আলী রীয়াজ :: রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানে কি পরিবর্তন ঘটেছে? এই প্রশ্নটি উত্থাপনের তাগিদ তৈরি হয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশের নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের কারণে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে সম্প্রতি যে একাধিক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, সেটা লক্ষ করলেই বোঝা যায়। সেই পটভূমিকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন, তা আমাদের মনোযোগ দাবি করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পটভূমি আগে উল্লেখ করা দরকার। রোহিঙ্গা সংকটে নতুন যেসব মাত্রা যোগ হয়েছে, তার একটি হচ্ছে ভারত থেকে কার্যত বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশ। ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই ভীতি তৈরি করতে পেরেছে যে তাদের জোর করেই মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই পদক্ষেপের কারণ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, মুসলিম বিদ্বেষ ও বিদেশিভীতি। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টিও যে তার পেছনে কাজ করছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না; উদ্দেশ্য সেটা যদি না–ও থাকে পরিণতি যে তা হচ্ছে, সেটা দুর্লক্ষ্য নয়। দ্বিতীয় নতুন মাত্রাটি হলো, মিয়ানমার থেকে শুধু মুসলিম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গারাই পালিয়ে আসছে না, সম্প্রতি ‘চীন’ ও ‘রাখাইন’ রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন, খুমি ও খ্যও সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী নারী, পুরুষ ও শিশুরাও পালিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তাদের অনেকে সীমান্তের শূন্যরেখা বরাবর বান্দরবান সীমান্তে অবস্থান করছে, কেউ কেউ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তৃতীয় মাত্রাটি হচ্ছে জাতিসংঘের শরণার্থী–বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) আহ্বান। কমিশন এই নতুন শরণার্থীদের প্রবেশের সুযোগ দিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত খুলে দেওয়ার জন্য ঢাকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গত শুক্রবার।
এসবের বাইরে ঘটছে আরও ঘটনা, যা গণমাধ্যমে খুব সামান্যই উল্লেখ হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে মানব পাচারের শিকার হচ্ছে, তা এখন স্পষ্ট। গত শুক্রবার পাচারের হাত থেকে সাতটি শিশুসহ ৩০ জনকে উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। রয়টার্সের ৫ ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, এ ধরনের পাচারের হাত থেকে উদ্ধার হয়েছেন একজন যশোরে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে। ঢাকা ট্রিবিউন–এ ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত একাধিক ঘটনার কথা উল্লেখ আছে, যেখানে পাচারকারীরা হয় এদের মাঝপথে ফেলে রেখে গেছে, নতুবা বিজিবি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে। যারা উদ্ধার হচ্ছে তাদের কাহিনি বলে দিচ্ছে যে আরও অনেকেই উদ্ধার হচ্ছে না। সংকটের শুরু থেকেই এ ধরনের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। আইএমওর পক্ষ থেকে জুলাই মাসে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মানব পাচার ও সেক্স ট্রাফিকিংয়ের ঘটনা এখন বাড়ছে, কেননা সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী শুধু যে মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যে আছে তা নয়, এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির আরও অবনতির কারণে তাদের ফেরার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছে।
এই পটভূমিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম বিদেশ সফরে গিয়ে নয়াদিল্লিতে প্রস্তাব দিয়েছেন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘সেফ জোন’ বা সুরক্ষাবলয় তৈরি করে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক এবং তার দায়িত্ব নিক ‘মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো’—ভারত, চীন ও আশিয়ান সদস্যভুক্ত দেশ (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। যদিও একে ‘নতুন প্রস্তাব’ বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে প্রস্তাবটি নতুন নয়, তবে তা বাংলাদেশের অবস্থানের ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করার অবকাশ আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরণার্থী সংকটের গোড়াতে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে যে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার ৩ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘জাতিধর্ম–নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা।’ প্রধানমন্ত্রী ওই সময়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শরণার্থী সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে যে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেখানে এবং ওআইসি কন্টাক্ট গ্রুপে দেওয়া ছয় দফা প্রস্তাবেও এই প্রসঙ্গ ছিল। সুরক্ষাবলয়ের এ প্রস্তাব উত্থাপনের সময়ে এটা অবশ্যই বোঝা যাচ্ছিল যে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন না করার কারণে এই ধরনের প্রস্তাব জাতিসংঘে পাস হবে না। যদিও ‘সুরক্ষাবলয়’ বা সেফ জোনের অভিজ্ঞতা সব সময়ই ইতিবাচক নয়, তবু এর কোনো বিকল্প না থাকায় একে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় অন্যদের সহযোগিতায় এ ধরনের সেফ জোনের বিষয় বিবেচনা করা উচিত বলেই আমার মনে হয়েছিল, যা আমি ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম। আমি লিখেছিলাম, ‘জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান ছাড়া “নিরাপদ এলাকা” প্রতিষ্ঠা দুরূহ, এই বক্তব্যকে একেবারে নাকচ না করে দিয়ে বলা যেতে পারে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন বা শক্তি প্রয়োগকে অত্যাবশ্যক মনে করারও কারণ নেই। যদিও বাংলাদেশের প্রস্তাবে “জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে” এই সুরক্ষাবলয়ের কথা বলা হয়েছে, অতীতে এ ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সম্মতিতে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের উদ্যোগে সেফ জোন প্রতিষ্ঠারও উদাহরণ আছে।’ আমি প্রাসঙ্গিকভাবে বলেছিলাম ‘মিয়ানমারের সমর্থক চীন, ভারত ও রাশিয়াকে বাদ দিয়ে সংকট সমাধান প্রচেষ্টার সাফল্যের আশা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না।’ (লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করবে কূটনৈতিক সাফল্যের ওপর, প্রথম আলো, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭)।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলেও বাংলাদেশ এ নিয়ে আর কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে বলে শোনা যায়নি। উপরন্তু আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে যখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশ ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে একধরনের সমঝোতায় উপনীত হয়। বোঝাই যাচ্ছিল যে রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিকীকরণের পথ বন্ধ করাই মিয়ানমারের কৌশল। একই ভাবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ার অনুকূলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সময়ে মিয়ানমার আবারও প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়ে আট হাজার শরণার্থীর একটি তালিকা অনুমোদন করে। ফলে মিয়ানমার একে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে রাখার যে চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে এবং এর বিকল্প থেকে সরে এসেছে।
যখন একদিকে আন্তর্জাতিক সমাজ, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হয়েছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের বন্ধুদেশগুলো এ দেশটির বদলে বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়েছে, তখন বাংলাদেশও খুব কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে—তার প্রমাণ নেই। বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপের অভাবের কারণে লাখ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশেই থেকে গেছে এবং সমাধানের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়াকে ক্ষমতাসীন দল যে কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে, তা–ই নয়, দেশের ভেতরের অগণতান্ত্রিক আচরণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমার এ নিয়ে বাংলাদেশের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। এখন আরও শরণার্থী বাংলাদেশ অভিমুখী হয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ‘মিয়ানমারের বন্ধুদের’ কাছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সুরক্ষাবলয়ের প্রস্তাব দেন, তখন তা এত দিনের অবস্থান থেকে আপাতদৃষ্টে ভিন্ন, কিন্তু অতীতে প্রধানমন্ত্রী আগে এই প্রস্তাব দেওয়ার পরেও সেই বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে প্রশ্ন জাগে, এটি কেবল কথার কথা কি না। বাংলাদেশ যদি দ্বিপক্ষীয় সমাধানের বাইরে গিয়ে আঞ্চলিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার এই প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গেই দিয়ে থাকে, তবে তার অনুকূলে অবিলম্বে জোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে এটাও সুস্পষ্ট করতে হবে যে এই নতুন প্রস্তাবে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা কী হবে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব কী হবে, ডিসেম্বর মাসে যে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে, তাকে কীভাবে এই ধরনের উদ্যোগে যুক্ত করা হবে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা কার্যত দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য মিয়ানমারের বন্ধুদের উৎসাহ নেই, যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেটি পশ্চিমা দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আগ্রহের কারণে। এ ধরনের চাপ ছাড়া মিয়ানমার কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেবে না, সেটা অতীতে দেশটির আচরণেই স্পষ্ট। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ও কার্যক্রম সুস্পষ্ট রূপ দিতে হবে। অন্যথায় এটিকে একটি চমকের চেয়ে বেশি কিছু বলে মনে হবে না।