।। মঞ্জু সরকার।।
বিয়ের এক মাস সাতাশ দিন পর, বলা যায় মধুচন্দ্রিমা উদ্যাপনকালে বাসরঘরেই সাপ যেন ছোবল মারতে উদ্যত হয় লখিন্দরকে। আত্মরক্ষার জন্য ঝটিতে দরজা খুলে বাইরে বেরোয় লস্কর এবং দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বারান্দায় একা হয় সে। নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে সংকটে একাকিত্বের দোসর সিগারেট জ্বালে, সাপের ছোবলের মুখোমুুখি হওয়ার দৃশ্যটির কথা ভাবে আবার। বুক ধড়ফড় করছে এখনো।
বিছানায় ভালোবাসার তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে লিমা। বালিশের তলায় তার ফোন জেগে উঠেছে। মধ্যরাতে এই ফোনেই আবির্ভাব ঘটেছে সাপটির। তার আলো ছলকানো, তার ফোঁসফোঁস টিউন-আওয়াজ লিমার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। অন্যদিকে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত লস্কর এই প্রথম নববধূর ফোন হাতে নিয়েছে। কলটা মিস হয়ে গেলেও আলোকিত স্ক্রিনে কলকারীর পরিচয়, সাংকেতিক নাম এক্স প্রথম খটকা জাগায় মনে। একটা জরুরি মেসেজও পাঠিয়েছে এক্স : ফেসবুকে দেখি না কেন? ফোন করো, সারা রাত অপেক্ষায় থাকব।
অপেক্ষার প্রহর দুঃসহ হয়ে উঠছে বলেই কি বাসরঘরে উঁকি দেওয়ার মতো মিসকল মারতে শুরু করেছে? লিমা তাকে সাংকেতিক নামেই সেভ করে রেখেছে বলে কললিস্টে একাধিক স্থানে তার উপস্থিতি জ্বলজ্বল করে। দুদিন আগে রাতে স্বামীকে এড়িয়ে এক্সের সঙ্গে কথা বলার জন্যই লিমা কি ফোন নিয়ে বারান্দায় গিয়েছিল? স্ত্রীর আলোকোজ্জ্বল ফোনের দিকে তাকিয়ে এক্স যখন সাপের ফণার মতো প্রশ্ন হয়ে ওঠে, ছোবল খাওয়ার ভয়ে ফোনটা দ্রুত বালিশের তলায় গুঁজে দিয়েছে লস্কর। কিন্তু বারান্দায় এসে মনে হয়, ভয়ে নয়, ছোবল অলরেডি খেয়েছে বলেই বুকের পালপিটিশন বাড়ছে। বিষক্রিয়া শুরু হওয়ায় বিষাক্ত সিগ্রেটের স্বাদ-গন্ধও টের পাচ্ছে না আর।
ভেতরের তাবত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দিয়ে লস্কর ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করে। তাদের বিয়েটাকে ভালোবাসার বিয়ে হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু জেনেশুনে বিষপান তো অবশ্যই। বিয়ের আগে পারস্পরিক জানাশোনা, একাধিক ডেটিং হয়েছে। সুযোগ বুঝে একদিন আলিঙ্গন ও চুম্বনও হয়েছে। কিন্তু যাকে বলে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন, তার শুরু বিয়ের শতেক সামাজিক ঝামেলা চুকে যাওয়ার পর। এই সম্পর্কে যাওয়ার জন্য শারীরিকভাবে দুজনই তো কমবেশি এক যুগ ধরে তৈরি হয়েই ছিল। দীর্ঘ অপেক্ষা ও প্রস্তুতির চাপ কমাতে ফুলশয্যার রাতকে যখন প্রতি রাতে ফিরে পাওয়ার কামনায় রোজ দুবার করে শরীরী মিলন অক্লান্তভাবে চলছে, তখন যৌথ সাধনার মাঝে আজ অসময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় লস্কর সাপটিকে প্রথম দেখতে পায় কেন?
