রাজনীতিতে গুমোট কাটছে

এম হাফিজ উদ্দিন খান

সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু বিএনপি নেতৃবৃন্দের বক্তব্য এর বিপরীত। তারা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে আপত্তির কথা জানিয়ে আসছেন। তবে একটা বিষয় সম্প্রতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনের গুমোট পরিবেশ কিছুটা হলেও কেটে গেছে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্নেষকই মনে করেন। দীর্ঘদিন পর বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে গত ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির শান্তিপূর্ণ জনসভা এবং এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ ও পথে পথে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বিএনপির রাজনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, এও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশগ্রহণও বিএনপির রাজনীতির জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মহলের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নমনীয় মনোভাবেরও প্রশংসা করেছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও বিশ্নেষকরা। সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতিতে অন্যরকম হাওয়া বইছে। এই হাওয়া উত্তরোত্তর ইতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে, এই প্রত্যাশা শান্তিপ্রিয়রা পোষণ করলেও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা কঠিন। সরকার বিএনপিকে জনসভা করতে দিয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। তবে এর জন্য একগুচ্ছ শর্ত বেঁধে দেওয়া, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো সমালোচনার ক্ষেত্রও তৈরি করেছে। যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টির ভুক্তভোগী ছিলাম আমি নিজেও। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে যে কাউকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত এবং অস্বস্তির বিষয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতিবিরুদ্ধ। এমন পরিস্থিতি নেতিবাচকতার বিষয়গুলো পুষ্ট করে তোলে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করে রাজনৈতিক দল জনগণকে তাদের নীতি কিংবা কর্মসূচির কথা জানাবে, এটিই খুব স্বাভাবিক বিষয়। দুই বছর পর বিএনপির সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রশাসন তথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায়িত্ব হলো নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা। যানবাহন বন্ধের ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিশেষ করে পুলিশের বক্তব্য ছিল হাস্যকর। এমন বক্তব্য ও ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য নিশ্চয় ক্ষতিকর। বিএনপিকে জনসভা করার অনুমতি দানের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক পরিবেশের সূচনা হয়েছে, এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি-না কিংবা নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড কেমন হবে, তারা একটি প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন করতে সক্ষম হবে কি-না- এসব কিছুর উত্তর রয়েছে ভবিষ্যতের কাছে।

আমাদের দেশে দৃশ্যত গণতন্ত্রের জন্য যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কিংবা সরকারের দায়িত্বশীলদের কথা বলতে শোনা যায়, প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটে এবং এমনটি ইতিমধ্যে বহুবার লক্ষ্য করাও গেছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হবে আর যারা সরকারে থাকবে তাদের জন্য অন্যরকম ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে- এমনটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য স্বস্তির বিষয় নয়। বরং এমনটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠারই জন্ম দেয়। আমরা বরাবরই হরতাল-অবরোধসহ যে কোনো রকম ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিরোধী। কোনোভাবেই জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা যাবে না-এটি হতে হবে রাজনীতিকদের মূল লক্ষ্য। নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করা যাবে না, রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তির সম্পদের ওপর আঘাত পড়ে কিংবা বিনষ্ট হয়, এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া যাবে না- এই বিষয়গুলো সম্পর্কে রাজনীতিকরা নিশ্চয় অজ্ঞাত নন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা এসব ভুলে যান এবং এটিই হলো দুর্ভাবনার বিষয়। আগামী সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ততই সরব হয়ে উঠছে। দীর্ঘদিন পর বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে নামার সুযোগ পাওয়ায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের চাঙ্গা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, এ বিষয়ে বিতর্ক চলছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বেগম জিয়ার বক্তব্য অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন, সংবিধান মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে।

দুই দলের অবস্থান নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত বিপরীতমুখী। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত, গ্রহণযোগ্য, দৃষ্টান্তমূলক করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের দুটি বড় দলকে ছাড় দিতে হবে। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে এক টেবিলে বসে সমাধান সূত্র বের করা উভয় দলের নেতৃবৃন্দের উচিত। সংকটের স্থায়ী সমাধানে প্রয়োজন রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা। সাংবিধানিক কারণে আওয়ামী লীগের অবস্থান আগে থেকেই পরিস্কার। বড় দুটি দলই তাদের দাবির ইস্যুতে অনড়। আর সংকট এখানেই। আবারও বলতে হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতিতে দেশ-জাতির স্বার্থেই বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে দু’দলকে সরে আসতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দু’দলের নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসার ক্ষেত্র তৈরিতে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। আলোচনার টেবিলে তর্ক-বিতর্ক হোক এবং এর মধ্য দিয়েই বের হয়ে আসুক সমাধান। শান্তিপ্রিয়রা এমনটাই প্রত্যাশা করেন। সবার অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার দায় কারোরই কম নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি মহলের দায় বেশি। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সবকিছু হতে হবে প্রশ্নমুক্ত, নির্মোহ অর্থাৎ আইন ও ন্যায়ানুগ। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণের বিষয়টি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলো নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অতীতে অনেক নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রীতিকর। সবকিছু আমলে রেখে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে না গিয়ে সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পরও আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারিনি বলেই বারবার এমন সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। এর স্থায়ী সমাধান করতে হলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। তবে শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরই নয়, সংশ্নিষ্ট সবারই চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের প্রতি যার যার অবস্থান থেকে আরও শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। সবাই যদি আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হন, তাহলে সংকটের সমাধান কোনো দুরূহ বিষয় নয়। সব দিক বিবেচনায় সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। অন্য কোনো পন্থায় শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যাবে না এবং পৌঁছা যাবে না ঐকমত্যে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকতেই পারে। এই মতবিরোধ নিরসনের প্রয়োজনেই দরকার অর্থবহ সংলাপ।

দেশে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নিজেদের স্বার্থের বিষয়গুলো গৌণ করে দেখে দেশ-জাতির স্বার্থ মুখ্য করে দেখা প্রয়োজন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যার যার অবস্থানে অনড় থাকলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরুদ্বিগ্ন থাকার অবকাশ নেই। এমন অবস্থা সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করবে, যা শান্তিপ্রিয় কারোরই কাম্য নয়। তাই খোলা মন নিয়ে সংলাপে বসতেই হবে। নির্বাচন কমিশনকে যদি আরও স্বাধীন এবং ক্ষমতা দিয়ে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সে রকম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়া যায় তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুশ্চিন্তা অনেকটাই কেটে যাবে। নির্বাচনের সময় যে সরকার থাকবে তারা নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ সহযোগিতা করবে। এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যমান সংকট কেটে যাওয়ার পথ সুগম হবে বলেই মনে করি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ জরুরি। এই সংস্কৃতির বিকাশেই আমাদের অনেক সমস্যা-সংকট নিরসনের পথ উন্মুক্ত হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

Advertisement