প্রতিবাদের অন্য ভাষা

রোকেয়া রহমান :

মির্জা শাহজাহান দৌড়ে চলেছেন। টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী রুপা খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যার বিচার দাবিতে জনমত গঠনে দৌড় শুরু করেছেন তিনি। প্রতি বুধবার তিনি টাঙ্গাইলের আদালত চত্বরে দৌড়ান। পিঠে থাকে রুপার হত্যাকারীদের বিচারের দাবি-সংবলিত স্লোগান। যত দিন রুপা হত্যার বিচার না হবে, তত দিন প্রতি বুধবার তিনি টাঙ্গাইল আদালত চত্বরে দৌড়াবেন।

২ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় মির্জা শাহজাহানের এই অনন্য উদ্যোগের খবরটি প্রকাশিত হয়। রুপা তাঁর নিজের মেয়ে, বোন, ভাগনি, ভাইজি কেউ নন। আত্মীয়তারও কোনো সম্পর্কও কখনো ছিল না। অচেনা, অজানা একটি মেয়ের হত্যার বিচারের জন্য তাঁর এ উদ্যোগ সত্যিই অনুকরণীয়। গত ২৫ আগস্ট টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রুপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পাঁচ পরিবহনশ্রমিক। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোটা দেশে নিন্দার ঝড় তোলে।

প্রথম আলোয় ২ ডিসেম্বর মির্জা শাহজাহানের খবরের পাশাপাশি আরও দুটি দাবির খবর ছাপা হয়। একটি হচ্ছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তাঁর মায়ের আমরণ অনশন কর্মসূচির খবর। আরেকটি হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ওয়ালিদ আশরাফের অনশনের খবর।

তিনটি খবর পড়েই আবেগাপ্লুত হয়েছি। পাশাপাশি মনে এই প্রশ্নও জেগেছে, কেন এই তিনজনকে এভাবে দাবি আদায়ের জন্য দৌড়াতে বা অনশন করতে হচ্ছে। মনে মনে একটু হাতড়াতেই উত্তরও খুঁজে পেলাম। কারণ, আমাদের দেশে যা ন্যায্য, যা হওয়া উচিত, তা সব সময় হয় না। কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার সহজে হয় না। একটি হত্যা মামলা বছরের পর বছর গড়ায়। আইনের ফাঁকফোকর গলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। কোনো শাস্তিই তাদের হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই সময় লেগেছে ৪০ বছরের বেশি। বড় ধরনের কোনো আন্দোলন না হলে বা গণমাধ্যমে প্রচার না পেলে অনেক অন্যায়-অত্যাচারের কাহিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। বিচার হয় না। হতে চায় না। হলেও ন্যায়বিচার হয় না। কাজেই একমাত্র মাধ্যম তো প্রতিবাদ করা, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করা। সেই বোধ থেকেই তিনজনের এই প্রতিবাদ কর্মসূচি।

কথায় বলে ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। অর্থাৎ যে দেশে আছেন, সেই দেশের বেশ আপনাকে ধরতেই হবে, সেই দেশের মতো করে চলতে হবে। তাই এটাই যদি নিয়ম হয়, ভালো কিছু হলে বাধা দেওয়া হবে। অন্যায়ের প্রতিকার সহজে হবে না। তাহলে প্রতিকারের আশায় এমন ব্যক্তি উদ্যোগের অহিংস প্রতিবাদে হয়তো ভবিষ্যতে অনেকে উৎসাহিত হবেন।

পুলিশের কর্মকর্তাদের আশ্বাস পাওয়ার পর দিয়াজের মা রোববার অনশন ভঙ্গ করেছেন। এখন আমরা আশা করব, পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের কথা রাখবেন। তাঁরা দিয়াজ হত্যাকাণ্ডের বিচার এগিয়ে নিতে সত্যিকারের অপরাধীদের পাকড়াও করবেন।

আমরা রুপা হত্যার বিচারের দাবিতে দৌড়ে চলা মির্জা শাহজাহানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি। আমরা চাই তাঁর এ প্রতিবাদ কর্মসূচি সফল হোক। আমরা ওয়ালিদ আশরাফের সঙ্গেও সংহতি প্রকাশ করছি। তাঁর চাওয়া আমাদের সবার চাওয়া। এভাবে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাই যদি সরব হয়, উচ্চকণ্ঠ হয়, সোচ্চার হয়, তাহলে দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। হতেই হবে। তাই প্রতিবাদ হোক সর্বত্র।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক

Advertisement