স্ত্রীর এবং নিজের স্মার্ট ফোনটাও বাসায় দিনে-রাতে ওয়াই-ফাই কানেকশনে ইন্টারনেট সেবা পায়। বিয়ের আগেও আলাদাভাবে এমন সুবিধাভোগে অভ্যস্ত ছিল তারা। ইন্টারনেটে যোগাযোগ হতো, ফেসবুকেও বন্ধু তারা, ইমু-স্কাইপেও মুখোমুখি কথাবার্তা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু লস্কর ছাড়াও ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ফোনবুকের কললিস্টে লিমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে নিশ্চয়ই। সংখ্যায় কতজন তারা? জানার জন্য বাড়তি কৌতূহল কখনো দেখায়নি লস্কর। লিমার ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করেনি কখনো। আজ মাঝরাতে যেটুকু করল, তাও আসলে কোনো বাজে সন্দেহ নিয়ে নয়। সন্দেহ করবে কেন? লিমাকে বিয়ে করেছে বলে তার পুরো অতীত ও একান্ত ব্যক্তিগত জগতের মালিক হয়ে গেছে লস্কর? নিন্দুকরা যাই বলুক, নিজেকে লস্কর উদার ও বিবেচক মানুষ হিসেবে প্রশংসা করে। বিয়ের আগে সে ছাড়াও লিমার একাধিক বন্ধু ছিল অবশ্যই, ঘনিষ্ঠতর এবং ঘনিষ্ঠতম ছিল কেউ কেউ, এখনো থাকাটাই তো স্বাভাবিক। লিমা যেহেতু এখনো চাকরি-বাকরিতে যোগ দেয়নি, উপরন্তু বাসায় কাজের মেয়ে ও কর্মক্ষম শাশুড়ি বর্তমান, সার্বক্ষণিক গৃহবধূ সাজার বিরক্তি এড়াতে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও বন্ধু-বান্ধবীসহ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তাও তার বেশি। দিনে স্বামীকে কাছে পায় না বলে ফোনে টাচ দিয়ে সময় কাটায়। অন্যদিকে লস্কর রোজ অফিস ও ঢাকার রাস্তার জ্যাম সামলে বাসায় যেটুকু সময় পায়, নববধূকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত থাকে বলে হাতের ফোনেও আঙুলের স্পর্শ দেওয়ার সময় পায় কম। ফেসবুকেও ঢোকা হয় না আগের মতো। লিমাই ভরিয়ে রেখেছে সব শূন্যতা। এর মাঝে কোথাকার কোন এক্স এসে দুজনার মাঝে ব্যবধান বাড়ানোর অপচেষ্টা করছে আজ! নিজের ওপরেই রাগ-বিরক্তি নিয়ে ঘরে আসে সে।
স্বামীর বিছানায় থাকা না থাকা লিমার ঘুমে বিঘ্ন ঘটায়নি একটুও। আজ ঘুমানোর আগে শরীরী সম্পর্কটা দীর্ঘতর করতে চেয়েছিল সে। লস্কর পারেনি, পরের বারে পারার আশ্বাস দিয়ে ঘুমিয়েছিল। সেই আশ্বাসের ওপর ভরসা করেই যেন কোলবালিশকে স্বামীজ্ঞানে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। বিয়ের আগেও কোলবালিশে অভ্যস্ত ছিল লিমা, স্বামীর বিছানায় এসেও অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি। বিয়ের আগে লিমা যে শুধু লস্করকে কল্পনা করে তার কোলবালিশটি জড়িয়ে ঘুমাত, এমন কথা লিমা কখনো বলেনি। বললেও যুক্তিবান স্বামী লস্কর অবশ্যই তা বিশ্বাস করবে না, বিবাহপূর্ব গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও বিশ্বাস করত না। আসলে বিয়ের আগের আটাশ বছর বয়সের যুবতীর কুমারী জীবনের যে নিজস্ব জগৎ, তার সীমা-পরিসীমা ও স্বাধীনতা নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই লস্করের। কিন্তু তা বলে স্বামীর শয্যায় কোলবালিশ জড়িয়ে স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষকে স্বপ্নে দেখবে, তা মেনে নেওয়ার উদারতা দেখাতে পারবে কোনো মহাপুরুষ? লস্কর বালিশের তলায় স্ত্রীর ফোনটার দিকেও তাকায়। সম্ভবত আবারও খোঁচা দিয়েছিল হারামজাদা এক্স। লস্কর এর আগেও ঘুমন্ত স্ত্রীর শরীরসংলগ্ন কোলবালিশটার স্থান দখলের জন্য খুব আলতো করে বালিশ সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আজ প্রায় হ্যাচকা টানে ওটাকে সরিয়ে দেয়। লিমার তবু ঘুম ভাঙে না। আরো ঘুমানোর জন্য পাশ ফিরে শোয়মাত্র।
পরদিন অফিসে যাওয়ার ব্যস্ততার মাঝেও, নাশতার টেবিলে লস্করই রাতে ঘরে সাপ দেখার প্রসঙ্গটি ওঠায়।
কাল রাত বারটার পরে তোমার একটা ফোন এসেছিল বোধ হয়।
হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু করেছিল। মেসেজও দিয়েছে।
লস্কর চোর ধরবে কি, নিজেরই চোর হিসেবে ধরা পড়ার ভয়ে বুক ছ্যাঁত করে। গভীর রাতে তার ফোন হাতড়ানোর বিষয়টি ধরে ফেলেছে নাকি?
