শাফিনেওয়াজ শিপু:
ইংল্যান্ডে স্টুডেন্ট ভিসায় আসার পর থেকে বলতে গেলে লেখাপড়া ও চাকরি নিয়ে কীভাবে যে দিন কেটে যেত,বুঝতেই পারতাম না। আর সেই সাথে অনেক কষ্ট হয়েছিল নতুন পরিবেশের সাথে খাপচ খাইয়ে চলতে।

এতো কষ্টের মাঝেও কিছুতা হলেও স্বস্তির আশ্বাস পাই যখন বাংলাদেশের ছোঁয়া, অনুভুতি ও গন্ধ পাই ইংল্যান্ডের মতো দেশে এসে। প্রথমদিকে খুব খারাপ লাগতো যখন দেখতাম জীবনযাপনের ধরন এইখানে একেবারেই ভিন্ন রকম এবং সব কিছুই ঘড়ির কাটা অনুযায়ী চলতো। সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতাম- কীভাবে এইখানে খাপ খাইয়ে চলবো। যার কারণে কোনো কিছুতেই সহজে মন বসছিল না।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় মনটা খালি বলছিল, আজকে যদি এটা বাংলাদেশে হতো তাহলে চটপটি ও ফুসকা খাওয়ার জন্য হয়তো টিএসসি বা শাহবাগ মোড়ে চলে যেতাম বন্ধু-বান্ধবের সাথে। তখন খালি মনে হচ্ছিল- ইংল্যান্ডের মতো দেশে আমি কোথায় গিয়ে বাংলা খাবার বা বাংলা খাবারের স্বাদ পাবো।
এই কথাটি যখন আমার ক্লাসের বান্ধবীর সাথে শেয়ার করছিলাম, তখনই সে বলে উঠলো- এইখানেও পূর্ব-লন্ডনে ব্রিকলেন নামে এমন একটি জায়গা আছে, যেখানে বাঙালি সব ধরনের খাবার পাওয়া যাবে। শোনার সাথে সাথে আমি আর এক সেকেন্ডও দেরী করিনি, ওইদিনই ছুটে গিয়েছি সেই বান্ধবীর সাথে ব্রিকলেন নামক জায়গাটিতে শুধুমাত্র বাঙালি খাবার খাওয়ার জন্য।

আসলে বাংলাদেশ থেকে আসার পর থেকে নিজের দেশের খাবারকে খুব মিস করছিলাম। শুধু যে খাবার তা নয়, আমার দেশের সংস্কৃতিকেও মিস করছিলাম। যখন ঢুকলাম ব্রিকলেনের লেনের ভেতরে, তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি কি আদৌ ইংল্যান্ডে, নাকি বাংলাদেশে। অবাক নয়নে তাকিয়ে তখন পুরো জায়গাটি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম এবং সেই সাথে মনে হচ্ছিলো- এইতো দেখি মিনি বাংলাদেশ।
চারিদিকে দেখলাম বাংলা অক্ষর দিয়ে রাস্তার নাম লেখা। শুধু রাস্তাই নয়, সাথে রেস্তোরাঁর নামও বাংলায় লেখা। এমনকি আশে পাশে বাঙালিদের সমাগম দেখে মনে হলো, এটি একটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। এক কথায় তখন মনে হচ্ছিল, আমি যেন কিছুক্ষণের জন্য বাংলাদেশে আছি এবং সেই সাথে ফুটপাতও মনে করিয়ে দিচ্ছিলো পুরান ঢাকার অলি-গলির কথা।
এই ব্রিকলেন লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের একটি রাস্তার নাম, যার অবস্থান পূর্ব লন্ডনে। এটি মূলত বেথন্যাল গ্রিনের উত্তর পাশ দিয়ে ঘেঁষে সোহান ফিল্ড রাস্তা দিয়ে শুরু হয়ে বেথন্যাল গ্রিন রোডকে ছেদ করে স্পিটাল রোড দিয়ে গিয়েছে। তারপর হোয়াইট চ্যাপেল নামে একটি জায়গার হাই স্ট্রিটে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে দক্ষিণ দিক দিয়ে। তাছাড়া এই ব্রিকলেন জায়গাটি ‘বাংলা টাউন’ নামেও পরিচিত। তবে এই রাস্তার আগের নাম ছিল হোয়াইট চ্যাপেল স্ট্রিট। হোয়াইট চ্যাপেলও আরও একটি বাঙালি জায়গা। এছাড়াও দোকান হতে শুরু করে রাস্তার নাম পর্যন্ত বাংলায় লেখা।
আরও ভালো লেগেছিল যখন দেখলাম, আমার সামনে এক ইংরেজ ক্রেতা চিকেন টিক্কা ও তেহারী অর্ডার দিচ্ছিল। আমাদের আশেপাশে তখন কিছু ইউরোপিয়ান এবং অ্যারাবিয়ান ক্রেতাও ছিল। তখন বুঝলাম, আমাদের দেশিয় খাবার ইংলিশ, ইউরোপিয়ান ও অ্যারাবিয়ানদেরও অনেক পছন্দের।
খুবই অবাক হলাম খাবারের তালিকা ও স্বল্প মূল্য দেখে। কারণ ভাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের ভর্তা, পোলাও, কোরমা, রোস্ট ইত্যাদি সব ধরনের খাবার পাওয়া যায় এই সমস্ত রেস্তোরাঁগুলোতে, যেমন- স্বাদ, গ্রামবাংলা, মধুবন, ক্যাফে-গ্রিল ও আলাউদ্দিন ইত্যাদি। খাবারের দাম নির্ভর করছে খাবারের ধরনের ওপর।
