ঈদ মোবারাক প্রিয় পাঠক। পবিত্র ঈদুল ফেতর উপলক্ষে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা কবি, ছড়াকার ও গল্পকারের লেখা নিয়ে ক্ষুদ্র আঙ্গিকে একটি সাহিত্যপাতা আপনাদের সামনে হাজির করেছেন আমাদের সাহিত্য সম্পাদক তালুকদার রায়হান। – সম্পাদক
জলজ ভ্রমণ
আতাউর রহমান মিলাদ
ভাঙতে চেয়েছি জলের জমাট
বিভ্রম কুয়াশা খুলে,
রাতের শিয়রে একজোড়া চোখ
পর্দা দিয়েছে তুলে।
যত্নে জমা প্রেমে অপ্রেমে
ভাঁজ করা যতো ভুল,
দীর্ঘ চুলের গহীন আঁধারে
জ্যোৎস্নায় ফোটা ফুল।
জলের ভেতর জলের উৎসব
জলজ নাভির ঘ্রাণ,
দেহের ভাঁজে গোপন সাঁতার
ঘড়ির কাটায় প্রাণ।
জলের উপর আচড় কাটা মায়া,
হাত বাড়ালেই স্বপ্ন বিভোর ছায়া।
তোয়া কাহিনী
নাহিদা আশরাফী
গল্প শুরুর গল্পঃ
প্রশ্ন উঠতে পারে তোয়া কে? তোয়া আমার ঘরের আকাশ। আমাদের সবার ঘরেই এমন আকাশ থাকে। আমাদের ভুলেই এই আকাশগুলো কংক্রিটের দেয়াল হয়ে যায়।
কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনির মতো জন্মের পর সে খুব বেশি সময় চুপ থেকে নষ্ট করেনি। গাছ, ফুল, পাখি, আকাশ, বাতাস, মাছ, মানুষ তো আছেই বাড়ির দেয়াল, নানামনির গাড়ীর চাকা, বাড়ীর লিফট, বাস, লঞ্চ সবার সাথেই তার বন্ধুতা। নিজের খেলনা গাড়ির চাকা নষ্ট হলে সে নানামনির জীপের চাকাকে প্রশ্ন করে,’ আচ্ছা তোমার বাবুটা এতো ঘন ঘন সিক হয় ক্যানো,হ্যা? সারাদিন এত বাইরে ঘুরলে হবে? ওদের দিকেও একটূ খেয়াল রাখো।’ বাজার থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আমাদের জয়নাল চাচা এক কাপ চা নিয়ে বসতেই তার ধমক, ‘বলি দাদু নিজে একা একা চা খাও। রুই ফিস আর চিকেনকে জিজ্ঞেস করেছো ওরা চা খাবে কিনা?’ এই হলো তোয়া। যার ভালোবাসা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড়ের নিশ্চিন্ত ঘুমের মতন। তো সেই তোয়ার কিছু কিছু কাহিনী, সংলাপ যখন এখনকার সামাজিক নানা অবক্ষয়,অসঙ্গগতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তখন মনে হলো তোয়ার সেই ভালোবাসা আর অবুঝ মনের সহজ প্রশ্নগুলো পাঠকের দরবারে তুলে দেই।
আমি না পারি কেউ তো পারবেন ওর এই সমস্যা আর প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে …
১
শরৎচন্দ্র যখন ড্রাইভার।
– মাম্মাম ওঠ না
– হুম।
– কি হু হু করছো, ওঠ না
– আরে বাবা বলো না কি হয়েছে।
– আচ্ছা শোন, সরি। হ্যা?
– হুম। কিন্তু কি কারনে সরি?
– কাল এই লোকটার বই কিনতে মানা করেছিলাম, তাই। আমি তো জানতাম না লোকটা এতো পুওর।
– কোন লোকটা?
– আচ্ছা একটা কাজ করো না।
– কি?
– নানামনি না লোকটাকে চাকরিটা দিতে চাইছে না। তুমি একটু যাও না। তুমি বললেই নানামনি চাকরিটা ওকে দেবে।
– আচ্ছা।
– কি আচ্ছা আচ্ছা করো। সারা রাত বই লেখে আর দিনে ড্রাইভারের জব করে। আহা কি কষ্ট বেচারার। যাও না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
– এর মধ্যে বাবা ডাকলেন। বাবার ডাকে উঠে গেলাম ওর কথার পাত্তা না দিয়ে। ছোটদের সব কথা ধরতে নেই। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখি তার চোখ ছলছল।
– ইউ আর সো আনকাইন্ড (ক্রুয়েল শব্দটির সাথে তার তখনও অতোটা পরিচয় ঘটেনি)
– কেন? কি করলাম আমি?
