ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: সামনের নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, নির্বাচনটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে কি না, তার কোনো নিশ্চিত জবাব এখনো নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতি নির্বাচনী হাওয়ার গতি বা তাপ কমাতে পারছে বলে মনে হয় না। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে-এমন আশার সূত্রেই এই লেখা।
নির্বাচন মানেই রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের সামনে হাজির হওয়া। ভোট পাওয়ার আশা করলে ‘কিছু নিয়ে’ তাদের সামনে দাঁড়াতে হয়। জনগণের মধ্যে যাঁরা কোনো না কোনো দলের সমর্থক, তাঁরা সাধারণত সব অবস্থাতেই নিজের দলের প্রার্থীকে ভোট দেন। এর বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরাই আসলে নির্বাচনের ফলাফল ঠিক করেন। কারণ, সময়ে-সময়ে তাঁরা অবস্থান বদল করেন। এই মানুষগুলোর ভোট নিজেদের পক্ষে নেওয়াই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁরা দেশের মোট ভোটারের কম-বেশি কত শতাংশ, তা আমরা ধারণা করতে পারি আগের নির্বাচনগুলোর পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে এ ক্ষেত্রে বিবেচনার সুযোগ নেই।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নব্বইয়ের পর যে নির্বাচনগুলোকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা যায়, সেগুলোর ফলাফল বিবেচনায় বলা যায়, মিত্রদেরসহ দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থনের হার কম-বেশি ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। সেই হিসাবে এমন ভোটার প্রায় ৮০ ভাগ। এর বাইরের লোকজন, মানে প্রায় ২০ ভাগের মতো ভোটারের বেশি অংশ যেদিকে যায়, সেই দলই ভোটে জেতে।
একটি মোটামুটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কোনো দলকে জিততে হলে নিজেদের ৪০ ভাগ ভোট ঠিক রাখার পাশাপাশি এই ২০ ভাগ ভোটারের একটি বড় অংশকে টানতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে তেমন একটি নির্বাচন হলে এই দল দুটি বা তাদের জোট কী আশ্বাস, কী সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি বা চমক নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে? এবং এই ২০ ভাগ ভোটারকে নিজেদের পক্ষে টানতে চাইবে? এই ভোটারদের বিচার-বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিন। কারণ, এখানে নতুন ভোটার যুক্ত হন, যাঁরা প্রথমবারের মতো ভোট দেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়া আঁচ-অনুমান করা সহজ নয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মূল স্লোগান ছিল ‘উন্নয়ন’। দলটি বলতে চেয়েছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে আবারও তাদের ভোট দিতে হবে। আর রাজনৈতিকভাবে দলটি তখন ‘স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি’ ইস্যুটিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রতি তরুণ জনগোষ্ঠীর সমর্থন বিবেচনায় নিয়ে দলটি তা করেছে। আবার পাল্টা শক্তি হিসেবে হেফাজতের জনসমর্থন বিবেচনায় নিয়ে ‘ইসলাম’ ইস্যুকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। বিএনপি সেই নির্বাচন বয়কট করায় ও একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোট হওয়ায় আওয়ামী লীগের এসব কৌশল কাজে দিয়েছে কি দেয়নি, তা বলা যাচ্ছে না।
দলের নেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে সামনের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ উন্নয়নকে মূল ইস্যু হিসেবে তুলে ধরবে। কিন্তু কোন দল ক্ষমতায় থাকবে বা থাকবে না-এই হিসাব-নিকাশে ‘উন্নয়ন’ ইস্যুর চেয়ে ‘রাজনীতির’ বিবেচনাই বড় হয়ে দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ দুই দফা ক্ষমতায় থেকেছে, এবার তৃতীয় দফা ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যেহেতু জনগণ প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ পায়নি, তাই সামনের নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হলে জনগণের কাছে তা একটি বড় ‘রাজনৈতিক ইস্যু’ হিসেবে হাজির হবে। আমেরিকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চমাত্রায় ও ২৯ ভাগ মধ্যমমাত্রায় রাজনীতি-সক্রিয়। এর মানে দাঁড়ায় দেশের ৯৪ ভাগ মানুষই কোনো না কোনো মাত্রায় রাজনীতি-সক্রিয়। শুধু ‘উন্নয়ন’ ইস্যু সামনের এই অতিমাত্রায় রাজনৈতিক নির্বাচনে ফল না-ও দিতে পারে।
উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯২ সালের ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ দারিদ্র্যের হার ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এ সময়কালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই ক্ষমতায় থেকেছে। নব্বইয়ের পরে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেই যে ক্ষমতাসীন দল দ্বিতীয়বারের মতো জিততে পারেনি, তার কারণ সম্ভবত উন্নয়নের সমস্যা নয়। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতাসীন দলের কিছু স্বাভাবিক মুশকিল থাকে। ক্ষমতায় থাকলে দলের লোকজন দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও নানা অপকর্মসহ স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে পড়ে। সরকারের কোনো অবস্থান বা আচরণও জনগণকে ক্ষুব্ধ করে। নির্বাচন তাদের সেই ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। তখন দলের একনিষ্ঠ সমর্থক ছাড়া যে ২০ ভাগের মতো ভোটার আছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ ক্ষমতায় থাকা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য আরও কিছু বিষয় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সরকার যে কায়দায় সামাল দিয়েছে, তা দেশের তরুণদের একটি বড় অংশকে ক্ষুব্ধ করেছে। অবস্থান বদল করতে পারে-এমন যে ২০ ভাগ ভোটারের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে এই তরুণ বা নতুন অনেক ভোটার রয়েছেন। এমন কিছু প্রতিকূল বাস্তবতায় আওয়ামী লীগকে আবার জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে। কোনো বড় ধরনের চমক ছাড়া এই ভাসমান ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণ ও নতুন ভোটারদের কথা বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ কি পারবে খুব দ্রুতই কোটা সংস্কারের ঘোষণা দিয়ে চমক সৃষ্টি করতে? বা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোনো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে? মন্ত্রী ও সাংসদদের যাঁরা প্রায় ১০ বছর ধরে পদ ধরে আছেন, তাঁদের অনেকের প্রত্যক্ষ বা তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় সহযোগীদের কাজকর্মে স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন ক্ষুব্ধ। জনগণ এই দীর্ঘ সময় তাঁদের অনেকের ক্ষমতার দম্ভ, বিত্ত লাভ, দখলদারি, চাঁদাবাজি ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ এমনকি খুনোখুনিও দেখেছে। এই পরিস্থিতি ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই এক বড় সমস্যা। সম্ভবত এসব কারণেই আওয়ামী লীগের তরফে বেশ বড় সংখ্যার নতুন প্রার্থীর মনোনয়নের কথা শোনা যাচ্ছে। জোটের জন্য আওয়ামী লীগের ৭০টি আসন ছাড় দিতে হতে পারে। বাকি ২৩০টি আসনের মধ্যে ৮০-৯০ এমনকি ১০০ আসনে নতুন প্রার্থী আসতে পারেন বলে কানাঘুষা আছে।
ভাবমূর্তির সমস্যা নেই; বরং নানা কারণে ভালো ইমেজ আছে-এমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণতর ও নতুন প্রার্থীর মনোনয়ন যদি দলটি সত্যিই নিশ্চিত করতে পারে, তবে তা হবে অর্থহীন যেকোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি কিছু। এর মধ্য দিয়ে দলটি শুধু পরিবর্তনের বার্তা নয়; বরং তারা যে সত্যিই ভালো কিছু করতে চায়, তার প্রমাণ নির্বাচনের আগেই জনগণের সামনে হাজির করতে পারবে। তবে আওয়ামী লীগের মতো পুরোনো, নেতায় ভরপুর ও টানা দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা দলের পক্ষে এমন কিছু করা কতটা সম্ভব হবে, তা এক বড় প্রশ্ন।
বিএনপি প্রায় ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এটা যেমন দলটির দুর্বলতা, তেমনি এই ক্ষমতার বাইরে থাকাই আবার নির্বাচনে দলটিকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। দলের মূল নেতা খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত এবং জেলে আছেন। ভারপ্রাপ্ত নেতা তারেক রহমানের সামনেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দণ্ডের খড়্গ ঝুলছে। তফসিল ঘোষণার আগেই সম্ভবত তাঁর শাস্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যু দলের সমর্থকদের বাইরের আলোচিত ২০ ভাগ ভোটারকে কতটুকু স্পর্শ করবে, তা বলা কঠিন। দলটির অতীতের অপকর্মের পাল্লাও ভয়াবহ রকম ভারী। ক্ষমতার বাইরে থেকে এই দীর্ঘ সময়েও তারা তাদের রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন এনেছে বা আনতে আগ্রহী, এমন কোনো প্রমাণ রাখতে পারেনি। সাধারণ ভোটারদের বিএনপির দিকে ঝোঁকার বাড়তি কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারি দলের শাসন পরিচালনায় ব্যর্থতা, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, অপকর্ম ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ ভোটারদের বিরোধী দলের দিকে ঠেলে দেয়। ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সেই সুবিধা পেতে পারে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দমনে সরকারের ভূমিকা-এসব বিষয়কে বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধিতায় সামনে নিয়ে আসতে পারে। বিএনপির অতীতের শাসনামলও এমনই নানা অপকর্মে ঠাসা। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় তা কিছুটা হলেও আড়ালে চলে গেছে। তরুণ ও নতুন ভোটারদের হিসাব-নিকাশে তা বিবেচিত না-ও হতে পারে। ফলে বিএনপিকে আসলে তেমন কিছু নিয়ে মাঠে নামতে হবে না। তার সামনে থাকবে আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরের শাসন।
তবে দল হিসেবে বিএনপি কার্যত নেতৃত্বহীন অবস্থায় রয়েছে। এমন অবস্থায় মাঠে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ হতে চাওয়া কিছু ছোট রাজনৈতিক দলকে। এমন কিছু দল এক হয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেছে। এদের সঙ্গে গণফোরাম থাকবে-এমনটি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। তবে এই দলগুলোর কার্যকর তৃতীয় শক্তি হয়ে ওঠা নির্ভর করবে বিএনপির ওপর। বর্তমানে বেকায়দায় থাকা বিএনপি অনেক ছাড় দিয়ে হলেও তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে-এটাই তাদের আশা। এমন কোনো সমঝোতায় গেলে বিএনপিকে ১০০ বা তার চেয়ে বেশি আসনও ছাড় দিতে হতে পারে। শুধু তাতেই হবে না, যুক্তফ্রন্টের তরফে এটা স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে যে, বিএনপি তাদের সঙ্গে যোগ দিলে এবং নির্বাচনে জিতলেও বিএনপিকে দেশ পরিচালনার ভার বা প্রধানমন্ত্রিত্ব-কোনোটাই দেওয়া হবে না। তারা নির্বাচনের মাঠে নেমেছে কার্যত বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটি সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ওপর ভর করা ছাড়া বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ এখনো একটি অবাস্তব ধারণা। যুক্তফ্রন্ট-গণফোরামের প্রস্তাবে যদি বিএনপি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়, তবে বুঝতে হবে নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোকেই দলটি সবচেয়ে বড় করে দেখছে।
সামনের নির্বাচন নিয়ে এই যে এত আলোচনা, এর তখনই কোনো অর্থ আছে, যদি ভোটাররা আগামী নির্বাচনে অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।