সরকারের অঘোষিত অবরোধ

সোহরাব হাসান

স্কুল খোলা থাকলে শিক্ষার্থী স্কুলে যাবে, পরীক্ষা থাকলে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সরকারের দায়িত্ব স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে প্রশাসন তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশব্যাপী যে ব্যাপক ধরপাকড়-তল্লাশি চালাচ্ছে, তাতে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুধু ব্যাহত হয়নি, ঢাকা শহর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষও ভয়ভীতিতে আছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়ে দিয়েছে, বৃহস্পতিবার ভোর চারটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকায় ছুরি, চাকু, ছড়ি ও লাঠি হাতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে।

ডিএমপির এই ঘোষণা দেখে মনে হতে পারে যে বিএনপির নেতা-কর্মীরা এত দিন ছুরি, লাঠি, চাকু নিয়ে ঢাকা শহরে অবাধে সভা-সমাবেশ করেছেন। পুলিশ বাধা দেয়নি। খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে সামনে রেখে তাঁদের সেই সুযোগটি সাময়িক রহিত করা হলো মাত্র। সরকারের অনেক অদ্ভুত নির্দেশনা থাকে। তার মধ্যে ঢাকা শহরে ছুরি, চাকু নিয়ে মিছিল নিষিদ্ধ করার ঘোষণা একটি।

এর আগে খবর বের হয়েছিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার বড় ধরনের জমায়েত রেখে আদালতে মামলার রায় শুনতে যাবেন। কিন্তু নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি কোনো কর্মসূচি নেবে না।

গত কয়েক দিনে ঢাকার বাইরে যানবাহনে যেভাবে তল্লাশি চালানো হচ্ছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমরা এক অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে সময় পার করছি। পুলিশ ঢাকার আবাসিক হোটেল, মেস, বাসেও তল্লাশি চালাচ্ছে। রাজধানীর প্রবেশমুখে বাসে তল্লাশি চালিয়ে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের পরীক্ষা করে দেখছে, তারা অপরাধী কি না। রামপুরার একটি মেস থেকে সোমবার রাত ১২টায় সাতজনকে ধরে নেওয়া হয়, যাঁদের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দুজন তরুণ প্রকৌশলীও ছিলেন। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যেসব আটক ব্যক্তি কোনো বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন না বা অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেননি, তাঁদের ঠিকানা হয়েছে থানার হাজতখানা।

আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি আছে। প্রথম পদ্ধতিটি হলো রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (প্রয়োজনে গোয়েন্দাদের সহায়তা নিয়ে) খোঁজখবর নিয়ে যদি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায় কেবল সে ক্ষেত্রেই তাঁকে গ্রেপ্তার বা আটক করবে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এটাই অনুসরণ করা হয়। আরেকটি পদ্ধতি হলো সরকার যাকে খুশি ধরে নিয়ে যাবে আর জেলখানায় বসে ওই ব্যক্তি/ব্যক্তিদের প্রমাণ করতে হবে তাঁরা নিরপরাধ।

যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ যেমন সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হন, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা শহরে মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের বাড়ি আছে। কিন্তু যাঁদের বাড়ি নেই কিংবা কোনো ফ্ল্যাট-বাসা ভাড়া করার সামর্থ্যও নেই, তাঁরাই নিরুপায় হয়ে মেসে থাকেন। কেবল মেসবাড়ি নয়, পুলিশের তল্লাশি অভিযান থেকে আবাসিক হোটেলগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে প্রতিদিন লাখ লাখ লোক ঢাকায় আসেন, দিনে দিনে ফিরে যেতে না পারলে তাঁরা হোটেলে থাকেন। সরকার পাইকারিভাবে তাঁদেরও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে এবং তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।

সরকারের পাশাপাশি সরকার-সমর্থক নেতা-কর্মী, বিশেষ করে পরিবহনের মালিকেরাও মাঠে নেমে পড়েছেন। পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথমে লাঠি হাতে ঢাকা শহরের টার্মিনালে টার্মিনালে পাহারা বসানোর কথা বলেছিলেন। পরে অবশ্য ডিএমপির নিষেধাজ্ঞার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি লাঠি ছাড়াই পাহারা দেবেন বলে জানিয়েছেন। জনগণের নিরাপত্তা বিধানে তাঁর এই অসামান্য অবদানের কথা নিশ্চয়ই ঢাকাবাসী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তবে সরকার সমর্থক পরিবহন মালিকেরা যদি আগাম ঘোষণা দিয়ে রাখতেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক ছাড়া তাঁদের বাসে কেউ উঠতে পারবে না, তাহলে রাস্তায় এত তল্লাশি-ধরপাকড়ের দরকার পড়ে না।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে যত পুলিশ থাকবে, তত বিএনপির নেতা-কর্মীও নেই। কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, পুলিশ কর্মকর্তার কথায় সরকার সমর্থক নেতারা খুব একটা ভরসা রাখতে পারছেন না। প্রথমে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব জানালেন ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি থাকবে না। কয়েক ঘণ্টা পর দলের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বললেন, ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি তাঁরা মাঠে থাকবেন।

সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক তাঁর আগের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে বলেছেন, বিএনপি কোনো নাশকতা ঘটালে আওয়ামী লীগের কর্মীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে তা মোকাবিলা করবেন। একটি বিষয় আমাদের মাথায় আসছে না। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অভিযুক্ত আসামি খালেদা জিয়া। আর আদালতের রায় নিয়ে বেশি টেনশনে আছেন সরকারি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এই ঘটনা আমাদের ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিলের আগে ও পরের ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ট্রাম্প কার্ড ঘোষণা করেছিলেন। একই সঙ্গে ঢাকায় হরতাল-মহাসমাবেশসহ নানা কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই কর্মসূচি ঠেকাতে বিএনপির সরকার ঢাকাগামী সব বাস-ট্রেন-লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি মুরগি নিয়ে আসা এক লঞ্চযাত্রীকেও পুলিশ সদরঘাটে আটকে দিয়েছিল।

সেদিন বিএনপি সরকার অঘোষিত অবরোধ পালন করেছিল। আজ আওয়ামী লীগ সরকার করছে। নাটকের কাহিনি এক, অভিনেতা ভিন্ন।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com

 

Advertisement