– আজ থেকে ও’র বই আর পড়বে না তুমি। তোমার জন্যেই জবটা পেলো না পুওর রাইটার।
– আহা মা ও’র ড্রাইভিং লাইসেন্স নকল। আর কি সব বলো। ও রাইটার কে বল্লো তোমাকে?
– “আমাকে মিথ্যে বলো না। নানামনি জিজ্ঞেস করেছিলো লোকটার নাম। আমি শুনেছি। ও বলেছে,”স্যার আমার নাম শরৎচন্দ্র।” আর এই যে দেখো তোমার বইয়ের রাইটারের নামের জায়গায় ওরই তো নাম।” আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে ওঠার আগেই সে তার কথা বলেই চললো।” আর যে বললে ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স নকল,তো কি হয়েছে? নকল লাইসেন্স দিয়ে যদি এতগুলো বছর গাড়ি চালাতে পারে আর এখন গাড়ি চালাতে পারবে না? আর ওকে রেখেই না হয় আসল ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ব্যাবস্থা করে দিতে। ওকে বিদায় করে দিয়ে কি লাভ হলো?” বলেই ছোট্ট দুটি পায়ে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে কোথায় গেলো কে জানে।
আমি অপার হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষন। অজান্তেই কি রূঢ় সত্যিটা আমায় শুনিয়ে গেলো সে। সত্যিই তো। প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা হয়তো তার নেই কিন্তু অভিজ্ঞতা তাকে যে শিক্ষাটুকু দিয়েছে তাই বা কম কি? আমি ইচ্ছে করলেই তাকে আসল লাইসেন্স এর ব্যবস্থা করে দিয়ে তার জীবিকার পথটা সৎ ও সাবলীল করতে পারতাম। ওর ক্ষুদ্র মগজে যে চিন্তাটুকু খেলা করলো তা আমার প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটধারী মাথায় কেন ঢুকলো না? না এই কাগুজে শিক্ষার চাপে মগজের সত্যিকারের জ্ঞানজ্যোতি তার দ্যুতি ছড়ানোর পথ পাচ্ছে না? এড়িয়ে যাবার কর্দমাক্ত চিন্তা কবে দূর হবে আমাদের?
অনেক ভুখন্ড ও জাতির কর্ণধার তাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের চেয়ে প্রতিষ্ঠালব্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশ ও জাতিকে কয়েক দশক এগিয়ে দিয়েছেন। আমাদের তো সেটুকুরও অভাব। পুরো দেশটার সর্ব অঙ্গেই যখন নকলের ধকল আর অভিজ্ঞতাহীনতার সমৃদ্ধ আবাদ তখন আর ছোট্ট এক গাড়ির ড্রাইভারের নিয়োগ নিয়ে এতো চিন্তা করে কি হবে?
সৎ চিন্তাগুলোও মনে হয় ও’র ছোট্ট পায়ের মতো। মগজে কিছুক্ষনের জন্য ধুপধাপ আওয়াজ তোলে।তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যায় …
২
মমতাময়ী মান্না দে
– মাম্মাম গানটাকে দাঁড়াতে বলো।
– কেন কি সমস্যা?
