:: মো. সাইফুদ্দিন তালিব ::
ভৌগোলিকভাবে আমাদের দেশটা এমন একটা অংশে যেখানে প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধর্মে বিশ্বাসী। অন্যদিক থেকে ভাবলে এটা এখানকার ঐতিহ্যও বটে। যা ধারণ করে আমরা সভ্য-ভদ্র, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল জাতি হিসেবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের সুনাম অর্জন করেছি। এ ধর্ম-বিশ্বাস বা আদর্শ হঠাত্ করে কিংবা আধুনিকতার ছোঁয়ায় যেমন সৃষ্টি হয়নি, তেমনি কোনো সম্প্রদায় যারা এ সম্পর্কে গবেষণা করে না কিংবা জ্ঞান রাখে না তাদের প্রাণপণ চেষ্টায়ও হারিয়ে যাবে না। আমরা বাঙালি জাতি অন্য জাতিকে আপনজন কিংবা সহযাত্রী মনে করি। যারা করে না তাদের সংখ্যাটা একেবারেই নগণ্য। বিপদে-আপদে একে অপরের জন্য সবই উত্সর্গ করি। অতীত ইতিহাস জ্বলন্ত নিদর্শন, পরবর্তী অতি ভদ্রলোকরা শিক্ষা নিতে পারেন। এখানে সময় হলে কেউ মসজিদে, কেউ মন্দিরে, কেউ গির্জায় নিজস্ব ইবাদত বা প্রার্থনায় মগ্ন হয়। স্রষ্টার দয়ায় সিক্ত হয়ে নির্জলা প্রাণ নিয়ে সবার কাছে ফিরে আসে। যে নির্জলা প্রাণে ঠাঁই করে নেয় অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা। পৃথিবীর সবগুলো ধর্মেরই ঘুরে-ফিরে একই উদ্দেশ্য— মানবজাতিকে কল্যাণের পথে ধাবিত করা। এর বিকল্পও কেউ ভাবতে পারে। ভাবলেও মানুষ যে সবার উপরে—একথা কেউ অস্বীকার করে না। মানুষ সবার উপরে বলেই অকারণে, অন্যায়ভাবে তাকে অধর্মের পথে পরিচালিত করা যেমন চরম অন্যায়, ঠিক একইভাবে তাকে অকারণে হত্যা করাও পাপ।
আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও জাতীয় চেতনাবোধ অন্যদের থেকে কখনও নিম্নমানের ছিল না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক উন্নত—এ বার্তা ছেলে-মেয়েদের প্রাণে গেঁথে দিতে হবে। কড়া নজর রাখতে হবে ঐসব নাটক, সিনেমা, গান, প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, কিংবা সংবাদের উপর যেগুলো নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির অমর্যাদা করে, অন্যদের প্রতি ঝোক বাড়ায় কিংবা আকৃষ্ট করে। এগুলো থেকে কোমলমনা বাচ্চাদের মনে নিজ দেশ ও মানুষের প্রতি অবজ্ঞা তৈরি হয়। টান বাড়ে সীমানার বাহিরে কী আছে তার উপর। যে প্রাণ সীমানার ওপারে থাকে তার দেহটা এখানে মৃত। এই শ্রেণির দেহগুলো সবকিছুতে নেগেটিভ দেখতে পায়। ফলে দেশ ও জাতির মূল স্রোত থেকে নিজেদের ভিন্নভাবে এবং ভিন্ন পথ ও মতের আবিষ্কার করে। এ পথ ও মত বাঙালি জাতির অবিরাম সম্প্রীতির মাঝখানে কখনো কখনো কাঁপন তৈরি করে। আমাদের সম্প্রীতির মাঝখানে কাঁপন তৈরি করতে পারলেও ছেদ তৈরি করতে পারেনি কখনো। কিছু বর্ণচোরারা অন্য জাতির মাঝে বিচ্ছিন্ন মত ও পথ খুঁজে তাতে নানাভাবে ফুয়েল (জ্বালানি) দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে। এ ফুয়েল ও পৃষ্ঠপোষকতার বড় অংশ আমাদের সামনে দিয়ে ছদ্মবেশে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট হয়। অন্য জাতি কোনোদিন যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তার মেডিসিন আর পৃষ্ঠপোষকতা ইনভেস্ট করে। একটি জাতির মাঝে গ্রহণযোগ্য ঐতিহ্য, লালনযোগ্য সংস্কৃতি ও অগাধ সম্প্রীতি বেঁচে থাকলে তাদের কখনো দমিয়ে রাখা যায় না।
আত্মীয়-স্বজনের ছোট ছেলে-মেয়ে কিংবা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায়ই বলতে শুনি, “এখানে (দেশে) থেকে কিছুই হবে না। ইউরোপ বা আমেরিকায় চলে যাবো, ওখানকার পরিবেশই ভিন্ন,” ইত্যাদি। এ ধরনের অতিলোভী আত্মঘাতী চিন্তা-চেতনার দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে ওদের কেউ কেউ রাষ্ট্রের বিধি-বিধান ও ঐতিহ্যে খাপ খাওয়াতে পারবে না এবং আরো দূরে সরে যাবে। দায়িত্বটা সরকারের হলেও এখানে বাবা-মারও ভূমিকা আছে। ছোট বেলা থেকেই বাঙালি জাতির গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের টেকসই চিত্র তাদের চোখে একে দিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন, আতিথেয়তা, অন্যের প্রতি মমতাবোধ আর ভালোবাসার নানা দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে মগজের ফাইলে ইনপুট করে দিতে হবে। যাতে অন্যদের ক্যামেরার অংশ বা আর্টিফিসিয়াল আচার-আচরণ দেখে নিজেদের আত্মসম্মানবোধ বিক্রি করে না দেয়।
লেখক : গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা
ই-মেইল: saifuddin1006@gmail.com