন উৎপাদনের দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে।

যেই মস্কোর উৎপাদিত ভ্যাকসিন নিয়ে এতো কথা, সেই রাশিয়া থেকেই ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য ভারত প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভারত আবার সেই ভ্যাকসিন বাংলাদেশেও রপ্তানি করতে চায়। অন্যদিকে ভারতের নিজস্ব কোম্পানি যেমন Serum Institute of India, Bharat Biotech এবং Zydus Cadila প্রতিনিধিরা সরকারের সাথে দেখা করে তাঁদের ভ্যাকসিন উৎপাদনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা যদি ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে তাহলে অপেক্ষা কৃত কমমূল্যে বাজারজাত করতে পারবে।

CEO of Russia’s sovereign wealth fund Kirill Dmitriev বলেছে যে, মস্কো চায় স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন ভারতে উৎপাদিত হোক। মিঃ দিমিত্রিভ ঐ লোক যিনি মস্কোর স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন উৎপাদনের সমুদয় অর্থ যোগান দিয়েছে। আর এজন্যই রাশিয়া ভ্যাকসিন তৈরী করবে এবং তা কম মূল্যে উৎপাদিত হবে ভারতে। এর মধ্য দিয়ে দিল্লি চাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যাকসিন বাণিজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য নিতে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীঙ্লা বর্তমান সফরকে যদি আমরা ভ্যাকসিন সফর হিসাবে ধরে নেই, তাহলে আমরা দেখতে পারবো যে ভারতের কৌশল হল রাশিয়ায় উৎপাদিত পর্যাপ্ত পরীক্ষা বিহীন, মান নিয়ন্ত্রনহীন একটি ভ্যাকসিন বাংলাদেশে বাজারজাত করা।

সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ ভারত যার চার পাশের সবগুলো দেশই প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে শত্রু রাষ্ট্র, সেই দেশ মরণ ব্যাধি করোনা নিয়েও রাজনীতি করতেও দ্বিধা করছে না, আর তাদের রাজনীতির একমাত্র ইস্যু হলো বাংলাদেশ। কেননা বাংলাদেশকে তারা চায় একটি বাজার বানাতে, যেখান থেকে তারা আয় করবে বিনা শুল্কে বিলিয়ন ডলার।

পত্রিকার মাধ্যমে আরও জানা যায়, হর্ষ বর্ধন শ্রীঙ্লার সফরের মূল লক্ষ্য ভ্যাকসিন ছিল না, বরং বাংলাদেশের নিরাপত্তার উপর আরো বেশি কিভাবে করায়ত্ত আরোপ করা যায়, সেটি ছিল তার সফরের একটি অন্যতম আলোচনা।ভারত যেখানে তাদের নিজ দেশের জনগণের মাঝে ভ্যাকসিন পৌঁছাতে পারে কিনা তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ঠ দ্বিধা ও সংশয়, সেখানে দুই পা আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রদান করার ভারতীয় স্বপ্ন যেন বাঙালিকে হাই কোর্ট দেখানোর মতো।

ভারত অনেক বড় একটি দেশ। যার জনসংখ্যা প্রায় ১২০ কোটিরও বেশী, অধিকাংশ জনসংখ্যা দারিদ্র সীমা বা এর চেয়েও নিচে বাস করে বলে ধরা হয়। তাদের জীবনযাত্রার মান ও আর্থসামাজিক অবস্থা সূচকের অনেক নিচে। এমন একটি দেশ যদি ভ্যাকসিন মস্কোর কাছ থেকে পায়ও বা উৎপাদন করতে সক্ষমও হয়, তখন দিল্লির প্রথম কাজ হবে তার নিজের দেশের চাহিদা আগে পূরণ করা, কোনো অবস্থাতেই নিজের দেশের চিহিদা পূরণ না করে অন্য দেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি করার কোনো উদ্যোগ মোদী সরকার নিবে না; এটিই বাস্তব। তাহলে দিল্লি সরকার কি আসলেই বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে পারবে? সত্যিকার অর্থে কি রপ্তানি করতে চাচ্ছে ভারত?

©️ লেখকঃ ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস।

Advertisement