– আহা বলোই না।
– ও’র সময় নেই।
– না দাঁড়াতে বলো।
এমনিতেই মেজাজ সকাল থেকে খারাপ হয়ে আছে তার মধ্যে এই আবদার আরও মেজাজ গরম করে দিলো। ত বু না শুনে উপায় নেই। কারন এই ক্ষুদে প্রানের এতই শক্তি যে তার কারণে আমার আপন বাবা-মাও আমার সাথে পরপর ভাব ধরে। বকা দেয়া মাত্রই বাবার চেহারা দেখলে মনে এই মাত্র তিনি একটা খুনের আসামী দেখলেন। আর মায়ের চেহারা “কোন কুক্ষণে তোর মতো মেয়ে পেটে ধরছিলাম” টাইপ। তাই বাধ্য হয়ে গানকে দাঁড় করাতে হলো মানে বন্ধ করতে হলো।
– করলাম এবার বল কি বলতে চাস।
– আমি তোমাকে গান বলবো।
– উফ আর কত উল্টাপাল্টা বলবি? গান বলবি না বল গান শোনাবি।
– না আমি শোনাবো কি করে? কান তো তোমার কাছে। শুনে নেবার কাজ তো তোমার।
আমি বলবো ,তুমি শুনে নেবে। গান শিখলে বলতাম গান গাইবো। আমি তো গান শিখিনি। তাই গান বলবো।
হে আল্লাহ চেয়েছিলাম মেয়ে। তুমি দিলা মাস্টার। একে আমি কি শিখাবো? জন্মাবধি সেই আমারে শিখিয়ে যাচ্ছে।
– আচ্ছা বল তোর গান।”
– আমার গান না। মান্না সাহেবের গান। তোমার প্রিয় তাই আমি বলবো। যাতে তোমার মেজাজ ভালো থাকে।
– আচ্ছা শোনা।
কন্যা গান ধরলো — “দ্বীপ ছিলো শিখা ছিলো শুধু তুমি ছিলে না বলে …”
– কি হলো থামলি কেন?
আবার গাইতে চেষ্টা করলো। কিন্তু বারবার ‘তুমি ছিলে না বলে’ থেমে যাচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেনো খুঁজছে। ততক্ষণে আমি পুরাই বিস্মিত, পুলকিত, আনন্দে গদগদ। নাহ মেয়েটা আমার কত খেয়াল রাখে। প্রিয় গান শুনিয়ে মন ভালো করতে চাইছে। কেন যে এতটুকুন মেয়েকেও বকি মাঝে মাঝে। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয়।
– পেয়েছি! পেয়েছি!!
ওর চিৎকারে চিন্তায় ছেদ পড়লো।
– কি পেয়েছিস?
ও সেই স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে বললো,”গানটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে।” আমাকে কোন কথার সুযোগ না দিয়ে গাইতে লাগলো, “দ্বীপ ছিলো শিখা ছিলো শুধু তুমি ছিলে না বলে লাইট জ্বললো না।”
অনেক কষ্টে হাসি থামালাম। বুঝলাম গান থেমে যাবার কারণ। আলো শব্দটি ভুলে গিয়ে যতো বিপত্তি। তবে আমার স্মার্ট কন্যা আলোর সমার্থক শব্দ বের করতে সময় নেয়নি। আর সেই প্রথম আমার মনে হলো, ধুর মান্না সাহেবের চেয়েও কেউ একজন আছে যার কন্ঠে এই গানটা অনেক প্রাণময়।
৩
বিশেষজ্ঞ বিড়ম্বনা
বাবার পড়ার ঘরের চেয়ারটা সবসময় আমার কন্যা রত্নটির দখলে থাকে। সময়টা ২০০৮ এর দিকে। মেয়েকে খুঁজতে বাবার রুমে ঢুকতেই দেখি ফ্লোরে বসেই গভীর মনযোগে তিনি পেপার পড়ছেন। পেপার পড়া শিখে অবধি এটাই তার প্রধান কাজ।
– মা কি করো?
– পেপার পড়ি।
– বাব্বাহ! কি পড়ছো পেপারে?
– ঠিক পড়ছি না মাম্মাম। খুঁজছি।
– কি খুঁজছো?
– একজন ভালো ডাক্তার।
– ওমা!!! কার জন্যে? কি হয়েছে?
– এখানে এসো। পেপারটা হাতে নাও। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা দেখো। একদল আর এক দলকে দোষ দিচ্ছে,একজন আর একজনকে মারছে,শিশুদের টর্চার করছে, মা- বাবাকে কষ্ট দিচ্ছে, ছিনতাই করছে, চুরি-ডাকাতি করছে, অন্যের জিনিস কেড়ে নিচ্ছে। পুরো পেপার জুড়ে এসবই খবর।
– সে না হয় হল। কিন্তু এ জন্যে ডাক্তার কি করবে?
