পান্তা দিয়ে কিশোয়ারের বিশ্ব জয়

।। হিমিকা আযাদ ।।

সব বিপ্লবে বন্দুক লাগেনারে মমিন!
হুমায়ূন আহমেদের “বাংলাদেশ নাইট” গল্পের মিজানের মত করে থম মেরে বলতে ইচ্ছা করছে-
“দেখ শালা বাংলাদেশ কি জিনিস। শালা দেখে যা”……

পান্তা ভাত, আলুভর্তা আর মাছভাজি যে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালের দ্বোরগোড়ায় দেখতে পাব এটা যেন আচমকা স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন শুধু নয় দু:স্বপ্নের কল্পনাতেও কখনো ভাবা যায়না। ফলাফল বলছে কিশোয়ার দ্বিতীয় রানার-আপ হয়েছেন, কিন্তু তিনি যা অর্জন করেছেন তার তুলনায় ওরকম দশটা মাস্টারশেফ পুরষ্কারও কিছুই না।চোখে পানি ছলছল ! এ যেন বিশ্বের মঞ্চে যে “বাংলাদেশি কুইজিন” বলে কিছু আছে, এটা উনি সারা দুনিয়াকে দেখালেন। আমাদের খাদ্য শিল্পের সাথে জড়িত আছেন যারা একটা সুযোগ নিয়ে দেখতে পারেন একটা আন্তর্জাতিক ব্র‍্যান্ড দাঁড় করিয়ে ফেলার !

কিশোয়ার মূলত: একজন বিপ্লবী শিল্পী , বুলেটের বদলে মসলা আর চামচ দিয়ে বিপ্লবটা করছেন মাত্র।
পশ্চিম বঙ্গেও চলছে বেশ হইহুল্লোর শিল্পীর এই এমন সাফল্যে । কিশোয়ার এই সফলতা বিদেশী কোনো রান্নায় নয় এ ছিল বাঙালী হেঁসেলের গল্প গাঁথা। দেশি সব খাবার রান্না করে বিচারকদের মন জয় করে নিয়েছেন। তার রান্না করা কালা ভুনায় মুগ্ধ হয়েছিলেন মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার বিচারকরা। এরপর খাসির রেজালা, ফুচকা, চটপটি, সমুচা, লাউ চিংড়ি, বেগুন ভর্তা, খিচুড়ি, আমের টকের মতো রেসিপি দিয়ে রীতিমতো বিচারকদের মাতিয়ে তুলেছেন।কিশোয়ার কিছু পাহাড়ী অন্চলের খাবার ও সাথে যুক্ত করেছিলেন ।


কিশোয়ারের বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। মায়ের বাড়ি কলকতায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তার মা-বাবা। সেখানেই জন্ম হয় কিশোয়ারের। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্নের বাসিন্দা কিশোয়ার চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে উঠা অস্ট্রেলিয়ায় ।তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায় হলেও তাঁর পারিবারিক আবহটা সবসময়ই ছিল বাঙালিয়ানা।মঙ্গলবার অনুষ্ঠানের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘ তিন মাস ধরে প্রতিযোগিতা চলার পর মঙ্গলবার চূড়ান্ত পর্বের ফল ঘোষণা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম নিউজ ডটকম থেকে জানা গেছে এ তথ্য।চূড়ান্ত পর্বের শুরুটা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল কিশোয়ারের জন্য। হাঁসের একটি পদ রান্না করা শুরু করেছিলেন। বিচারকেরা রান্না দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘এখানে কিশোয়ার কোথায়?’তারপরেই মেনু বদলে ফাইনাল ডিশ হিসেবে পরিবেশন করেন বাঙালির চির পরিচিত আলু ভর্তা, পান্তা ভাত আর সার্ডিন মাছ।
শেষ দিনের চ্যালেঞ্জে কিশোরারসহ বাকিদের রান্না করতে হয় স্কুইডের বিশেষ একটি রেসিপি ও সিডনির অপেরা হাউসের রেস্টুরেন্টের নিয়মিত ডেজার্ট ‘গোল্ডেন ক্র্যাকার’।

পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে চ্যাম্পিয়ন জাস্টিন নারায়ণ পেয়েছেন প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় পিট ক্যামবেল পেয়েছেন প্রায় ২০ লাখ ও কিশোয়ার পেয়েছেন প্রায় ১৩ লাখ টাকা। ফাইনালের আগের রাউন্ডেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসেন কিশোয়ার। সেরাও হন ওই পর্বে। সার্ভিস রাউন্ডে মাত্র চার ঘণ্টায় ২৩ গ্রাহক, ২০ অতিথি ও তিন বিচারককে খাওয়াতে হয়েছে তার নিজস্ব খাবার। মাছের পদের সঙ্গে ছিল পানের আইসক্রিম ও নেহারি। ওই পর্বে বাকি দুজনের খাবার বিচারকদের বেশ হতাশ করলেও কিশোয়ারের রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন সবাই। প্রথম হননি তাতে কী! কিশোয়ারের কারণে আমাদের পান্তা আর আলুভর্তাও এখন ব্র্যান্ড! তার ভাজা মাছ আর খাসির রেজালার স্বাদ সহসা ভুলতে পারবেন না বিচারকরা। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীদের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও এখন কিশোয়ারের উপচেপড়া প্রশংসা করছেন। ঘরে ঘরে রান্না হচ্ছে তার রেসিপি।দেশের গন্ডী পেরিয়ে পান্তা আলুর ভর্তা জায়গা করে নিল বিশ্বের অন্যতম ফেবারিট কুইজিনে । ধণ্যবাদ কিশোয়ার । বিশ্বের বুকে আরেকবার ছিনিয়ে আনলে বিজয়ের মুকুট ।

লেখকঃ প্রবাসী ব্রডকাষ্ট জার্নালিষ্ট

Advertisement