কোন বন্ধু?
ও পাস করার পরই ভালো একটা কম্পানিতে চাকরিতে ঢুকেছে। ওর কম্পানিতে আমাকেও ঢোকানোর চেষ্টা করছে। এ নিয়েই জরুরি কথা বলতে চাইছে। দেখি আজ ফোন করব।
এরপর এক্সের লিঙ্গ পরিচয় মনে প্রবল প্রশ্ন হয়ে উঠলেও, তা প্রকাশ করে নিজেকে ছোটলোক প্রমাণ করতে চায় না লস্কর। ছেলে বন্ধু হোক, আর মেয়ে বন্ধু হোক, মধ্যরাতেও যে লিমাকে চাকরিতে ঢোকানোর চেষ্টায় অস্থির হয়ে ওঠে, তার মহত্ত্বটাই বড় কথা। সমর্থন দিয়ে বলে সে, দেখো তোমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলো। বিয়ের দুই মাসেই গৃহবন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠেছ মনে হচ্ছে।
মাস্টার্সের পর এতগুলো ইন্টারভিউ দিলাম। শেষ পর্যন্ত কোথায় কী হয়, দেখা যাক। তোমাকে পাওয়ার পর চাকরি নিয়ে আর তাড়াহুড়া নেই। কী বলো।
তুমি চাকরি না করলেও আমাদের সংসার ঠেকে থাকবে না লিমা।
নিজের কাছেও কবুল করতে দ্বিধা নেই লস্করের, স্ত্রীর সেবাযত্ন পাওয়ার ব্যাপারে তার মনটা ব্যাকডেটেড। ঘরের বউ বাইরে গিয়ে ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তি কি প্রতিষ্ঠানের অধীন থেকে কাজ করবে, কাজটা যত সুন্দর হোক আর কাজের মজুরি যত উচ্চ হোক, এমন প্রস্তাবে অন্তত নিজের স্ত্রীর বেলায় মনটা সায় দিতে চায় না। তবে বিয়ের আগেই পারস্পরিক জানাশোনার সময়ে লিমা ভবিষ্যতে তার চাকরি করার শর্তটি জুড়ে দিয়েছিল। লস্করও আপত্তি করেনি। প্রতিযোগিতার বাজারে দুজনের রোজগারের চাকায় বাঁধা থাকলে সংসার যে অনেক গতিশীল থাকবে, এ যুক্তি পাগলও মানবে।
দিনকয়েকের ছোটাছুটি এবং মাসদুয়েকের অপেক্ষায় এক্সের কম্পানিতে চাকরি হয়ে যায় লিমার। বায়োডাটা আগেই দেওয়া ছিল। ইন্টারভিউয়ের পর অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার পেতেও বিলম্ব হয় না। আর এই প্রক্রিয়ার মাঝে লিমার কললিস্টের রহস্যময় বন্ধু এক্সকেও জানা হয়ে যায় লস্করের। বান্ধবী নয়, গোঁফওয়ালা দশাসই পুরুষ। ইউনিভার্সিটিতে লিমার সহপাঠী ছিল। সম্পর্কটা যে সহপাঠের মধ্যে সীমিত থাকেনি, সহবাসসুলভ গভীরতায় পৌঁছার পথও খুঁজেছে, তা অনুমান করার জন্য সন্দেহবাতিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রথম দর্শনেই পষ্ট বুঝতে পারে সে।
লিমার আগেই বিয়ে হয়েছে এক্সের। কিন্তু আইটি বিপ্লব দুজনের কাছাকাছি হওয়ার কত যে গোপন পথ সৃষ্টি করেছে। গোপনে যোগাযোগটা অব্যাহত ছিল বলেই লিমার জন্য মোটা বেতনের চাকরি নিজের কম্পানিতে ঘুষ ছাড়াই করে দিয়েছে এক্স। কে এ রকম করে আজকাল? লিমা নিজে তো কৃতজ্ঞ, স্বামীর চৌদ্দগোষ্ঠীকেও কৃতজ্ঞ করে তোলার জন্য একদিন তাকে দাওয়াত করে বাসায় ডেকেও আনে। বিশিষ্ট মেহমানকে খাওয়াতে লিমা তার স্পেশাল রেসিপি করতে রান্নাঘরে অনেক সময় দেয়। স্বামীর জন্যও এতটা সময় দেয়নি এখনো।