– কাল ক্লাসে টিচার শিখিয়েছেন জ্বরের মাত্রা বেশি হলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়। তখন মানুষ উল্টো পালটা আচরণ করে এবং প্রলাপ বকে এবং নিজের অজান্তেই নিজের এবং সবার ক্ষতি করে। মা আমি কনফার্ম আমাদের দেশের বড় বড় মানুষদের অনেক জ্বর। যার জন্যে এরা উল্টাপাল্টা বকছে ও আজব আজব কাজ করছে। জ্বর তো ছোঁয়াচে তাই সব সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। খুব তাড়াতাড়ি একজন ভালো ডাক্তার দরকার জ্বর নামাবার জন্যে।
বলেই পেপারটা আমার হাতে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে যেতে যেতে বল্লো “একজন ভালো টিচার খুঁজো তো যিনি ভালো করে পড়তে শিখাবেন। লিখতে না শিখালেও চলবে।”
– কি আজব! শুধু পড়তে শিখাবে ,লিখতে শিখাবে না। এ আবার কেমন কথা? যেমন ধুপধাপ করে গেল, তেমনি ধুপধাপ করে ফিরে এলো।
– পেইজ নাম্বার তিন এ দেখো একজন পুলিশ অফিসার আঙ্কেল এক শিশুকে কোর্টে চালান করেছে। শিশুটির বয়স ওখানে উল্লেখ ছিলো। উনি যদি পড়তে জানতেন তবে কি একটি সাত বছর বয়সী শিশুর কোর্টে চালান দেবার কাগজে সই করতে পারতেন? আবার এটা দেখো, দেয়ালে নির্বাচনী প্রচারণা হচ্ছে। অথচ পাশেই ছোট করে লেখা “দেয়ালে লেখা ও পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ”– এটা পড়তে পারলে ও কি লিখতো? তার মানে ও লিখতে পারে। পড়তে পারে না। আবার সাতের পাতায় দেখো এক ডাক্তার আংকেল রিপোর্টে যে অসুখের কথা লেখা আছে তিনি তা না করে অন্য অসুখের ট্রিটমেন্ট করলেন। তার মানে ক্লিয়ার উনিও রিপোর্ট পড়তে পারেন নি। এতো বড় বড় মানুষদেরই যখন এই অবস্থা তখন অন্যদের কি অবস্থা বুঝো। এরপরও কি তোমার সন্দেহ আছে যে আমাদের বেশির ভাগ মানুষ লিখতে পারেন,পড়তে পারেন না। সো এমন একজন টিচার দরকার যিনি ভালো পড়াতে পারেন আর একজন ভালো ডাক্তার দরকার যিনি জ্বর নামাতে পারেন। বুঝলে?
আমি তো যা বোঝার বুঝলাম। প্রিয় পাঠক, আপনারা কি বুঝলেন?
স্মৃতিকাব্য
দিলু নাসের
যতোবার চোখ রাখি স্মৃতি জানালায়
কতো মুখ, কতো চোখ, ডাক দিয়ে যায়।
স্মৃতির ভেতরে আছে অনেক স্মৃতি
কিছুটা রোদেলা আর কিছু ছায়া বীথি।
আছে রোদ, আছে মেঘ, আরো আছে ঝড়
চন্দ্র তাঁরায় ভরা স্মৃতি চত্বর।
আছে আশা, ভালবাসা, আছে বিশ্বাস
নানা রঙে ঝলমলে স্মৃতির আকাশ।
আছে প্রেম, অভিমান, হতাশা ও ক্ষোভ
তবু দেই বারবার স্মৃতিজলে ডুব।
কারণে অকারণে তাই যায় চলে
যখন তখন মন, স্মৃতির অতলে।
মুক্তো মানিক আর প্রবাল শৈবাল
ঝিনুক গহ্বরে ডুবে, আছে মহাকাল।
তাইতো অবসরে, স্মৃতির দড়ি ধরে
আমিও ঝাপ দেই অতল গহ্বরে।
