জাতীয় নির্বাচন সেনা মোতায়েন নিয়ে ভাবনা

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: জাতীয় বা স্থানীয় যেকোনো নির্বাচনে সরকারবিরোধী দলগুলো সেনা মোতায়েনের দাবি জানায়। পক্ষান্তরে বিপরীত অবস্থানে থাকে ক্ষমতাসীন দল। আর সেনা মোতায়েনের এ দাবিটা মূলত স্থানীয় প্রশাসনের সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রতি পক্ষপাতসুলভ আচরণের ভয় থেকে। ভয়টা অমূলকও নয়। আর তা দিন দিন জোরদার হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে বেসামরিক শাসনব্যবস্থার অব্যাহত দলীয়করণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যত দিন ছিল, তত দিন প্রশাসনে রদবদলের মাধ্যমে তারা একটি নিরপেক্ষ অবস্থান আনত। তা–ও ২০০৬–এর শেষে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা করতে সফল হয়নি। এক–এগারোর পরিবর্তনের পর গঠিত সরকার ২০০৮–এর শেষে জাতিকে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে কোনো নির্বাচনে পরাজিত দলই এটা সুষ্ঠু হয়েছিল বলে মেনে নেয় না। যা–ই হোক সেই নির্বাচনে গঠিত সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। অবশ্য উচ্চ আদালতের একটি রায়ও সামনে ছিল। এরপর ২০১৪ সালে দলীয় সরকার রেখেই অনেকটা একতরফা একটি নির্বাচন হয়। তবে সে সংসদ ১৯৯৬–এর ফেব্রুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে গঠিত সংসদের মতো স্বল্পায়ু হয়নি। পুরো করতে যাচ্ছে মেয়াদ। আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে। নভেম্বরের সূচনাতেই তফসিল ঘোষণার কথা।

সামনের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী মেরুকরণ চলছে। ক্ষমতায় থাকা জোট বরাবরের মতো বলছে, সংবিধানের আওতাতেই নির্বাচন হবে। আর এর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর। মূল বিরোধীপক্ষ চাইছে সংসদ ও সরকার ভেঙে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচন। তারা আরও চায় নির্বাচন কমিশনও ভেঙে দিয়ে একে পুনর্গঠন করা হোক। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, জনমনে শঙ্কা তত ঘনীভূত হচ্ছে। তারা চায় ভোটের অধিকার। চায় শান্তিতে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের সুযোগ। পাশাপাশি অবশ্যই চায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আরও জোরদার হোক। তবে সবচেয়ে বেশি চায় প্রবৃদ্ধির ভাগ যেন মধ্য ও নিম্নস্তরেও পৌঁছায়। আর এসব নিশ্চিত করতে পারে সুষ্ঠু ভোটে নির্বাচিত সরকারই।

সরকারের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা জোরালোভাবে চান নির্বাচনে সেনা মোতায়েন। তাঁদের কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার দাবিও করছেন। আকৃতি আর প্রকৃতি যা–ই হোক, আমরা প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়ক ভূমিকায় দেখেছি। মূলত সেনাবাহিনী এ দায়িত্বে থাকে। দ্বীপাঞ্চল বা উপকূলীয় এলাকায় মোতায়েন করা হয় নৌবাহিনী। প্রকৃতপক্ষে তারা জোরদারভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কমে যায়। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাধারণত জনজীবনের সঙ্গে সব সময় সংশ্লিষ্ট থাকেন না। তাই এ ক্ষেত্রে তাঁদের একটি পৃথক সুবিধা আছে। প্রভাব বিস্তারে প্রত্যাশী প্রার্থী বা তাঁদের কর্মী–সমর্থকেরা তাঁদের কাছে সহজে ভেড়েন না। এ অবস্থা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থার অনুকূলে থাকে।

তবে সেনাবাহিনীকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে মোতায়েন করা হয় না। দেশের ৪০ হাজার ২০০ কেন্দ্রে সরাসরি দায়িত্বে থাকবে পুলিশ ও আনসারই। তবে এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তাবলয়টি আরও জোরদার করা হয় ব্যাটালিয়ন পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সামরিক বাহিনীর মোবাইল ফোর্স ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের মাধ্যমে। কোনো কেন্দ্রে গোলযোগের খবর পেলে এসব ফোর্সের এক বা একাধিক ইউনিট অকুস্থলে হাজির হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ব্যবস্থাটি জটিল। তবে সফল বলে প্রমাণিত। এসব মোবাইল ফোর্স ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সঙ্গে থাকেন বিচারিক বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও। তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচনী আইন বা বিধি ভঙ্গকারী কোনো ব্যক্তিকে অকুস্থলে দণ্ডিত করেন।