লস্করের আন্তরিকতা এক্সের স্ত্রীকে পর্যন্ত ছোঁয়, আহা, ভাবিকে সঙ্গে আনলেন না কেন? চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যেত।
ওয়াইফ আমার অফিস আর অফিস-কলিগদের ব্যাপারে একদম ইন্টারেস্ট দেখায় না। লিমাও তো এখন অফিসকলিগ হলো।
অতঃপর তাদের মধ্যে অফিস, দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়, কিন্তু পারিবারিক কথা দু-একটির বেশি নয়। স্ত্রীকে খুশি করতে তার পুরনো বন্ধুকে আন্তরিক আপ্যায়নে ত্রুটি না করলেও, ভদ্রতা করেও এক্সের মতো মানুষকে লস্কর বন্ধু তালিকায় ঠাঁই দিতে পারবে না। মেহমান বিদায় হতে না হতেই এ সত্যটা স্ত্রীর কাছে গোপন করার চেষ্টা করে না লস্কর।
তোমার ক্লাসমেট ঘরের বউকে বাইরে কোথাও জড়াতে চায় না দেখছি।
সবাই তো তোমার মতো উদার নয়। ও আসলে রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে।
আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো কন্টাক্টলিস্টে তোমার বন্ধুর নাম এক্স রেখেছো কেন বলো তো?
লিমা রহস্যটিকে মজার হাসির আচ্ছাদন পরিয়ে বলে, জানো সেক্স নিয়ে ও খুব বাজে রসিকতা করত। এ কারণে ওকে আমরা এক্স নামেই ডাকতাম।
স্বামী-স্ত্রীর বাইরে সেক্স নিয়ে ঠাট্টা-মসকরা করাটাও যে লস্করের কাছে মোটেও রুচিসম্মত বিষয় নয়, সেটা বোঝাতে এ নিয়ে আর বাড়তি কোনো কথা বলে না সে। গাম্ভীর্য কঠিন করে তুলতে পাশ ফিরেও শোয়।
লিমা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর নবদম্পতির সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব ও শূন্যতাও যেন বাড়তে থাকে। স্ত্রী সারাক্ষণ বাসায় থাকার সময়ে লস্কর রোজ অফিস থেকে কারণে-অকারণে কয়েকবার ফোন করে তার খোঁজ নিত। একইভাবে লিমার অফিসেও প্রথমে রোজ ফোন করেছে, কিন্তু লিমা অফিসে স্বামীর উপস্থিতি অবাঞ্ছিত ভাবে বোধ হয়। অফিসে গেলে ঘর-সংসার দূরে রাখতে পছন্দ করে। প্রাইভেট কম্পানি, শিক্ষানবিশি প্রিয়ড বলে কাজের চাপ বেশি। কর্মব্যস্ততা ছাড়াও তার কথা বলার বন্ধুর অভাব নেই। অফিস পেয়ে রোজ অফিস নিয়েই এমন আচ্ছন্ন লিমা, বাসায় ফিরেও স্বামীকে অফিসের গল্প শোনায়। এমডির কথা বলে, সহকর্মীদের কথা বলে, কিন্তু এক্সের গল্প করে না কখনো। ভাবখানা এক্স বলে কেউ নেই তাদের অফিসে।
প্রথম মাসের বেতন পেয়ে স্বামী, শাশুড়ির জন্য দামি প্রেজেন্টেশন কেনে লিমা। আবার বাপের বাড়ির সবার জন্যও এটা-সেটা কিনতে ভোলে না। নিজের রোজগার স্বাধীনভাবে খরচ করার অধিকার আছে তার। এ নিয়ে লস্করের আপত্তির কিছু নেই। ভালোবেসে স্ত্রীকে সারাক্ষণ দেহমনে আঁকড়ে রাখতে চায় বলে তার রোজগারের টাকাকে নিজের মানিব্যাগে ঢোকাতে চাইবে, এতটা অর্থলোভী নয় লস্কর। কিন্তু চাকরির ব্যাপারে যার কাছে সবচেয়ে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, প্রথম বেতন পেয়ে তাকে কী প্রেজেন্টেশন দেওয়া হলো, লিমা কিছু জানায় না। উদার স্বামী লস্করই বরং এক্সের ন্যায্য পাওনা মনে করিয়ে দেয়। কী দিলে তাকে?