অকুল সাগরে আমি হয়ে ডুবুরি
নিশিদিন খুঁজি একা হারানো কস্তুরী।
ডাক দেয় চুপিচুপি অলীক ময়ুরী
আরব্য রজনীর সেই রাজকুমারী।
দু’হাত বাড়িয়ে আমি কিছু কিছু ছুঁই
আবার পারিনা ধরতে অনেক কিছুই।
রঙিন অনেক স্মৃতি আমাকে না বলে
হারিয়ে গিয়েছে তারা অথৈ জলে।
কোনোটা বা উড়ে গেছে আকাশে বাতাসে
মিশে গেছে বেদনার সহস্র নিঃশ্বাসে।
তবুও যেসব রঙ খুঁজে আমি পাই
তা দিয়ে স্মৃতির পাতা যত্নে সাজাই।
কিছু স্মৃতি ভাঙাছেঁড়া,কোনটা বা ধূসর
বেশীরভাগ ঝলমলে চির ভাস্বর।
হারিয়ে যাওয়া সেই রঙমাখা দিন
আমার ধুসর চোখ,করে দেয় রঙিন।
স্মৃতির সাঁকো বেয়ে দুরন্ত কিশোর এক দৌড়ে আসে
কখনো কাঁদে আর কখনো সে হাসে।
কখনো বালক এসে সামনে দাড়ায়
চুপিচুপি ডাক দেয় হাত ইশারায়।
লাটাই হাতে নিয়ে দৌড়ে কিশোর
আমাকে সে নিয়ে যায় দূরে বহু দূর।
আমি তার পিছু পিছু হাওয়ায় হাওয়ায়
মেঘের ভেলায় ভাসি দূর নীলিমায়।
অনেক পাহাড় নদী পেরিয়ে আমি
হাত’পা ছড়িয়ে দিয়ে যেখানে নামি
চেয়ে দেখি চারিদিকে হরিৎ প্রান্তর
গায়ে জড়িয়ে আমার স্মৃতির চাদর।
দেখি আমি সবুজাভ ঘাসের উপরে
আমার হারানো দিন সাজানো থরে থরে।
ঘাসের উপরে আমি দৌড়ে বেড়াই
পুরনো দিনের কাছে নিজেকে বিলাই।
খুঁজে পাই ভুলে যাওয়া কতো শত মুখ
আমাকে দেখে তারা হয় উৎসুক।
উল্টেপাল্টে দেখি ছেঁড়া এ্যালবাম
পেয়ে যাই প্রিয় বহু স্বজনের নাম।
স্মৃতিময় প্রান্তর ভরে দেয় মন
স্বার্থক হয় আমার নীলিমা ভ্রমন।
কবিতা গল্প আছে স্মৃতির ভেতর
আছে গ্রাম মেঠোপথ শহর নগর।
কিশোর-কিশোরী – আছে তরুণ তরুণী
এখনো কানে আসে,মৃদু পায়ের ধ্বনি।
স্মৃতিপথ জুড়ে আছে নদী-পাখি,ফুল
বেতফল, লুকলুকি, আছে জামরুল।
আছে আম, জাম আর কাঠাল লিচু
কিছুটা ঝলমলে,আবছা কিছু।
বর্ষায় খাল, বিল উথাল-পাথাল
হাওর বাওর আর জোড়াতালি পাল
স্মৃতির বন্দরে এখনো উড়ে
কখনো পোড়ায় আর কখনো পুড়ে।
স্মৃতিতে বর্ষাকাল, শ্রাবণ ঘনঘোর
কানামাছি লুকোচুরি,ছড়ায় রোদ্দুর
দোয়েল ঘুঘু ডাকা উদাস দুপুর
গ্রাম্য বালিকার পায়ের নুপুর
কিচ্ছা কাহিনী শত, স্মৃতিতে ভরপুর।
স্মৃতিতে ভয়ডর -দুঃসাহসিকতা
ইসকুল পালানোর সেই প্রবনতা
রয়েছে তমাল, বট, ঘন বাঁশঝাড়
সুবুজাভ ধান ক্ষেত দূরের পাহাড়
আর-
“মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার”.।
রাখালছেলের বাঁশি বাউলের গান
জোনাক আলোয় ভরা স্মৃতির বাগান।
হিমকবরি, জবা কুসুম-
স্মৃতির ভেতরে গুমরে মরে
” যাও পাখি বলো তারে…সে যেন ভুলেনা মোরে “।
আমলকীর মৌ-খেলারাম খেলে যা –
নিষিদ্ধ লোবান
ছড়ায় হৃদয়ে আজো চন্দন ঘ্রাণ।
মাসুদরানা, দস্যু বনহুর, দুর্ধর্ষ কুয়াশা
