সুলতানা কামাল :: উনিশে ফেব্রুয়ারি বেলা একটার দিকে আমি দোতলা থেকে নেমে আমাদের অফিস ঘরে যেতে আমার এক সাবেক সহকর্মী ডেইলি স্টার পত্রিকার বেশ পুরোনো একটা বিশেষ সংখ্যা এনে আমার হাতে দিল। সংখ্যাটির তারিখ ১ জুলাই ২০১১। আমার মা সুফিয়া কামালের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত। ভেতরে মায়ের নানা ছবির সঙ্গে পরিবারের সদস্যদেরও ছবি রয়েছে তাতে। একটি ছবি সুফিয়া কামালের পরিবারের নামে ছাপা হয়েছে। সেটা আমাদের বাড়িতেই তোলা। আমার মা-বাবার সঙ্গে সেই ছবিতে পরিবারের বলতে আছি আমরা দুই বোন আর বড় বোনের ছেলে। আছেন বন্ধু আবুল মোমেন। রয়েছেন যাঁর জন্য সে ছবিটা তোলা হয়েছিল—ভারতের (পুনা) বিখ্যাত চলচ্চিত্রবোদ্ধা সতীশ বাহাদুর আর এককালের সবার পরিচিত আর প্রিয় চলচ্চিত্রকর্মী মুহম্মদ খসরু। খসরু বহুদিন ধরে আমাদের জীবন থেকে উধাও। কত বছর কেটে গেছে নানা ভালো-মন্দে। খসরু আর আমাদের বর্তমান দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে নেই। নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়ে সবার থেকে নিজেকে কেমন যেন আড়াল করে ফেলল ও । ছবির মানুষগুলোকে সহকর্মীদের চেনাতে গিয়ে খসরু প্রবলভাবে ফিরে এল মনের স্মৃতিপটে। কী আশ্চর্য! যখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, সবাইকে পেছনে ফেলে না-ফেরার দেশে যাত্রা করল, তখনই এমনভাবে খসরু আমার মনের দরজায় কড়া নেড়ে গেল!
অপরাজেয় বাংলার সামনে খসরুকে শায়িত রেখে কিছু কথা বলতে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার কথা বলার সামর্থ্য যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। যা বলতে চেয়েছিলাম কিছুই বলতে পারলাম না। খসরুর কাছে যে আমার, আমাদের অনেক ঋণ! সেই তারুণ্যে খসরু আমাদের উদ্দীপিত করেছিল চলচ্চিত্র বলে যে শিল্পটি আছে তার পরিচয় নিতে, স্বাদ পেতে। বইয়ের দোকানে সময় কাটাতে কাটাতে বইকে সুহৃদ বানিয়ে নিয়েছিল খসরু। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধার ধারেননি, বহু শিক্ষিত নামধারীকে বহু পেছনে ফেলার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছিল সে। ওর শিক্ষা প্রকৃত অর্থেই ছিল নিজেকে গড়ে তোলার প্রত্যয়, প্রগতির পথে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার বাহন। এসব করতে করতে খসরু একাই একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চাশের দশক থেকেই সুফিয়া কামাল আর কামালউদ্দীন খানের তারাবাগের আর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দা প্রগতিশীল মানুষদের জন্য একটা বড় প্রশ্রয়ের জায়গা ছিল। তাদেরই একজন খসরুও সেই বারান্দায় তার অন্যতম কর্মক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছিল। আর সেই সুবাদে হয়ে উঠেছিল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন। আমার মায়ের বিশেষ স্নেহের পাত্র খসরু আমাদের পরিবারের প্রায়-সদস্য হিসেবে গণ্য হতো।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের ক্ষুদ্রশিল্প সংস্থায় আলোকচিত্রীর কাজ করত সে। