:: আনিসুল হক ::
স্বাধীনতা দিবসের কবিতা
তাঁরা আমাদের দেশ দিয়ে গেছেন
পতাকা দিয়েছেন,
মানচিত্র দিয়েছেন।
আমাদের আগের প্রজন্ম,
তাঁরা তাঁদের কাজ করে গেছেন।
আমি তো ফারুক ইকবালের গল্প জানি,
তিনি আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র ছিলেন,
১৯৭১ সালের মার্চের তিন তারিখে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যাওয়ার জন্য মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিলেন মালিবাগ থেকে,
রামপুরা টিভিভবনের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল,
চালাল গুলি,
রাস্তায় পড়ে গেলেন ফারুক ইকবাল।
পানি, একটু পানি—আর্তি শোনা গেল,
জনতা ছুটল পানির খোঁজে,
ফিরে এসে দেখল ফারুক ইকবাল বুকের রক্ত দিয়ে কালো রাজপথে
লেখার চেষ্টা করছেন ‘জয় বাংলা’।
আমি তো কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের কথা জানি, ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ভোরে
পাকিস্তানি মিলিটারি তাঁর বাড়ি ঘেরাও করল,
বুটের শব্দ খট খট খট,
দরজায় আঘাত ঠক ঠক ঠক,
তিনি দরজা খুললেন,
তারা বলল, বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ,
তিনি বললেন, এক দফা জিন্দাবাদ,
তারা বলল, বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ,
তিনি বললেন, স্বাধীনতা…
আমাদের বড় ভাইয়েরা হাসতে হাসতে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের ভালো রাখার জন্য
আমাদের একটা নির্ভয় দেশ দেবেন বলে…
আমি একজন নারীর কথা জানি,
যিনি একটা পুকুরের পাশে কাপড় কাচছিলেন,
সেই পুকুরে পানার নিচে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে লুকিয়ে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।
মিলিটারি বলল, মুক্তি কিধার হ্যায়,
নারীটি বললেন, দেখিনি,
মিলিটারি চলে যাচ্ছিল,
হঠাৎ নড়ে উঠল পানা,
মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলল সেই নারীটিকে।
যেমন এক নারী ভোরবেলা গ্রাম্য কুটিরের দুয়ারে
বসে কোরান শরিফ পড়ছিলেন,
ভেতরে ছিল মুক্তিযোদ্ধারা,
পাকিস্তানি মিলিটারি ওই ঘরের দুয়ার থেকে ফিরে গেল,
মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদে সরে গিয়ে আক্রমণ করল পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর,
ফেরার পথে মিলিটারিরা জ্বালিয়ে দিল ওই বাড়ি,
শহীদ হলেন সেই নারী।
আমি একজন বাবার কথা জানি।
তাঁর একমাত্র ছেলে নারায়ণগঞ্জে অপারেশনে এসে শহীদ হলো।
মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সেই খবর দিল, কাকা, আপনার ছেলে শহীদ হয়েছে।
তিনি কাঁদতে লাগলেন। বললেন, আমি এ জন্য কাঁদছি না যে আমার একমাত্র ছেলে শহীদ কেন হলো?
আমি কাঁদছি এই জন্য যে আমার কেন একটা মাত্র ছেলে।
আজ আরেকজন ছেলে থাকলে তো আমি তাকে যুদ্ধে পাঠাতে পারতাম।
আমি একজন বোনের কথা জানি।
একাত্তরে তার পেটে গুলি লেগেছিল। তাকে নেয়া হয়েছিল
আগরতলার হাসপাতালে।
রক্ত দরকার। রক্ত জোগাড় করা যায়নি,
ডাক্তারের হাত ধরে তিনি বলেছিলেন, দাদা, আমি তো মারা যাচ্ছি,
আপনি কথা দেন যে দেশটাকে স্বাধীন করে যাবেন।
আমি একজন মায়ের কথা জানি।
তাঁর একমাত্র ছেলে আজাদ যুদ্ধে ধরা পড়ার পর তাঁর কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। মা বলেছিলেন, শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।
মা ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন রমনা থানায়।
ছেলের দেখা পাননি। এই মা আরও ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন। আর কোনো দিনও ভাত খাননি।
আমাদের মায়েরা হাসতে হাসতে তাঁদের ছেলেমেয়েদের উৎসর্গ করে ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য।
আমাদের বাবারা তাঁদের ছেলেমেয়েদের উৎসর্গ করে ছিলেন আমাদের স্বাধীন করে যাবেন বলে।
আমাদের বড় ভাই ও বোনেরা নিজেদের জীবন আমাদের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করে রেখে গিয়েছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তর সালে ঘড়ির কাঁটায় সব সময় বাংলাদেশের টাইম রেখে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, আপনাদের মনে আছে, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব।
তিনি তাঁর কথা রেখেছেন…
আমাদের পিতৃপুরুষগণ তাদের কাজ করে গেছেন।
আমরা পেয়েছি
দেশ
আমরা পেয়েছি
ভাষা
আমরা পেয়েছি
পতাকা
আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা
আমরা পেয়েছি এগিয়ে চলার প্রেরণা আর দীপনা
অনেক রক্ত
অনেক অশ্রু
অনেক ত্যাগ
অনেক কষ্ট
অনেক ভালোবাসা দিয়ে
তাঁরা তাঁদের কাজ করে গেছেন
এবার আমাদের কাজ আমাদের করতে হবে
পিতৃপুরুষের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে
আমাদের যুদ্ধ যেতে হবে না
আমাদের রক্ত দিতে হবে না
আমাদের তাই করতে হবে যা আমাদের সবার ভেতরে আছে
দেশের জন্য ভালোবাসা
আমাদের নিজেদের কাজটুকু ঠিকঠাক করে যেতে হবে
আমরা যে অক্সিজেন নিই, তা আমাদের দেশমায়ের বাতাস থেকে নিই
আমরা যে অন্ন গ্রহণ করি, দেশমায়ের শরীর থেকে আসে তা
এই দেশের অন্ন পানি বায়ু আমাদের পুষ্ট করেছে
আমার মায়ের কাছে আমাদের যত ঋণ, তা আমাদের শোধ করতে হবে
আমাদের ভাইয়ের কাছে আমাদের যত ঋণ, তা আমাদের শোধ করতে হবে
আমাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আমাদের যত দায়, সব শোধ করতে হবে
আমাদের যুদ্ধে যেতে হবে না
আমাদের রক্ত দিতে হবে না
আমার নিজেকে আলোকিত করতে হবে
১৬ কোটি প্রাণে যদি আলো জ্বলে ওঠে
আলোয় আলোয় ভরে উঠবে এই দেশ
আমরা নিজেদের গড়ব আলোয় আলোয়
আমরা ন্যায়ের পথে চলব আলোয় আলোয়
অন্যায়ের প্রতিবাদ করব আলোয় আলোয়
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
অযুত নিযুত প্রাণের প্রদীপে কোটি কোটি জ্বলে জয়
শহীদের দানে পুণ্য স্বদেশ
নেই তার পরাজয়
মাথা নোয়াবার নয়।