স্মৃতির ভেতরে রোজ করে যাওয়া আসা।
স্মৃতিতে গোর্কি আছে, আছে পুশকিন
মার্ক্স এঙ্গেলস আর আছেন লেলিন।
স্মৃতির ভেতরে আছে যুদ্ধ, বিধ্বস্ততা
মিছিল, মিটিং, শ্লোগান, প্রিয় স্বাধীনতা।
আছে সুখ, উল্লাস, বিশ্বাসঘাতকতা
রক্ত আগুন মাখা স্মৃতির পাতা।
রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, সুজাতা
স্মৃতির মখমলে ঝরায় স্নিগ্ধতা
শচীন, কাননবালা, পুরনো কলেরগান
হৃদয়ের মাঝে আজো আছে অম্লান
মান্না, সতীনাথ, বশির, জব্বার
স্মৃতির খেয়াঘাটে করে যে পারাপার।
আজ বহুদিন পর এই মধ্য বয়সে
আমাকে কাঁদায় সেই স্মৃতিরা এসে।
স্মৃতির বাতাসে ভাসে কখনো নয়ন
কখনো সিক্ত হয়, খরায় পীরিত মন।
স্মৃতির মায়ার টানে ,রোদ্র আসেনা প্রাণে
রক্তক্ষরণ তাই বাড়ে অকারণে।
পাশের দেশে ভ্রমণ
আবু মকসুদ
অনির্ধারিত এক কবরের পাশে হেঁটে যেতে যেতে
হটাতই মনে হল
এবেলা যদি ডাক আসে
দয়াপরবশ কেউ কি সঙ্গী হবে
আবার ভাবি দয়া দাক্ষিণ্য কেউ না দেখালে
একা কোথায় যাবো, সঠিক ঠিকানায় কি পৌঁছানো হবে
পাড়া প্রতিবেশী হিসাবে
যাদের পাব তাদের সাথে কি সখ্য হবে
তারা কি আমাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত
নাকি নিজেরাই কি মুক্তির লড়াইয়ে ব্যস্ত
অথবা আমি কি তৈরি
অবগাহন জলে পর্যাপ্ত সাঁতার কি সম্পন্ন হয়েছে
নীলের নীচে যে সবুজ ভূমি তার কর্ষিত ফসলে
আমার কি কোন অবদান আছে, লাঙলের ফলা দিয়ে
চেরা মাটিতে কোন দাগ কি রাখতে পেরেছি
জানি রাজার সমন এলে ভাবা-ভাবির সময় মেলে না
তবু কেউ কেউ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পেয়াদার সাথী হয়
অপূর্ণতার অতৃপ্তি যাদের তাদের কি গতি হয়
জানতে সাধ জাগে, জানা কি একেবারেই অসম্ভব
যেতে তো হবেই, যাবো, নির্ধারিত সময়ে অনির্ধারিত কবরে
শুতে যাবার আগে জানিয়ে যাবো আমিও তো বেঁচে ছিলাম …
ঈদীয়তা এবং অন্যান্য
এ কে এম আব্দুল্লাহ
বুকপকেট থেকে হারিয়ে ফেলেছি পুকুরঘাট। চার বাই ছয় ফুট ঘরে এখন বহে আমার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত। এখন এই জলে নাই। আর নৌকা বাই।
পৃথিবীর যেখানে এখন আমার বাস, সেখানে ঘন কুয়াশার মতো সেমাই গন্ধ নেই। কর্ডফিস আর ফ্যাটচিপসের স্বাদে শ্বাস নিতে নিতে বাঁচি। ট্র্যাফিক সিগন্যালে গাড়ি ব্র্যেক করলে কখনও কাচের জানালা দিয়ে দেখিঃ
আমাদের মানুষগুলো বড়ো শুকনো মুখে হাঁটে।
আমিও মিররে তাকাই-দেখি, আমার শুকনো মুখে প্লাস্টিকের হাসি।
তবুও আমাদের রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুজো ঘর। আর ভেতরে প্রার্থনার উৎসব।
স্মৃতির দেউড়ি
কুতুব আফতাব
আমাদের জারুলগাছে ফুটে কি আশ্রিত অর্কিড?
