আনু মুহাম্মদ :: গত ৩০ মে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত সেটা সারা জীবন মনে রাখবে। তবে এ জন্য আমি ভারতের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না।’ (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০১৮)।
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ‘উত্তুঙ্গ পর্যায়ে’ আছে বলে দু’দেশের সরকারি ব্যক্তিবর্গের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। তবে এই দু’দেশের সম্পর্ক ও জটিলতা একদিনের নয়; এর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। নদী নিয়ে বহুবিধ সমস্যা বা নদী নিয়ে চুক্তি হওয়া-না হওয়া- সব বিষয় ঝুলে আছে বহু বছর থেকেই। বাণিজ্য, বেআইনি এবং আইনি, ধরন বা পরিমাণের দিক থেকে বড় আকারের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার এখনও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত।
তবে গত কয়েক বছরে যেসব ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রানজিট বা করিডোর প্রধান। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট ও করিডোর- এই তিন ধারাতেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কাজ এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। এর পূর্ণ বাস্তবায়নে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ অনেক দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে এখন সড়ক, সেতু ও রেলপথের যোগাযোগ ক্ষেত্রে ট্রানজিটের সঙ্গে সম্পর্কিতগুলোই প্রধান গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশকে। সে টাকায় ভারতেরই ট্রানজিট বা করিডোরের অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই ঋণে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারত থেকেই সর্বোচ্চ সংখ্যক উপকরণ, বিশেষজ্ঞ, যন্ত্রপাতি ও প্রতিষ্ঠান নিতে হবে। এর মাধ্যমে সেখানে ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ ছাড়া ভারত থেকে ঋণের টাকায় আসছে বাস, বগি, রডসহ নানা সামগ্রী। এর পাশাপাশি বন্দরগুলো ভারতের ব্যবহারের উপযোগী করে পরিবর্তন হচ্ছে। নৌপথে ড্রেজিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
গত কয়েক বছরে জোরদার আরেকটা কর্মসূচি হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ। আছে সুন্দরবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, দু’দেশের সরকারের অবিশ্বাস্য মাত্রায় আগ্রহ এই ভয়ঙ্কর প্রকল্পের ব্যাপারে। এর বাইরেও রিলায়েন্স, আদানিসহ বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বড় আকারে যুক্ত হচ্ছে। রূপপুরে যে পারমাণবিক কেন্দ্র, সেখানেও ভারত যুক্ত। তারা সেখানে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে। এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আরও বাড়ানো এবং এক পর্যায়ে ভারতে বিদ্যুৎ রফতানি করার ব্যাপারে আয়োজন হচ্ছে। এর বাইরে আইটি, বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র, অর্থনৈতিক অঞ্চল, গার্মেন্টস, বায়িং হাউস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ভারতের অংশীদারিত্ব বাড়ছে।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান এবং বৃহৎ পুঁজির চাহিদা পূরণের যে তাগিদ নিয়ে এই বৃহৎ রাষ্ট্র এবং তার বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিকল্পনার বিন্যাস করেছে, তার বাস্তবায়ন তাই হচ্ছে দ্রুত। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ও পরিকল্পনার বিষয় দু’দিকের তৎপরতা থেকেই বোঝা যায়। এই অঞ্চলে ভারতকে ইকোনমিক জোন দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হওয়া সত্ত্ব্েও ভারত রামপাল নিয়ে জোরজবরদস্তি করছে বা লেগেই আছে। বোঝা যায়, এটা শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে নয়, রূপপুরের ব্যাপারেও তাই।
এর আগে ২০১৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ৬৫ দফা ঘোষণার শিরোনাম করা হয়েছিল :’নতুন প্রজন্ম নয়ি দিশা’। এই ঘোষণায় যেসব চুক্তি ও সমঝোতা চূড়ান্ত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বাণিজ্য, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ, বঙ্গোপসাগর অর্থনীতি, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল, ভারতকে সাবমেরিন কেবল ইজারা দান ইত্যাদি। এ ছাড়া এই সফরকালেই ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আম্বানি ও আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন সংক্রান্ত বিনিয়োগ চুক্তির প্রাথমিক বোঝাপড়া নিশ্চিত হয়, যৌথ ঘোষণায় সুন্দরবনধ্বংসী প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।
বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নৌপথ, সমুদ্রবন্দরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে, তাতে সড়ক, রেলপথ, নৌপথে, বন্দরে চাপ বাড়বে কয়েক গুণ। এখনই যে পরিস্থিতি, তাতে এই অতিরিক্ত চাপ কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে তার পরিস্কার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের জনগণের কাছে উন্নয়নের মোড়কে এই খবরগুলো খণ্ড খণ্ডভাবে আসে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের কী লাভ কী ক্ষতি, তা নিয়ে বিশ্নেষণ, আলোচনা, স্বচ্ছতা- সর্বোপরি জনসম্মতি ছাড়াই সবকিছু সম্পন্ন হচ্ছে। অভিন্ন সব নদীর ওপর বাংলাদেশের অধিকার নিষ্পত্তির কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু তিস্তা চুক্তি নিয়ে মাঝেমধ্যে এমনভাবে শোরগোল তৈরি করা হয়, তাতে মনে হয়, ভারত রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের আর কিছু চাওয়ার নেই। অথচ তিস্তা চুক্তি বলতে কী বোঝায়, চুক্তি স্বাক্ষর হলেই তা বাংলাদেশের পক্ষে যায় কি-না, সে বিষয়ে মিডিয়ারও মনোযোগ খুব কম। কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের জনগণের উদ্বেগ আর স্বার্থের বিষয়গুলো, এমনকি অনেক ছোট বিষয় যেমন ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখানো; তারও কোনো ফয়সালা হয়নি। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগও আটকে আছে ভারতের জন্যই। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় মৌখিক বাগাড়ম্বরের বেশি কিছু পাওয়া যায় না। কাঁটাতারের বেড়া অপসারণ কখনও কোনো আলোচ্য সূচিতেই থাকে না।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতের ইকোনমিক টাইমস-এর বরাত দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে :’বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নৌ-করিডোর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ভারত।… পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া থেকে শুরু হয়ে এই নৌপথ (৯০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য) সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে গিয়ে মিশবে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে। তারপর এটি ব্রহ্মপুত্র হয়ে যুক্ত হবে আসামের সঙ্গে।’ ভারতের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, ‘আলোচিত নৌপথ বাস্তবায়ন করা গেলে পণ্য পরিবহন খরচ কমে যাবে শতকরা ৭০ ভাগ।’ (সমকাল, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)। একই দিন আরেকটি খবরে আরেকটি করিডোর নিয়ে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানা যায়। বলা হয়েছে, ‘নিজেদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত। সে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটি ৭৬৫ কেভি লাইন নিতে চায় দেশটি।’ (আমাদের অর্থনীতি, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)
কানেক্টিভিটির কথা বলেই এসব কাজ হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশকে তিন দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ডিসকানেক্ট করে রেখেছে ভারত। শুধু তা-ই নয়, ‘কানেক্টিভিটি’র এই কালে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অবাধ পানিপ্রবাহকেও ডিসকানেক্ট করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি মানবিকতা বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়; আন্তর্জাতিক আইনস্বীকৃত অধিকার, যা থেকে দশকের পর দশক বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে ভারত। কাঁটাতারের পেছনে বড় যুক্তি, বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসী-জঙ্গির ‘অবাধ চলাচল’ ঠেকানো। বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের থেকে ভারতকে নিরাপদ করাই যদি কাঁটাতারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেই ‘সন্ত্রাসীভরা’ দেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পণ্য ও যাত্রীবাহী যান বা নৌযান চলাচল কীভাবে নিরাপদ হবে? কে নিশ্চয়তা দেবে? কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে রেখে, নদী আটকে রেখে, সুন্দরবন বিনাশ করে বন্ধুত্ব আর কানেক্টিভিটি কীভাবে সম্ভব? উন্নয়নের গল্প দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে তাই এসব প্রশ্ন দূর করা যাচ্ছে না যে, ‘কাঁটাতারে ঘেরা কেন, বন্ধু ভারত যদি/ (কেন) বন হত মানুষ হত আরও হত নদী’?
অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়