বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ জরুরি

শেখ মো. ফয়সাল হোসেন
প্রাচীনকাল থেকেই শ্রবণহীন মানুষের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে ইশারা। বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি বড় অংশও এ ভাষাকে তাদের মতপ্রকাশের অন্যতম বাহন হিসেবে বেছে নেয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় দুই শতাধিক ইশারা ভাষা প্রচলিত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ইশারা ভাষা দেশের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ভাষার উন্নয়ন ও সর্বত্র এর প্রসার ঘটানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। প্রতিবন্ধী মানুষ ও প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে সমাজ ও উন্নয়নের সকল পর্যায়ে বাক্ ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশে শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য দোভাষী নিয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী-বান্ধব হয়ে ওঠার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
এটি অত্যন্ত ইতিবাচক যে, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর তাত্পর্যপূর্ণ প্রভাব পড়ছে। টেলিভিশনে ইশারা ভাষায় খবর পাঠও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে, বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষ এবং তাদের অধিকার বিষয়ে জনমত তৈরি হতে শুরু করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ ও কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জনের জন্য বিশেষ শিক্ষার বলয় পেরিয়ে এখন একীভূত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সমাজে তাদের সার্বিক অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলা ইশারা ভাষার প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ সাধনে বিভিন্ন প্রয়াসের তথ্যও পাওয়া যায়। এসব উদ্যোগ একদিকে বাংলা ইশারা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে নানা অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি করছে। বর্তমানে শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের পাশাপাশি এবং বাংলা ইশারা ভাষা ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ ভাষা বিষয়ে ব্যবহারিক ও ধারণাগত বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান রয়েছে, যা বাংলা ইশারা ভাষার একটি একক রূপের প্রসারে অন্যতম অন্তরায় হয়ে উঠছে। প্রমিত ইশারা ভাষার অভাব এ সংকটকে আরো প্রকট করে তুলছে।
আমাদের কারো কারো ধারণা এই যে, বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষ যে অবাচনিক যোগাযোগ পদ্ধতি ব্যবহার করে, তা আলাদা কোনো ভাষা নয়। বরং নিছক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কোনো কিছু বোঝানোর চেষ্টা মাত্র। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, বাংলা ইশারা ভাষা নিছক অঙ্গভঙ্গি নয়, কিংবা বাংলা ভাষার ইশারা রূপও নয়, বরং বাংলা ভাষার মতই একটি স্বতন্ত্র ভাষা।
যে সকল শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিশু শ্রবণ-প্রতিবন্ধী বাবা-মা’র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, তারা প্রাকৃতিক নিয়মেই ইশারা ভাষা অর্জন করে। মৌখিক ভাষা ব্যবহারকারী শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিশুর বাবা-মায়েদের সাধারণত এই ভাষায় দক্ষতা থাকে না। ফলে, এ সকল পরিবারে জন্মগ্রহণ করা শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষের যোগাযোগের দক্ষতা কেবল গুটিকয়েক গৃহসংকেতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। অঞ্চলভেদে তাই বাংলা ইশারা ভাষার বিভিন্ন রূপ ও সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। এভাবে যোগাযোগীয় ভিন্নতার কারণে শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষের কাঙ্ক্ষিত অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এজন্য বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের করতে বাংলা ইশারা ভাষার একটি একক রূপের প্রসার অত্যন্ত জরুরি। প্রমিতকরণের মাধ্যমে বাংলা ইশারা ভাষার আঞ্চলিকতার জটিলতা ও বিভিন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
প্রকৃত অর্থে, বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণে ভাষা বৈজ্ঞানিক ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে এর বৈশিষ্ট্য, গঠনরীতি ও ব্যাকরণ আবিষ্কার করা প্রয়োজন—যা এখনও করা হয়নি। ভাষা পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলা ইশারা ভাষা ব্যবহারবিধি উন্নয়ন, এ ভাষার বিভিন্ন উপাদান সংকলন ও মুদ্রণ এবং সর্বত্র এ ভাষার প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করাও আবশ্যক। যেহেতু ইশারাভাষীদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে এ ভাষার উদ্ভব, তাই এ বিষয়েও যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ইশারাভাষীরা বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে, কেননা বিশ্বের প্রায় সকল ইশারা ভাষার মতই বাংলা ইশারা ভাষারও লিখিত রূপের প্রচলন ঘটেনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ইশারাভাষী ব্যক্তিদের সঙ্গে সাধারণ যোগাযোগের জন্য মৌখিক ভাষার ইশারা রূপেরও প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশেও বাংলা ইশারাভাষীদের সঙ্গে সহজ যোগাযোগীয় পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সর্বসাধারণের জন্য বাংলা ভাষারও ইশারা রূপের প্রচলন করা সম্ভব। অর্থাত্, বাংলা ভাষার গঠনগত বৈশিষ্ট্য মেনে বাংলা ইশারা ভাষার শব্দ দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা। সেক্ষেত্রে, বাংলা ভাষার বিভিন্ন শব্দের ইশারা জানা থাকলে ও কিছু ব্যবহারিক নিয়ম অনুসরণ করলে বাক ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগে পারদর্শী হওয়া যায়।  আমাদেরকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলা ভাষার ইশারা-রূপ হবে বাংলাভাষী ও বাংলা ইশারাভাষী মানুষের মধ্যকার যোগাযোগ রক্ষাকারী সেতুমাত্র। সরকারের পক্ষ থেকে এ ভাষার উন্নয়ন, প্রয়োগ ও সর্বস্তরে প্রসার নিশ্চিতকল্পে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
amirfaisal18@gmail.com
Advertisement