ঝড় আক্রান্ত নিশি শেষে সবাই যখন আমতলায়,
আমি তখন ঝরে পড়া অর্কিড লতা কুড়াতাম,
ছেলেমানুষি আনন্দে নিজেকে নিজে করতাম মাল্যদান।
পরবাসী বর্ষা এলে বৃষ্টি যখন ছুঁয়ে যায় দেহ মন,
উদাস হয়ে স্মৃতির দেউড়িতে দেই উঁকিঝুঁকি,
তন্ন তন্ন করে খুঁজি আমার মহামহিম শৈশব।
জল ভরা পুকুরে খুদ পানার চাকে মারি ডানপিটে ঢিল,
খালের স্রোতে ভেসে আসা লাটিম ধরি উল্লাসে,
ঝিমধরা দুপুরে মাঝ উঠানে লাগাই লাটিম খেলার ধুম।
আমার বিকেল কাটতো মুর্তাপাতার বাঁশিতে সুর তোলার প্রানান্ত চেষ্টায়,
সেই চেষ্টা আমি অতি যতনে লুকিয়ে রেখেছি প্রাণে।
অনেক রঙে সময় রাঙালো বৈষয়িক জীবন,
অবিরাম সখের সপ্তডিঙ্গা ভাসালাম ভাবনার সমুদ্রে,
দিন শেষে জলে ভাসা জারুলফুল আমার ময়ুরপঙখী,
তাতেই সোয়ারী হতে চায় যাবতীয় অনুভূতি,
আমার অনুভবে কেবলই ফেলে আসা দিন ফিরে পাবার প্রার্থনা।
২৯/০৫/২০১৮
না বলা কথা
আসমা মতিন
তোমার সাথে লুকোচুরি খেলার একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিলো,
এক রাতে তোমাকে সব কথার খাতা হাতে তুলে দিলে;
একের পর এক বাম থেকে ডান দিকে নিতে নিতে
আচমকা মুখ তুললে রাজ্যের যতো বিস্ময়
নীরব ক’টি মুহুর্ত,
তারপর বললে;
এ বিশাল পাথর বুকে নিয়ে সেই কবে থেকে এতোটা পথ হাঁটছো,
তাহলে আমি কি এখন এক যুদ্ধের সাথে কথা বলছি?
ততক্ষণে আমার আঁখিকোলে জল থৈ থৈ,
তুমি বললে –
সুকন্যা ওগো আঁখিকোল, ভাসালে বন্যায় এ যে তোমার যুদ্ধ জয়ের উল্লাস।
মেঘমল্লার আষাঢ় শ্রাবণ
এম এ ওয়াদুদ
কলাগাছের ভেলায় চড়ে বর্ষা আসে
কাজরি রাগ টিনের চালে আষাঢ় মাসে,
উদাস হাওয়ায় মনের ঘরে বাজে নুপূর
কদম হাতে প্রতিক্ষিত একলা দুপুর।
টইটম্বুর নদীর জলে ঢেউয়ের ছলাত্
জোয়ার ভাটার ভাসছে কতো পূর্নিমা রাত,
মুলি বহরে ঘর বেঁধেছে একলা মাঝি
ভাটির স্রোতে ধরেছে সে জীবন বাজি।
খালের উপর বাঁশের সাঁকো এপার ওপার
অলস ফিঙে বসে আছে মন নেই উড়ার,
মাছরাঙাও ধ্যান ধরেছে তীক্ষ্ণ চোখে
সুযোগ পেলেই ঠোঁট বসাবে পুঁটির বুকে।
ভাওয়ালী কাঁঠাল উজান আসে মধু মাসে
মিষ্টি মধুর সুবাস ছড়ায় চারিপাশে,
হিমসাগর আর ফজলি আমের সর্গীয় স্বাদ
এদের দিনে অমৃতও লাগে বিস্বাদ।
কাদা জলের বাংলা আমার চিরায়ত
নির্ঝরিণীও শ্রাবণ ঝরায় অবিরত,
গামছা কাঁধে লুঙ্গি পরে বাংলা হাঁটে
হাডুডু’র লড়াই জমে সবুজ মাঠে।
গাঁয়ের বধু আকুল থাকে পথ চেয়ে
নাইওর যেতে মন উচাটন গসতি নায়ে,
মাঝির কাছে খবর বলে গেয়ে সারি
বাপজানেরে কইও মাঝি আসতো তাড়াতাড়ি।
হাওড় বিলে ফুটে কতো শাপলা শালুক
কচুরিপানার ফুলে খোঁজে পতঙ্গ সুখ,
স্বচ্ছ জলে মাছেরা গায় জলের কোরাস
পদ্মপাতায় ঝিলিক মারে রোদের পরশ।
আষাঢ় মাসে নকশিকাঁথার কাব্য রচি
মেঘমল্লার স্বাদ কড়ই ভাজা কাঁঠাল বিচি,
দইয়ের সাথে নরম চিড়া বিন্নি ধানের খই
মিঠাই রসে দুধ মেশানো পল্লী মায়ের সই।
যুক্তরাজ্য
০৪/০৭/২০১৭
ভালোবাসার চালচিত্র
মোহাম্মদ ইকবাল
আহবান শব্দের একটাই মানে আমি বুঝি এবং সেটা তুমিও বেশ ভালোই বুঝো,
আহবান প্রথম বোধে এলে আবেগি তোড়ে বিপত্তির সবকিছু টপকে তোমাকে ছুঁয়েছি।
বাতাসের শরীর থেকে আহবানের সংক্ষিপ্ত বার্তা পড়ে এখনও উতলা হই,
আসকারার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নিষিদ্ধ লোভগুলো প্রলুব্ধ হতে হতে মগডালে গিয়ে পৌছে,
তার পত্র পল্লব লতাগুল্মে কখনও জাড়িয়ে গেলেই তুমি নির্লিপ্ত গুটাতে থাকো
যেমন ঝিনুক গুটায় নিজেকে খোলসে!
