Dr. Zaki Rezwana Anwar FRSA
বেশ কয়েকটি কারণে ২০২২ সালের বৃটিশ স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ একটু তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ সাধারণত পূর্বেকার নির্বাচনের সাথে একটা তুলনামূলক আলোচনা করে থাকেন। এবার সেই সরাসরি তুলনাটি মোটামুটিভাবে প্রযোজ্য হলেও শতভাগ সঠিক হবে না। ২০১৮ সালের স্থানীয় নির্বাচনে ডানপন্থী বামপন্থী, ধনী দরিদ্র এসব যতটা না বিভক্তির কারণ ছিল তার চাইতে বড় ছিল ‘লীভ’ ও ‘রিমেইন’ ফ্যাক্টর। এবার সেই ফ্যাক্টরটি নেই, যোগ হয়েছে নতুন কিছু ফ্যাক্টর যেমন ক্ষমতাসীন সরকারের পার্টিগেট কেলেঙ্কারি, মুদ্রাস্ফীতি এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সহ জ্বালানির গগণচুম্বী দাম।
এবারের নির্বাচনে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে নর্দান আয়ারল্যান্ডের দিকে বৃটেনের একটি ঐতিহাসিক কারণে। তবে বাদবাকী বৃটেন বিশেষ করে ইংল্যান্ডের দিকেই প্রথমে নজর দেওয়া যেতে পারে। এখানে আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। এবার স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে সব অথরিটিতে নির্বাচন হলেও ইংল্যান্ডে ১৪৬ টি কাউন্সিলে নির্বাচন হয়েছে এবং তার ভেতরে আবার বেশ কয়েকটি জায়গায় অর্ধেক আবার কোথাও কোথাও এক তৃতীয়াংশ আসনে লড়াই হয়েছে। তার ভেতরে অনেকগুলোই হয়েছে শহুরে এলাকায়, যেমন লন্ডনেই ৩২ টি বারাতে সব কাউন্সিলরগণ লড়েছেন।
লন্ডনে লেবারের উল্লেখযোগ্য বিজয়ের মধ্যে রয়েছে মার্গারেট থ্যাচারের প্রিয় ওয়ান্ডয়ার্থ, ওয়েষ্ট মিন্স্টার ও বার্ণেটের মত কট্টর টোরী এলাকায় প্রথমবারের মত লেবারের আধিপত্য বিস্তার। এই কাউন্সিলগুলোকে টোরীর ফ্ল্যাগশীপ কাউন্সিল বলা হয়ে থাকে, কারণ ১৯৭৮ সাল থেকে ওয়ান্ড্সওয়ার্থ কনজারভেটিভ এলাকা এবং বার্ণেট ও ওয়েষ্টমিন্স্টার কাউন্সিলের জন্মলগ্ন থেকে এ দু’টো কাউন্সিল কনজারভেটিভের করায়াত্তে ছিল। এমনকি টনি ব্লেয়ারের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ খ্যাত সময়েও এই কাউন্সিলগুলো কনজারভেটিভের দখলে ছিল, অর্থনৈতিক মন্দায় যখন বৃটেন কৃচ্ছ্রতা সাধন করছিল তখনও এসব কাউন্সিলকে হারাতে হয় নি কনজারভেটিভের, রেফারেন্ডমের পরে টেরিসা মের সময়েও কনজারভেটিভ ধরে রাখতে পেরেছিল এসব কাউন্সিল। কাজেই সেই দিক থেকে এ বিজয়ের একটি প্রতিকী মূল্য আছে এবং এটি কনজারভেটিভের জন্যে একটি লজ্জাকর সংবাদ তো বটেই।
তবে লন্ডনের বাইরে যেসব অঞ্চলে লেবারের জেতা উচিত ছিল যেমন হার্টলিপুল, পিটারবোরা, রেডিচ, ইপসুইচ – এসব এলাকায় লেবারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা দলের জন্যে খুবই প্রয়োজন ছিল বিশেষ করে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ১০ নম্বর ডাউনিং ষ্ট্রীটের এত নাটকের পরে লেবারের এসব জায়গায় কৌশলগত বিজয় লেবারকে অনেকটা এগিয়ে দিতে পারত।
অন্যদিকে কনজারভেটিভ শুধু লন্ডনই নয় ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলেও খারাপ করেছে। এছাড়া সাদেমটনে লেবারের কাছে পরাজয় ছাড়াও মার্টন ও ওয়েষ্ট অক্সফোর্ডশায়ারে (যেখানে ডেভিড ক্যামেরনের নির্বাচনী এলাকা ছিল) লিবডেমের কাছে পরাজয় কনজারভেটিভের জন্যে অনেক বড় পরাজয়। লিবডেমমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিজয় হল কিংস্টন-আপন- হাল এ লেবারকে হারানো।
মোটা দাগে বলা যায় যে, এবারের নির্বাচনে অনেকটা সাফল্য দেখিয়েছে লিবডেম ও সেই সাথে গ্রীণ পার্টিও এবং ১০ নম্বরে এত নাটকের পর কনজারভেটিভের একেবারে ভরাডুবি হবে বলে মনে অনেকেই যেমনটি বলছিলেন তেমনটি বোধ হয় হবে না, তবে নি:সন্দেহে এই ফলাফলে বরিস জনসনকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে; অন্যদিকে কনজারভেটিভের পার্টিগেট কেলেঙ্কারিকে পুঁজি করে লেবার দলের যতটা ভাল করা প্রত্যাশিত ছিল ততটাও হয় নি।