এখানে উল্লেখ করা সমীচীন যে, এসব নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সামরিক বাহিনী ছাড়া অন্য সবাই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও ক্ষেত্রবিশেষে গ্রেপ্তার করতে পারে। নবম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সামরিক বাহিনী একই অবস্থানে ছিল। পরে তুলে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন বেসামরিক কাজের দায়িত্ব হামেশাই সরকার সামরিক বাহিনীকে দিচ্ছে। বিদেশে শান্তি মিশনে গিয়েও তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে। জাতীয় নির্বাচনেও তাদের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। তাহলে এ সংজ্ঞায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে দোষ কোথায়? এতে তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ প্রসারিত হবে।

এরপর আসছে তাদের কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার প্রসঙ্গ। কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বলা হয়, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের এরূপ ক্ষমতা দিলে তাঁরা নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যেকোনো জেলায় কর্মরত সব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭ ধারা অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধস্তন। তিনি তাঁদের কর্ম বণ্টন, কর্মস্থল নির্ধারণ ইত্যাদির জন্য একমাত্র কর্তৃপক্ষ। আর একটি জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (যিনি ডেপুটি কমিশনার বা ডিসি বলে অধিক পরিচিত) একজনই থাকার বিধান আছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অধিকতর দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই সেনা কর্মকর্তাদের এ ক্ষমতা দেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। সে ক্ষেত্রে সেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যদি পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা প্রভাবাধীন থাকেন, তাহলে তাঁর আওতায় কাজ করা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও যথাযথভাবে কাজ করতে পারবেন না।

এটা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের জন্যও প্রাসঙ্গিক। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাবের উপশম ঘটাতে না পারলে এ ধরনের দায়িত্ব প্রদান কার্যত কোনো সুফল দেবে কি না, এ নিয়ে সংশয় আছে। ১৯৯১ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি সফল নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর পরিপূর্ণ সমর্থন ফলপ্রসূ অবদান রেখেছে। তেমনি ১৯৯৬–এর ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪–এর জানুয়ারির নির্বাচনেও তাঁরা বেসামরিক প্রশাসনের পাশে ছিলেন। সুতরাং সমস্যাটি অন্যত্র।

আমরা যদি নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি দল ও জনগণের একটি আস্থার ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে না পারি, তাহলে বাহ্য উন্নতিসাধক কোনো ব্যবস্থা প্রকৃত সুফল দেবে না। সংবিধান ও নির্বাচনী আইন নির্বাচন কমিশনকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছে। এ আস্থার স্থানটি তৈরির দায়িত্ব তাদের। এ আস্থার অবস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে কমিশনের কোনো ভূমিকা লক্ষণীয় হচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে একটি দাবি থাকে—প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব না দিয়ে কমিশন কর্মকর্তাদের তা দেওয়া। বলা হয়, তাহলে তাঁরা প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন। তা দেওয়াও হয় অনেক ক্ষেত্রে। দেওয়া হয়েছিল বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতেও। এগুলোর অবস্থা দেখে মনে তো হয় না তাঁরা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তেমনি নির্বাচন কমিশনও নিজেদের ভূমিকাকে জোরদারভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে আমরা দেখেছি আচরণবিধি ভঙ্গের বেপরোয়া বহিঃপ্রকাশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের কর্মী–সমর্থক ও এজেন্টদের এলাকাছাড়া করার দৃশ্যমান চেষ্টায়ও কমিশন ও তার রিটার্নিং অফিসারদের কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। আচরণবিধি ভঙ্গেও কোনো দৃঢ় অবস্থান নেননি তাঁরা। ইদানীং গণমাধ্যমে দেখা গেছে, শত শত ভুয়া মামলা করে কয়েক হাজার লোককে আসামি করা হয়েছে। তা ছাড়া, অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে রয়েছে কয়েক হাজার। সেখানে যে কাউকে ধরে হাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়। নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে। কমিশন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেছে—এমনটাও জানা যায় না। তাহলে তাদের ঘিরে আস্থার স্থান সৃষ্টি হবে কীভাবে?

অথচ এ সম্ভাবনাময় দেশটিতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গড়তে নির্বাচন কমিশনকেই অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার কথা। সরকারের উচিত আন্তরিক সহযোগিতা দেওয়া। সহযোগিতা করা উচিত সব রাজনৈতিক দলের। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী ও দক্ষ নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রয়োজন হবে। বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব, কোস্টগার্ড, আনসার যথেষ্ট দক্ষ। অতীতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। পাশাপাশি সে নিরাপত্তাব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ আরও মজবুত করবে। তাই অতীতের মতো এটা অতি অবশ্যই প্রয়োজন। আর আগে থেকেই নিরাপত্তা পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। এটা নির্বাচনের সাংগঠনিক ব্যবস্থার মতোই একই রকম গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement