একাত্তরের বীরাঙ্গনা নারীদের নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন সুরমা জাহিদ। চার খণ্ডে প্রকাশিত বীরাঙ্গনা সমগ্রতে তিনি তুলে এনেছেন ৩৬১ জন বীরাঙ্গনার মর্মস্পর্শী কাহিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এই আয়োজনে স্বাধীনতা দিবসের আগমুহূর্তে নিজের কাজ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ।
আলতাফ শাহনেওয়াজ: প্রায় বিশ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আপনি। বীরাঙ্গনা সমগ্র নামে চার খণ্ডে সেগুলো গ্রন্থিতও হয়েছে। এই কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন কেন?
সুরমা জাহিদ: প্রায় পাঁচ শ বীরাঙ্গনা নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। সব কটি এই চার খণ্ডে নেই। এখানে আছে ৩৬১ জনের কাহিনি। যাহোক, ছোটবেলায় পরিবারের সদস্যদের মুখে যখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম, বীরাঙ্গনার প্রসঙ্গ এলেই সবাই থেমে যেতেন। কথা বাড়াতেন না। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, বড় হও, জানতে পারবে। আমার মনে তখন প্রশ্ন জাগত, কেন বীরাঙ্গনাদের গল্প তাঁরা বলেন না? সেই সময় থেকেই বীরাঙ্গনা সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। পরে সম্ভবত ১৯৯৭ সালে কুড়িগ্রামে এক বীরাঙ্গনার সন্ধান পাই। তাঁর কষ্টের কাহিনি শুনে তাঁদের নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন কিন্তু বীরাঙ্গনারা একদমই মুখ খুলতেন না। এমনকি আশপাশের বাড়ির মানুষেরাও বলতেন না যে এখানে বীরাঙ্গনা আছেন।
আলতাফ: বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলার সময় যখন তাঁরা সহজে আপনার সামনে মুখ খুলতেন না, তখন আপনি কী করতেন? কীভাবে ঢুকতেন তাঁদের মনের গহিনে?
সুরমা: আমি যেহেতু একজন নারী, তাই তাঁদের মনস্তত্ত্ব বুঝে অন্যভাবে তাঁদের গহিনে প্রবেশ করতাম। তাঁদের বলতাম, আমিও একজন মা, একজন বধূ, একজন মেয়ে। আমিও সংসার করি। ফলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়টাও বুঝি। আপনাদের কষ্টও আমি বুঝতে পারি। এসব কথার পর আস্তে আস্তে তাঁরা নিজেদের কষ্টের কথা বলতে শুরু করতেন।
আলতাফ: বীরাঙ্গনা নারীদের দুঃখগাথা প্রথম লিপিবদ্ধ করেন নীলিমা ইব্রাহীম তাঁর আমি বীরাঙ্গনা বলছি বইয়ে। আপনিও প্রায় একই রকম কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে আপনার কাজের পার্থক্য কী?
সুরমা: আঙ্গিকগত দিক দিয়ে নীলিমা আপার সঙ্গে আমার কাজের মিলই বেশি। তবে তাঁর সঙ্গে আমার কাজের মূল ফারাক হলো, তিনি কাজ করেছিলেন স্বাধীনতার পরপর। সদ্য স্বাধীন দেশে বীরাঙ্গনা নারীদের অবস্থা তিনি খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছিলেন। আর আমি কাজ করেছি মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ থেকে। মাঠপর্যায়ে ঘুরে ঘুরে বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করেছি। জানার চেষ্টা করেছি তাঁদের বর্তমান অবস্থা। আর বলা বাহুল্য, একাত্তরের পরের সময় আর এখনকার অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক-সামাজিক নানা দিক দিয়েই রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাই দুজনের কাজেও পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আলতাফ: মুক্তিযুদ্ধের প্রায় তিন দশক পর বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন আপনি। এত দিন পর তাঁদের শনাক্ত করলেন কীভাবে?
সুরমা: আমি সে সময় ইত্তেফাক-এ লেখালেখি করতাম। ইত্তেফাক-এর তৎকালীন সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক রাহাত খানের সহায়তা নিয়ে প্রথম দিকে দুই-এক জায়গায় কাজ করেছি। একপর্যায়ে রাহাত ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তত দিনে আমার আগ্রহ আরও বেড়েছে। তখন আমার স্বামী জাহিদ হোসেনের সহযোগিতায় কাজটা এগিয়ে নিই। তিনি যেহেতু সরকারি চাকুরে, ফলে মাঠপর্যায়ে যখন কাজ করতে যেতাম, তখন তাঁর মাধ্যমে ওই এলাকার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। তারপর ওই কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, চেয়ারম্যান, কমিশনার—তাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিতাম। পরে সেগুলো যাচাই-বাছাই করতাম। বীরাঙ্গনাদের এভাবেই শনাক্ত করেছি। হ্যাঁ, কিছু ভুয়া বীরাঙ্গনার দেখাও পেয়েছি। আদতে আমি কথা বললেই বুঝতে পারতাম কে আসল আর কে নকল। এই বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকারের অনেকগুলো ইত্তেফাক, ভোরের কাগজ ও বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি প্রায় পাঁচ শ বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি বটে, তবে কাজটা করতে গিয়ে আট থেকে দশ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি।
আলতাফ: কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন কি?