স্থানীয় নির্বাচন কি সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের একটা ভাল ইন্ডিকেটর? অর্থাৎ কনজারভেটিভ যেমন সংখ্যক আসন হারিয়েছে এরকম চিত্রই কি দেখা যাবে আগামী সাধারণ নির্বাচনে? সম্ভবত: না। ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ সালে স্থানীয় নির্বাচনের পর পরই সাধারণ নির্বাচন ডেকেছিলেন মার্গারেট থেচার। ১৯৮৩ সালে কনজারভেটিভ লেবারের থেকে মাত্র তিন পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ লেবারকে গুঁড়িয়ে দেয় ষোল পয়েন্টে। একইভাবে ১৯৮৭ সালে কনজারভেটিভ স্থানীয় নির্বাচনে ছয় পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয় এগারো পয়েন্টে। কিন্তু সরকার যখন বদল হয় অর্থাৎ অন্য দল ক্ষমতায় আসার আগে মোটামুটিভাবে পুরো দেশই সেই দলের রঙে রঙিন হয়ে যায়, যেমন আমরা দেখেছি লেবারকে হারিয়ে মার্গারেট থেচার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগের স্থানীয় নির্বাচনে গোটা বৃটেন নীলে নীল হয়ে গিয়েছিল; তারপর আবার কনজারভেটিভকে হারিয়ে টনি ব্লেয়ার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগের স্থানীয় নির্বাচনে গোটা বৃটেন লালে লাল হয়ে গিয়েছিল; তারপর লেবারকে হারিয়ে ডেভিড ক্যমেরন ক্ষমতায় আসার ঠিক আগের স্থানীয় নির্বাচনে আবারো সমগ্র বৃটেন নীলাভ হয়ে উঠেছিল। বলা বাহুল্য, কেয়ার ষ্টার্মার টনি ব্লেয়ারের ষ্টাইলে বৃটেনকে সেভাবে লালে লাল করতে পারার সম্ভাবনা দেখছি না।
তবে ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় এবার হয়তো সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে নর্দান আয়ারল্যান্ডের নির্বাচনী ফলাফল। জনমত জরিপের যদি প্রতিফলন ঘটে তাহলে নর্দার্ন আইরিশ রাজনীতির শতাব্দীর ধারা বদলে গিয়ে নতুন ইতিহাস তৈরী হবে।
গত ১০০ বছরে নর্দার্ন আইরিশ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছে ইউনিয়নিষ্ট দলগুলো, ন্যাশনালিষ্ট দলগুলো কখনোই প্রধান হতে পারে নি। কিন্তু এবারের জনমত বলছে শীন ফেইন পার্টি যারা বৃটেন ছেড়ে আয়ারল্যান্ডের সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছিল তারাই ষ্টরমন্টে সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হয়ে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করবে। ঐতিহাসিকভাবে শীন ফেইন ‘আই আর এ’ – এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং পরে ১৯৯৮ সালে ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এক্ট’ -এর মাধ্যমে যুদ্ধ বিবাদ থামিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের এসেম্বলিতে অংশগ্রহণে সম্মত হয়।
নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের জনগণের ইউনিয়নিষ্ট দলকে ছেড়ে ন্যাশনালিষ্ট দলের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে ইউনিয়নিষ্ট দলগুলোর ব্রেক্সিটের ব্যাপারে ভুল বিবেচনা যার ফল ‘আইরিশ সী বর্ডার’ যেটি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে বাদবাকী বৃটেন থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
যদি শীন ফেইনের মতো ন্যাশনালিষ্ট পার্টি বেশীরভাগ আসন পায় তাহলে ইতিহাসে এই প্রথম ন্যাশন্যালিষ্ট পার্টি ফার্ষ্ট মিনিষ্টার নিয়োগ দিতে পারবে। যদিও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের এসেম্বলির কাঠামোটিই তৈরীর করা হয়েছে ক্ষমতার ভাগাভাগির ভিত্তিতে এবং ১৯৯৯ সাল থেকেই শীন ফেইন এসেম্বলিতে ছিল ও ২০০৭ সাল থেকে ডেপুটি ফার্ষ্ট মিনিষ্টারও শীন ফেইন থেকে। তবু শীন ফেইনের এই সম্ভাব্য বিজয় বৃটেনের জন্যে একটি অশনি সংকেত।
স্কটল্যান্ডে যেখানে ন্যাশন্যালিষ্ট পার্টি সংখ্যাগুরু সেখানে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের শীন ফেইন – এর বিজয় হলে অবস্থাটা দাঁড়াবে এমন যে স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড দুই জায়গাতেই এমন আইন প্রণেতাকারী থাকবেন যাদের উভয়েরই মতাদর্শ বৃটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে। অর্থাৎ শীন ফেইনের বিজয় হলে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বৃটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বীজ বপিত হবে।।
………………………… …………………….
লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট
Advertisement