ওকে আবার কী দেব? আমার চেয়েও বেশি বেতন পায়। তবে নিজেই গুলশানের এক বিদেশি রেস্তোরাঁয় খেতে চেয়েছে। খাওয়াতে হবে একদিন। কারণ আমার চাকরিতে পারমানেন্ট হওয়াটাও ওর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।
তাহলে একদিন কেন, প্রতি মাসেই বেতন পেয়ে তো ওকেই আগে খাওয়ানো উচিত।
উদার পরামর্শের ভেতরে ভেজাল খুঁজতে লিমা তীব্র চোখে তাকায়, সতর্ক করে স্বামীকে, আমার অফিস নিয়ে তোমাকে এত ভাবতে হবে না।
তুমিও আর অফিসের গল্প করো না আমার কাছে।
এখন থেকে অফিসকে অফিসে রেখেই বাসায় ফিরব দুজন। ঠিক আছে?
লিমা চাকরির গল্প না করলেও, রাতে এক বিছানায় থেকেও অনেক সময় তার নাগাল পায় না লস্কর। সারা দিন অফিস করার ক্লান্তিতে বিছানায় শুলেই ঘুম পায়, কিংবা ঘুমানোর আগেও হয়তো অফিসের কথাই ভাবে লিমা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে লস্কর, দাম্পত্য শয্যায় মিনিট দশেকের সম্পর্ক যা দেয়, সে তুলনায় কর্মজগতের প্রাপ্তিটা অনেক ভারী। মাসিক বেতনটা হস্তগত করতে প্রতিদিনের কাজ, অকাজ, আপস, বিরক্তি, ক্লান্তি হজম করতে হয় প্রতিদিন। লিমাও চাকরিতে ঢুকে এসব করছে সন্দেহ নেই। প্রাইভেট কম্পানিগুলো সুযোগ-সুবিধা যেমন দেয়, তেমনি কর্মচারীদের দেওয়ার ক্ষমতা সবটাই শুষে নিতে চায়। লস্কর এসব জানে বলে লিমার চাকরির ব্যাপারে সহানুভূতি দেখাতে চায়। কিন্তু লিমা তার চাকরির খারাপ দিক স্বামীর কাছে জানায় না কিছু। অফিসের গল্প টুকটাক যেটুকু বলে, তাতে অফিস ও চাকরির প্রতি তার ভালোলাগাটাই ধরা পড়ে বেশি।
অফিসে যাওয়ার আগে সাজুগুজু করতেও বেশ সময় নেয় সে। একসঙ্গে গেলে, লিমাকে অফিসে পৌঁছানোর দায়িত্ব পেলে লস্কর হয়তো বিরক্তি লুকাতে পারত না। ভাগ্যিস দুজনের অফিস দুই দিকে, যাত্রা ও ফেরার সময়টাতেও তারতম্য ঘটে দু-এক ঘণ্টার। লিমা যেদিন বেশি সাজুগুজু করে, চকিতে লস্করের মনে সন্দেহ জাগে গুলশান রেস্তোরাঁয় আজ খাওয়ার প্রগ্রাম নেই তো? অফিসে লিমা যতবার তার এক্সের টেবিলে যায়, শুধু কি কাজের স্বার্থে? কী এমন কাজ তার, এক্সের সঙ্গে যা শেয়ার করা জরুরি? কাজের ঘনিষ্ঠতায় লিমার শরীরী সৌন্দর্য-ঘ্রাণ এক্সের চোখে-নাকে ধরা পড়ে নিশ্চয়ই। কাজ আদান-প্রদানের সঙ্গে হাতে হাতে ছোঁয়াছুঁয়ি হয় নাকি?