সুরমা: বাধার মুখে পড়ার ঘটনা তো আছেই। একবার কাজ করতে গিয়েছি জামালপুরে। কিন্তু কাজ করতে দেবে না বলে কিছু লোকজন আমাকে সেখানে একটা ঘরে আটকে রেখেছিল। ঘটনাটা খুলে বলি: জামালপুরের এক গ্রামে এক বীরাঙ্গনা—যিনি ছিলেন হিন্দু—তাঁকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন একজন। পরে তিনি তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ এসব কথা এখন স্বীকার করতে চান না। তাঁদের ভাষ্য, ঘটনা সত্যও হলেও এগুলো এখন লেখা যাবে না। কারণ, এই ঘটনার সঙ্গে গ্রামের ‘ইজ্জত’ জড়িত।
এই জামালপুরেরই আরেকটা ঘটনা বলি। আরেকজন বীরাঙ্গনা তাঁর কষ্টের কথা বলতে চান, কিন্তু তাঁর স্বামী ও বাড়ির অন্য লোকজন ওই ‘ইজ্জত’-এর কারণেই তাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলতে দেবেন না। পরে রাতের বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে রাতভর জেগে তাঁর গল্প শুনেছিলাম। এ রকমভাবে নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে কাজ করেছি। নিজের নাম প্রকাশ হোক, বীরাঙ্গনাদের অনেকেই তা চাননি। এ ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়েছে। শতাধিক জনের ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছি।
আবার দু-এক জায়গায়—যেমন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে এক বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। তবে এমন ঘটনা হাতে গোনা।
আলতাফ: বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলে সাধারণভাবে তাঁদের কোন কোন বৈশিষ্ট্য আপনার চোখে ধরা পড়েছে?
সুরমা: এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। তারপরও মোটাদাগে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের শিকার হওয়া এই নারীরা স্বাধীন বাংলাদেশেও বারবার নিগৃহীত হয়েছেন—পারিবারিক, সামাজিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবেও। মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা যেভাবে মূল্যায়ন করেছি, তাঁদের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। অপ্রিয় হলেও সত্য হলো, সমাজে আমরা বীরাঙ্গনাদের সেভাবে মর্যাদা দিইনি। একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের অনেকেই চরম অবহেলা আর অর্থাভাবে মারা গেছেন। আমি যখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নিজের নাম-ঠিকানা কেউ সহজে প্রকাশ করতে চাইছেন না, সহজে মুখ খুলতে চাইছেন না। এখন যেসব বীরাঙ্গনা বেঁচে আছেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থাও যথেষ্ট সঙিন। তেমন কোনো চাওয়া নেই কারও। দুবেলা খেয়ে-পরে সম্মানের সঙ্গে মরতে পারলেই যেন তাঁরা খুশি। তবে বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যা মনে হয়েছে তা হলো, নির্যাতনের ভয়াবহতা। একাত্তরের সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাঁরা আজও বয়ে বেড়ান এবং দগদগে এই স্মৃতি নিয়ে অনেকে মারাও গেছেন।
কয়েকজনের ঘটনা আমি বলতে চাই, এতে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। গাজীপুরের শ্রীপুরে এক বীরাঙ্গনা ছিলেন, যাঁর পায়ুপথ ধর্ষণের কারণে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাঁর তেমন চিকিৎসা হয়নি। দীর্ঘদিন অমানবিক কষ্ট সয়ে তিনি মারা গেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের এক বীরাঙ্গনার হয়েছিল ক্যানসার। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে তিনিও গত হয়েছেন। কুমিল্লায় খুঁজে পেয়েছিলাম এক বীরাঙ্গনাকে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল খুবই কম। তাঁকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়। তাঁকে এত বেশি নির্যাতন করা হয়েছিল যে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে যায়। পরবর্তী সময়ে এই মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ঘটনা জানার পর আর সংসার টেকেনি। এ তো গেল বাঙালি নারীর কথা। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীরাও চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে তাঁদের কথা সেভাবে আসেনি। খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাঁচ থেকে ছয় শ পাকিস্তানি সৈন্য ধর্ষণ করেছিল তাঁকে। পরে ওই নারীর পরিবারও তাঁকে আর গ্রহণ করেনি। আজ থেকে সাত-আট বছর আগে আমি যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিই, সে সময় তিনি এক দুর্গম পাহাড়ে একা একা বাস করেন। বীরাঙ্গনাদের জীবনে এ রকম অসংখ্য গল্প আছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবেএই নারীদের নিগ্রহ শেষ হয়নি। স্বাধীন দেশেই পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। এমন কয়েকজন বীরাঙ্গনা নারীর কথা আমি জানি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে যাঁরা পতিতাপল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বীরাঙ্গনাদের অনেকে এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করছেন। হাতে গোনা কয়েকজনই আছেন, যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল।
আলতাফ: বীরাঙ্গনা সমগ্র প্রকাশ করেছেন। এখন সামনের দিনগুলোতে পরিকল্পনা কী?
সুরমা: বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাজ এখনো শেষ হয়নি। তো, এসব নিয়েই এখন পরিকল্পনা করছি। বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই আমাকে ফোন করেন, তাঁদের এলাকার বীরাঙ্গনাদের খোঁজখবর জানান। তাই যাঁদের সঙ্গে এখনো কথা বলা হয়নি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। দ্রুতই এ কাজগুলো করতে চাই। একাত্তরের বীরাঙ্গনা নারীদের বয়স এখন অনেক। একের পর এক তাঁরা মারা যাচ্ছেন। আর পাঁচ-সাত বছর পর তাঁদের কাউকে আর জীবিত পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।