মুজিব জানতেন স্বাধীনতার থেকে কম কিছুও উপেক্ষিত হবে

মিজানুর রহমান খান
মুজিব জানতেন স্বাধীনতার থেকে কম কিছুও উপেক্ষিত হবে

প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সিআইএ বলেছিল, জেনারেল ইয়াহিয়া গণপরিষদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছেন। একই সঙ্গে পাঁচজন প্রাদেশিক গভর্নরকে অপসারণ করে তাঁদের জায়গায় সামরিক আইন প্রশাসকদের নিয়োগ দিয়েছেন। এবং বাধা-নিষেধ (সেন্সরশিপ) আরোপ করেছেন। এই সেন্সরশিপ সম্পর্কে নিক্সনকে আরও জানানো হয়, এটা সমগ্র দেশের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু আসলে পূর্ব পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া অবদমন করাই এসবের লক্ষ্য। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শিথিলভাবে শাসনকার্য চালাতেন। এখন তাঁকে সারিয়ে যে স্থানীয় সেনা অধিনায়ককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁকে কিছুটা কঠোর মনে করা হয়। এরপর উল্লেখ করা হয় যে গতকাল মুজিবুর রহমানের ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে ঢাকা অচল হয়ে পড়েছিল। আজ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তা বিস্তৃত হবে। বিভিন্ন ধরনের সহিংস ঘটনার কারণে কর্তৃপক্ষ ঢাকায় রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করেছে। কনসাল জেনারেল ব্লাড মন্তব্য করেছেন, ‘তীব্র মানসিক আঘাত, হতাশা এবং ক্ষোভ, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্পর্শ করেছে, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। আগামী রোববার মুজিব তাঁর পরিকল্পনামাফিক একটি জনসমাবেশে বিরাট কোনো ঘোষণার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ রয়েছেন। তিনি হয়তো কর না দেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মস্থলে কর্মবিরতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্য বয়কট করার মতো কর্মসূচির মধ্যে নিজেকে সংবরণ করতে পারেন। ৩ মার্চের ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিলম, তা বিবরণ দিতে গিয়ে তারা নিক্সনকে লিখেছিল, একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ঢাকার পরিবেশ অনুকূল।

১৯৭১ সালের ৫ মার্চ সালের নথিটি পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। একটি অংশ গোপন রাখা হয়েছে। এই নথিতে একটি সম্ভাব্য সামরিক হামলা পরিচালনায় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামর্থ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই নথি সাক্ষ্য দিচ্ছে, স্বাধীনতাকামী নিরীহ জনতার ওপর সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ পরিচালনার বিষয়টি সিআইএ ভাবলেশহীনভাবে নিক্সনকে অবহিত করেছিল। অন্যদিকে, নথিটি একটি নতুন তথ্যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে, মুজিব একদল বিদেশি সংবাদদাতার কাছে স্বীকার করেছেন, ফেডারেশন গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি তাঁর ভাষণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি আলাদা সংবিধানের খসড়া তৈরির আহ্বান জানাবেন। এই নথিতে সাতই মার্চের ভাষণে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়ে সিআইএর নিজস্ব মূল্যায়ন নিক্সনকে জানানো হয়েছিল এভাবে, ‘একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণার চেয়ে এ ধরনের একটি পথ বেছে নেওয়া কম কঠোর বলে প্রতীয়মান হবে। তবে মুজিব সংবাদদাতার কাছে স্বীকার করেছেন, তাঁর পরিকল্পনা হলো এমন কিছু ঘোষণা দেওয়া, যা হবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতার সমান।’

উল্লেখ্য, ৬ মার্চে সিআইএ তার একটি বুলেটিনে (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স বুলেটিন) স্বাধীনতার সমতুল্য বলতে মুজিব কী বুঝিয়েছিলেন, তার একটি ব্যাখ্যা আছে। তাতে লেখা আছে, ৭ মার্চে মুজিব সম্ভবত এখনো স্বাধীনতার সমতুল্য কিছু ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আর তা হলো, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক সংবিধান প্রণয়ন এবং প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা।’ অবশ্য পরে দেখা যায়, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পৃথক সংবিধান বা পৃথক প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার মতো কিছু বলেননি।

তবে লক্ষণীয়, সিআইএ নিক্সনকে এটা পরিষ্কার করেছিল, ‘মুজিবের ওই প্রস্তাবও সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্যনির্ভর সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য হবে।’ ৫ মার্চে ওই নথি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছে, সংবেদনশীল বিষয়গুলোয় ব্যক্তিগতভাবে মুজিবের চিন্তাভাবনাই যে পরিস্থিতির জন্য নিয়ামক হয়ে উঠেছিল, সিআইএ তা নিক্সনের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিল।

১ মার্চে সিআইএর প্রস্তুত করা ১৮ পৃষ্ঠার একটি স্মারকে (ইস্ট পাকিস্তান: অ্যান ইন্ডিপেনডেন্ট নেশন?) বলেছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব আজ থেকে কার্যত একটি পার্টি স্টেট—আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমান হিসেবে শুরু হলো।’

চার দিন পরে সিআইএ নিক্সনকে বলেছে, ‘বুধবার অপরাহ্ণে (৩ মার্চ) এক সমাবেশে মুজিবের ভাষণের পরে পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতার প্রকোপ হ্রাস পেয়েছে। মুজিব যদিও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য সরকারের সমালোচনা করেছেন। সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরানোর দাবি করেছেন। আর একই সঙ্গে গত মঙ্গলবার থেকে চলতে থাকা লুট ও অগ্নিসংযোগ থেকে বিরত থাকতে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে, সামরিক চলাচল আটকাতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি, সড়কে ব্যারিকেড তৈরি এবং কর না দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।’ এরপরের একটি অনুচ্ছেদ মুছে দেওয়া হয়েছে।

আর পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতির বিষয়ে সিআইএর ব্যাখ্যা থেকে এই ইঙ্গিত সুস্পষ্ট, সিআইএ ইয়াহিয়ার অশুভ পরিকল্পনা সম্পর্কে নিক্সনের কাছে কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটায়নি। নিক্সনকে বরং তারা জানিয়েছিল, ‘গোলযোগ শুরু হওয়ার আগে প্রায় ২০ হাজার সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন ছিল। এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছিল বাঙালি। যাদের আনুগত্য সম্ভবত জ্ঞাতিভাই পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতিই ছিল।’ সংস্থাটির যেন দরদ ছিল, এটা ফুটিয়ে তোলা স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়, ‘গোলযোগ’ দমনে ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা যাতে সফল হতে পারে।

‘বৃহৎসংখ্যক সৈন্য পরিবহনের মতো পর্যাপ্ত বিমান এবং নৌপরিবহনের সামর্থ্য পর্যাপ্ত নয়’—ওই নথিতে এ কথা উল্লেখ করার পরে সিআইএ লক্ষণীয়ভাবে মন্তব্য করেছে, ‘আমরা মনে করি, একটি বড় ধরনের বিদ্রোহ মোকাবিলায় বিপুলসংখ্যক সৈন্য দরকার পড়বে।’

তবে লক্ষণীয়, পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পশ্চিম পাকিস্তান বাস্তবে ‘যেকোনো মূল্য’ দিতে রাজি ছিল না, নিক্সনকে সেটাও পরিষ্কার করেছিল সিআইএ। তারা ৫ মার্চে লিখেছিল, ‘[পূর্ব পাকিস্তানে] পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সামরিক বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের ভারত সীমান্ত থেকে তার মোতায়েন করা কোনো সেনা ইউনিটকে স্থানান্তর করতে চাইবে না। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আস্থা ব্যক্ত করেছে যে সর্বাত্মক বিদ্রোহের থেকে কম কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের পর্যাপ্ত শক্তি রয়েছে।’

৬ মার্চের ব্রিফটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অতি গোপনীয় থেকে গেছে, যা অবমুক্ত করা হয়নি। এই নথির অবমুক্ত করা অংশে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ ঘোষণা দিয়েছেন যে গণপরিষদের স্থগিত হওয়া অধিবেশন ২৫ মার্চে ডাকা হবে। তাঁর কথায়, মতপার্থক্য নিয়ে আলোচনার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করতে তাঁর ব্যর্থতার কারণে তাঁর সামনে পরিষদের অধিবেশন ডাকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাঁর কথায়, তিনি মনে করেছেন, নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই অচলাবস্থা নিরসনে তাঁর দায়বদ্ধতা রয়েছে। সিআইএ এরপর লিখেছে, ইয়াহিয়ার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু তাঁর কথার সুরে এটা প্রকাশ পায় না যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে আপসরফা আনতে পারে, এমন কোনো অগ্রগতি তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

এরপর দুটি প্যারাগ্রাফ মুছে দেওয়ার পর লেখা হয়েছে, গতকাল ইয়াহিয়া ভুট্টোর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বৈঠকের পরে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) একজন মুখপাত্র স্থগিত করার বিষয়ে ‘সবচেয়ে অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারণে’ মুজিব ও তাঁর সহযোগীদের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ওই মুখপাত্র পিপিপি পরিষদে এখন যোগ দিতে সম্মত আছেন কি না, সে বিষয়ে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই এই নথি অবমুক্ত করা হয়।

Advertisement