ক্ষেত্রী আমি, ভালোবাসার অনার্কষিত ভূমি চষে কুড়োই প্রণয়ী মুক্তো মানিক,
অতিক্রম করি সবকটি বন্ধ কপাটের উলঙ্গ চৌকাঠ।
নিষেধের হুলিয়া ঝুলে থাকেই মাথার উপর
বাহির থেকে ভালোবাসায় তোমার স্বভাবগত কৃপণতা ধরা পড়লেও আমিতো জানি, নিশ্চিত জানি;
অন্তরে তুমি রেশমী কোমল জাফরানি মৌচাক!
০৫.০৬.২০১৮, লন্ডন।
ব্যথার নদী ছুঁয়ে দেখিস
শামীম আহমদ
এখন কেনো কাঁদিস তবে
চোখের জলে হয় সমুদ্দুর,
ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে
বুকের পাঁজর ধুঁয়ে দিয়ে,
যায় কতদূর, বলতে পারিস?
বলতে পারিস ব্যথার কি রঙ
কালো নাকি নীল হলুদে,
চোখের জলের রঙ কি জানিস
জানলে আমায় তা বলে দে!জানি আমি, পারবি না তুই,
পারবিনা রে ওরে পাষাণ ,
এখন কেনো নিত্য শুনি
রাত বিরাতে বুকফাটা গান ।
যখন আমি পাশে ছিলাম
তখন আমায় খুব কাঁদাতে, মনে আছে ?
উপোষ থেকে অভিমানে
ঘুমিয়ে যেতাম নিত্য রাতে।আসতেও না একটু পাশে
বসতে না তুই পাশটি ঘেষে
তখন কেবল আমিই আমার –
দিন গড়ালে দিনের শেষে ,
বৃথাই কেনো খুঁজিস আমায়,
রোজ রাতে ঐ তাঁরার দেশে
আমি কবেই হারিয়ে গেছি
অস্থাচলের কালোয় মিশে ।
এখন আমি কেবলই স্বপ্নচারিনী,
স্বপ্নে এসে বলে যাবো
রোজ আমার ব্যাথার কাহিনী।
সাহস থাকলে একবার ছুঁয়ে দেখিস ব্যথার নদী …
১৭.০৬.২০১৭
লন্ডন
ঈদ আনন্দ
দিলারা রুমা
আত্মা দেহ শুদ্ধিকরে
পথ দিয়েছি পাড়ি,
ঈদ এসেছে, ঈদ এসেছে,
যাবো সবার বাড়ি।
গরীব ধনী বলে কিছু
থাকবেনা আজ ভেদ,
উঁচু নীচু সব ভুলে যাও
মিথ্যা নামক ক্লেদ।
মাটির দেহ লাল রক্ত
সব মানুষের এক,
মানবতা-শান্তি-প্রীতি
গাইছে সবই দেখ।
মন কাননে নাইরে দেয়াল
বইছে ফাল্গুধারা,
সব ব্যবধান যাই ফেলে সব
জাগায় দিলের সাড়া।
যাও দূরে যাও খানদানি রঙ
যাও দূরে যাও রাগ,
হিংসা দেয়াল সব ভেঙ্গে দাও
জাগাও সত্য ডাক।
দাও মুছে দাও দুখিনীর জল
প্রাণ খুলে গাও গান,
আকাশ বাতাস জুড়ে দেখো
বইছে কলতান।
১১/০৬/১৮ ইং