খেলাপি ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে তথ্য: বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ আদায় দুরূহ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: খেলাপি ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ অর্থ আদায় করা ব্যাংকগুলোর জন্য অত্যন্ত দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এটি আরও কঠিন।

মূলত পাঁচটি কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে- ঋণ বিতরণের সময় যেভাবে সম্পদ বন্ধক দেয়া হয় খেলাপি হলে সেই অবস্থায় পাওয়া যায় না, ভুয়া জামানত প্রদান, একই জামানত একাধিক ব্যাংকে বন্ধক রাখা, বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখানো এবং ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনিয়ম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রচলিত আইনি কাঠামোর সুফল না পাওয়া ও এর দুর্বলতা অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব তথ্য পেয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণের বিপরীতে চার ধরনের জামানত নেয়া হয়। গ্রাহকের সরাসরি জামানত, পরোক্ষ জামানত, ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট গ্যারান্টি এবং গ্যারান্টারের জামানত। ঋণ দেয়ার সময় গ্রাহক সরাসরি যেসব জামানত দেন সেগুলো ঋণ দেয়ার সময় যা থাকে, ঋণ খেলাপি হলে আর তা থাকে না। জামানতের মান ও দাম দুটোই কমে যায়। অথচ মান ও দাম বাড়ার কথা।

বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণগুলোতেই এমন অবস্থা দেখা যায় বেশি। ব্যাংক-গ্রাহক যোগসাজশে জামানতের মূল্য বেশি দেখানো হয়, ভুয়া জামানত দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণ নেয়ার সময় এক জামানত দেয়া হয়, পরে খেলাপি হলে ব্যাংক নিলাম করতে গিয়ে পায় অন্য জামানত।

এসব কারণে ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে সম্পত্তি বিক্রি করে যথাযথ মূল্য পায় না। ফলে ঋণের টাকাও আদায় হয় না। বিপাকে পড়ে ব্যাংক। প্রত্যক্ষ জামানত থেকে ঋণ আদায় না হলে ব্যাংক ঝোঁকে পরোক্ষ জামানতের দিকে।

এগুলো সরাসরি ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে থাকে না বলে ব্যাংক নিজের দখলে নিতে পারে না। ফলে বিক্রিও করতে পারে না। কোনো গ্রাহকের ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় করতে পেরেছে- এমন নজির নেই।

এসব জামানত থেকে ঋণ আদায় ব্যর্থ হলে ব্যাংক ঝোঁকে গ্যারান্টারের দিকে। গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নিলেই গ্রাহক মামলা করে ব্যাংকের সব ধরনের উদ্যোগ থামিয়ে দেয়। ফলে গ্যারান্টার পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই যাওয়া সম্ভব হয় না।

প্রচলিত আইন অনুযায়ী, গ্রাহক নিজে ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টারের কাছে চাইতে পারে ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়েই নিষ্পত্তি অনেক জটিল হয়ে পড়ে।

এ ছাড়া তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টার থাকে শুধু ব্যক্তিগত ঋণগুলোতে। প্রকল্প বা বড় ঋণে গ্যারান্টার থাকে না। আর এখন বড় অঙ্কের ঋণগুলোই বেশি খেলাপি হচ্ছে। যেগুলোর বিপরীতে ব্যাংকের কাছে যথেষ্ট জামানত থাকে না।

এ ছাড়া জাল-জালিয়াতির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ জামানতই ভুয়া। ফলে এগুলো থেকে কোনো অর্থই আদায় করতে পারে না ব্যাংক। উল্টো আদায়ের প্রক্রিয়ায় আইনি লড়াই করতে গিয়ে ব্যাংকের অর্থ খরচ হচ্ছে।

এর বিপরীতে কবে নাগাদ ঋণের টাকা আদায় হবে, তা নিশ্চিত হতে না পেরে অনেক ব্যাংক হাল ছেড়ে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো মুনাফা থেকে ঋণের প্রভিশন করে তা অবলোপন করার মতো সহজ পথটিই বেছে নিচ্ছে। এসব কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে আইনি সংস্কারের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বেশকিছু প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে আইনি দুর্বলতাগুলো কেটে যাবে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের জবাবদিহিতাও বাড়বে। একই সঙ্গে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহকের মধ্যেও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা পাবে।

অর্থ আদায়ের আইন নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওই আইনটি প্রয়োগে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। কিছু ধারার দুর্বলতার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে জনগণের আমানত নিলে ফেরত দিতে হবে- ঋণখেলাপিদের এমন একটা বার্তা দেয়া উচিত। এ জন্য আইন কঠোর করতে হবে। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হতে হবে। তাহলে খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি কমবে, এর আগে নয়।

জানা গেছে, জামানত নিয়ে জালিয়াতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের মতো করে জামানতের একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। ব্যাংকগুলো থেকে জামানতের সব ধরনের তথ্য নিয়ে এ ভাণ্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করা এ উদ্যোগের বেশ অগ্রগতিও হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, জামানতের তথ্যভাণ্ডারটি পুরোদমে কাজ শুরু হলে একই জামানত একাধিক ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার প্রবণতা কমানো যাবে। যদি জামানতের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেয়া হয় বা একই সম্পদ ভিন্ন নামে অন্তর্ভুক্ত করা থাকে, তবে তা ঠেকানো কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণের সঙ্গে জড়িত বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের সতর্ক হতে হবে।

Advertisement