এই ধরুন- তেহারী, মোরগ পোলাও, কাচ্চি-বিরিয়ানি ও ভুনা খিচুরীর দাম বাংলাদেশি টাকা অনুযায়ী পড়বে ৪০০-৬০০ টাকার মধ্যে। সেই সাথে আছে সাদা ভাত থেকে শুরু করে রকমারি ভর্তা, যার কারণে দেশের নিরব হোটেলকে আমি অন্তত মিস করি না।
বাহারী রকমের মিষ্টি যেমন- কালোজাম থেকে শুরু করে রসগোল্লা, রাজভোগ, চমচম, দই ও সন্দেশ ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের মিষ্টি পাওয়া যায় এই ব্রিকলেনে। তবে এইখানে একটি মজার বিষয় হচ্ছে, আপনি চাইলে একটি করে মিষ্টি কিনতে পারবেন, হয়তো আমাদের দেশের মতো কেজি দরে কিনতে হবে না।
এতো গেলো বিভিন্ন রকমের খাবার ও মিষ্টির কথা। এছাড়াও এইখানে বিভিন্ন রকমের সবজি পাওয়া যায়, যেমন- করলা, মিষ্টি কুমড়া, নানা রকমের শাক, ঢেঁড়শ, লতি ইত্যাদি। তবে সবজির মূল্য কেজি ধরে করা হয়। ওই মুহূর্তে আমি বিকেলের দিকে সারা দিনের কাজ শেষ করে এইখানেও বিভিন্ন সংগঠনের লোকজনরা একত্রিত হয়, আড্ডা দেয়। দেখে মনে হবে, এই যেন আমাদের সেই শাহবাগ বা টিএসসি চত্বর। এমনকি পহেলা বৈশাখের র্যালিটি এই ব্রিকলেন থেকে শুরু হয়।
সবার কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই ব্রিকলেন জায়গাটিই একমাত্র বাংলা খাবারের জন্য বিখ্যাত এবং সেই সাথে সারা বছর ধরেই পর্যটকদের সমাগম হতে থাকে। এমনকি প্রত্যেক রোববারে এইখানে মেলা বসে যাকে বলে –‘সানডে মার্কেট’। এই মেলাতে অনেক কম মূল্যে দ্রব্য-সামগ্রী পাওয়া যায়। এক পাউন্ড থেকে শুরু হয় দ্রব্যমূল্য। তাছাড়া পর্যটকদের সমাগম সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শুক্রবার, শনিবার ও রোববারে। এ যেন আমাদের ছোট্ট একটা বাংলাদেশ!
তবে কিছু কিছু জিনিস দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম, রেস্টুরেন্টগুলোতে কর্মচারীরা ডেকে ডেকে কাস্টমার জোগাড় করছে। প্রশ্ন জাগছিল, কাস্টমারকে ডাকতে হবে কেন, খাবারের মানের জন্য তো অবশ্যই কাস্টমাররা নিজে থেকেই খেতে আসবে। আমি তখন রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলেন এমন একজন পথচারিকে জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে কাস্টমারকে ডেকে ডেকে আনার মানে কী?
উত্তরে এটাই বুঝলাম যে, খাবারের কোনো ভিন্নতা নেই বলে, কাস্টমার আগের মতো আসে না এবং তার মধ্যে অন্য দেশের রেস্টুরেন্ট থাকাতে প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে গিয়েছে। এই কারণেই হয়তো রেস্টুরেন্টের ম্যানেজাররা বাড়তি কর্মচারী রেখেছে বাইরে থেকে কাস্টমার ডেকে আনার জন্য। তবে অনেকের মতে, খাবারের মান ভালো কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে একই মেন্যু থাকাতে বা কোনো ভিন্নতা নেই বলে হয়তো কাস্টমারের পরিমাণ দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে এই একটি কারণেই ইউরোপিয়ানরা এই বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় অনায়াশে রাজত্ব করছে তাদের রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে।
তবে যাই হোক, তারপরও জায়গাটিতে গিয়ে নিজের দেশের যে স্বাদ ও আমেজ পেয়েছি, এর উপর আর কোনো কথা নেই। এরপর থেকে যত বার মন চেয়েছে, ততবারই গিয়েছি ব্রিকলেনে শুধুমাত্র নিজের দেশের স্বাদ পাওয়ার জন্য। শুধু যে খাবারের জন্য তা নয়, ওখানকার পরিবেশ দেখেই মনে হয় আমি এখনও বাংলাদেশেই আছি। এই ব্রিকলেন ও হোয়াইট চ্যাপেল নামক বাঙালি জায়গাগুলো আমাদেরকে এখনও মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগুলো।
লেখক: শাফি নেওয়াজ শিপু
স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর,ব্রিটবাংলা24.কম
ই-মেইল: topu1212@yahoo.com