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে খসরুকে। কিন্তু সেই কষ্ট অতিক্রম করে খসরু তার সঙ্গীদের নিয়ে পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিল সুস্থ চলচ্চিত্র শিল্পচর্চার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ সমাজ গড়ার ব্রতে। খসরুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বিস্তারিত বিবরণ স্মরণে আনতে পারি না; কিন্তু এটুকু বলতে পারি ওর হাত ধরেই এ শিল্পকে জানার সুযোগটুকু পেয়েছিলাম। ক্রমে ক্রমে বিশ্বের এক বিরাট ঐশ্বর্যের সন্ধানের যাত্রায় প্রণোদিত হতে পেরেছিলাম। চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস, ব্যাপ্তি, তার কৌশলগত উৎকর্ষ, এর মধ্য দিয়ে জীবনবোধের স্পর্শ পাওয়া—সে এক বিশাল অথচ বিরল অভিজ্ঞতা। আইজেনস্টাইন, রেনোয়াঁ, গদার, পোলানস্কি, কুরোসাওয়া, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনরা যেন হয়ে উঠলেন পরম আত্মীয়।
শুধু ছবি দেখা বা দেখানো নয়, চলচ্চিত্র সংসদকে ঘিরে সাংগঠনিকভাবে মানুষকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসা, চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ধ্রুপদি বের করা, সবকিছুতে খসরু ছিল অবিসংবাদিত নেতা আমাদের কাছে। কাজ আদায় করে নিতে খসরুর মতো কঠোর ‘টাস্ক মাস্টার’ আর কাউকে পাইনি আমার জীবনে। অবহেলার কোনো ক্ষমা ছিল না ওর কাছে। ধ্রুপদির জন্য কীভাবে গদারের ছবির ওপর ভয়ংকর উচ্চমানের এক লেখা অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিল কাইজার চৌধুরী আর আমাকে দিয়ে! কত কাঠখড় পুড়িয়ে সতীশ বাহাদুরের মতো বিদগ্ধ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে এনে ঢাকা আর চাটগাঁয়ে ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন’ কোর্স করিয়েছিল।
এরই ফাঁকে কখন যেন আমাদের পরিবার খসরুর ভরসার জায়গাটি হয়ে উঠেছিল। কঠিন কষ্টের ভেতরেও ওর জীবনযাপনে ও একটা সহজ আর মজার ভঙ্গি বজায় রেখে চলত। মনে পড়ে ছোট বোন টুলু বা আমাদের বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করত খাবার আছে কি না। থাকলে বাড়িতে ঢুকবে নয়তো ওরই ভাষায় খাবারের সন্ধানে অন্য কোথাও যাবে! বড় বোনের মেয়ে সিমিনের ওপর ওর ছিল সস্নেহ দাবির সম্পর্ক। যেকোনো সময়ে চা খাওয়াতেই হবে ওর খসরু মামাকে।
একই সময়ে আমরা তখন ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। প্রতি সন্ধ্যায় আমরা একত্র হই দলের নানা কাজে। সে সময়ে হাসি-আনন্দ আর মজা করে আমাদের সময় কাটত খসরুর সঙ্গে। খসরুর ভালো লাগা, কষ্ট, বেদনা আর ছবি বানানোর স্বপ্নের কথা কখনো কখনো শুনিয়েছে আমাকে। তা এখন এক শীর্ণ প্রবাহে পরিণত। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে খসরুকে একদিন পেলাম বাংলা একাডেমির বইমেলায় আলো-আঁধারিতে একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। দেখলাম ওর দাড়ি কেটে ফেলেছে। জিজ্ঞেস করলাম দাড়ি কী হলো। স্বভাবসুলভ হাসি হেসে উত্তর দিল, ‘শিবিরে লয়া গেসে!’ খসরুর সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা, তারপর আবার খসরু অতীত হয়ে গিয়েছিল আমার জীবনে। কিন্তু চলে যাওয়ার সময়টাতে কাকতালীয়ভাবে পরিবারের ছবিতে ভর করে খসরু আবার যেন আমার বর্তমানে জায়গা করে নিল। খসরুকে স্মরণ করি পরম মমতায়, অনেক শ্রদ্ধায়।