সন্দেহবাতিকতা খুব খারাপ জিনিস। লস্কর বুঝতে পারে, যেদিন প্রথম মধ্যরাতে এক্স লিমার ফোনে উপস্থিত হয়ে সন্দেহের বিষ ঢোকায় তার মনে, সেদিন থেকে সম্পর্কের মাঝে যে ফাটল তা লিমার কারণেই যেন ক্রমে বেড়ে চলেছে। ফাটল মেরামত করে সম্পর্কটাকে তরতাজা রাখার জন্য লস্করই উদ্যোগ নেয়। বিয়ে করার আগে থেকে সে উত্তমরূপে জানে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টেকসই করে রাখে সন্তানরা। মা-বাবার মাঝে এমন সব গিট্টো লাগিয়ে রাখে, যা ছিন্ন করা সহজ নয়। অনিবার্য ডিভোর্স পর্যন্ত ঠেকিয়ে দেয় তারা। লস্কর এক রাতে নিজের অনাগত সন্তানকে আদর দিতে স্ত্রীর নগ্ন পেটে হাত রেখে বলে, আমার মনে হয় গো, আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না। অফিস থেকে ফিরে তোমায় না দেখলে মনটা ফাঁকা লাগে। কিন্তু রোজ অফিস থেকে ফিরে যদি আমরা সোনামণির মুখ দেখি, মনটা ভরে যাবে।
কেন আমাকে দেখে আর মন ভরছে না?
তুমি তো তোমার জায়গায় ঠিকই আছো। ভাবছিলাম, এমনিতেই তো বিয়ে করতে দেরি হলো, সোনামণিদের আগমন ঠেকিয়ে রাখা কি ঠিক হবে? মাও বাসায় একা থাকে। একটা অন্তত আসুক আগে।
লিমার কণ্ঠে স্পষ্টই বিরক্তি, বিয়ে হতে না হতেই পায়ে বেড়ি পরাতে চাইছ? নতুন চাকরিতে ঢুকলাম। এখনো পারমানেন্ট হইনি।
চাকরি নিয়ে এত ভাবো কেন? তোমার চাকরি না হলেও কি আমাদের চলত না?
এ যুগে কোনো শিক্ষিত মেয়ে কি স্বামীর ওপর ভর করে শুধু মা হওয়া আর বাচ্চাকাচ্চাদের সামলানোর মধ্যে নারীজীবন সার্থক ভাবতে পারে? বিয়ের আগে তোমাকে বলিনি, আমি অবশ্যই কিছু একটা করব।
চাকরিতে ঢুকে লিমা যে এতটা নারীবাদী ও স্বাধীনচেতা হয়ে উঠবে, লস্কর আশা করেনি। স্ত্রীকে ত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি দেখাতে বলে সে, একটা কেন, প্রয়োজনে একশবার কিছু একটা করার স্বাধীনতা তোমার আছে লিমা।
ধন্যবাদ। তুমি না চাইলে এ চাকরিটাতে ঢোকাই হতো না। চাকরিটাতে এত সুযোগ-সুবিধা, কিন্তু টিকবে কি না বুঝতে পারছি না বুঝলে। বেশ টেনশনে আছি।
কেন, কী হলো আবার?
এমডি থেকে শুরু করে অনেকের মন যুগিয়ে চলতে হয়।
ঘরে আমার মতো ভালো মানুষ স্বামী, আর অফিসে তোমার পুরনো বন্ধু এক্স পক্ষে থাকলে সব ম্যানেজ করতে পারবে তুমি। সে যোগ্যতা তোমার আছে।
লিমা লস্করের শ্লেষটাকেও সহজভাবে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, সেটাই তো বড় ভরসা।
বাদ দাও তো এখন অফিসের চিন্তা। এদিকে ফিরে শোও।
বড় ভরসার জায়গা থেকে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করে নিজের করে পেতে চায় লস্কর। সন্দেহজনক শত্রুকে তাড়াতে আলিঙ্গনে বেশ শক্তিও প্রয়োগ করে। এমনভাবে জড়িয়ে রাখে, যেন শত্রুর ছায়া পর্যন্ত স্ত্রীর দেহমনে ঘেঁষতে না পারে। কিন্তু লিমা বিরক্ত হয়, ধ্যাৎ! এমন জানোয়ারের মতো করছ কেন আজ?
বউকে কন্ট্রোল করতে ভালোমানুষ স্বামীর মাঝেমধ্যে জানোয়ার হওয়া ভালো। লস্করের এই জবাব শরীরী ভাষায় সোচ্চার হয়ে উঠলে, তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় লিমা। বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে, ঝটিতি ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বারান্দায়।