নিজেকে আড়াল করা…
কানাডিয়ান মানুষ অনেক ভদ্র এবং বিনয়ী এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। মানুষের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন কিছু স্তর আছে- শৈশব, কৈশর, তরুণ, যুবা, বয়স্ক, বৃদ্ধ। সময়ের সাথে সাথে অধিকাংশ মানুষই এভাবেই তার জীবনচক্র শেষ করেন। অধিকাংশ এ জন্যই বললাম, কারণ সৃষ্টিকর্তা সবার জন্য সবকিছু একরকম করে ঠিক করেননি। অন্য সবার মতো আমিও নিজে ও এই জীবনচক্রের শেষ পর্যন্ত যেতে চাই।
আমার চার পাশের বেশিরভাগ মানুষই অনেক পজিটিভ। যারা নেগেটিভ আছেন তাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগও নেই। সবাইতো আর একরকম হয় না। আমার নিজেকে বেশ পজিটিভ একজন মানুষ মনে হয়, কোনো নেগেটিভ কিছু হলে সহজে ভেঙে পড়ি না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে থাকি। সফল না হলে ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করি।
আম্মু বেশ কিছু দিন অসুস্থ। কিছুই খেতে পারছিল না। আম্মুর মিষ্টি অনেক পছন্দ ছিল। একদিন নিজে মিষ্টি কিনে বাসায় এনে আম্মুকে খাওয়ালাম। সেই রাতেই আম্মুর হার্ট অ্যাটাক হলো। হাসপাতালে আম্মুকে নিয়েছিলাম ১৪ দিন। এর মধ্যে একদিনও হাসপাতাল থেকে বের হইনি, চোখের আড়াল হতে দেইনি একবারের জন্যও। এক একটি ইনজেকশনের খোঁচা যেন আমার নিজের কাছে বল্লমের খোঁচার মত মনে হত। ইনজেকশনের খোঁচায় আম্মুর দুটো হাত আর দুটো পায়ের পাতা কালো হয়ে গিয়েছিল। ব্যথায় আম্মুর চোখ দিয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়ত। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম আর মনে মনে বলতাম, আম্মু, আমার ভালোবাসায় কোনো অন্যায় ছিল না। জানি থাকলেও আম্মুর চোখের পানি আড়াল করে আমাকে ক্ষমাই করে দিত।
জীবনচক্রে আম্মু এখন বয়স্ক। সময়ের আর জীবনের প্রয়োজনে এখন আমি আম্মুর থেকে অনেক দূরে, ঠিকমত কথাও হয় না প্রতিদিন। মাঝে মাঝে যখন শুনি আম্মুর শরীর ভালো নেই, বুকের কোনো এক কোণে শূন্যতা ভর করে। মস্তিষ্কের এক কোণে এক যুগ আগের সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে। কিন্তু ঠিক আগের মত অস্থিরতা প্রকাশ করার সুযোগ, সময় আর পরিস্থিতি এখন আর আমার নেই। কারণ আমি এখন কানাডিয়ানদের মতো ভদ্রতা আর বিনয়ের সাথে নিজের অনুভূতি আড়াল করতে শিখে গেছি। শিখে গেছি ভুলে থাকতে কিছু প্রিয় মুখ। আমি শিখে গেছি অপ্রিয় সত্যকে আড়াল করতে। শিখে গেছি কীভাবে ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করতে।
লেখক: মাঈনুল বাশার, কানাডা প্রবাসী