:: ইমরান আহমেদ চৌধুরী ::
স্বাধীনতা যুদ্ধ আমার জীবনের একটা সবচে’ বড় অধ্যায়।স্বাধীনতা সংগ্রাম আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ভিন্নভাবে। ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল, সেই ৪৯টি বছর যাবত বহন করে আসছি এক বিশাল গল্প, এক বিভীষিকাময় অন্নুছেদ, এক দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক, এক ভয় ভীতি, এক যন্ত্রণা এবং এক না বলা গল্প । সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা প্রত্যহ মনের পর্দায় ভেসে উঠে বারবার । জীবন থেকে উড়ে গেছে ঘটনাবহুল এই কয়েকটি মাস ; আপাতঃ দৃষ্টিতে যদিও মনে হবে অল্প কয়েকদিন কিন্তু বাস্তবতায় ঐ দিনগুল ছিল বাঙ্গালী জাতির জীবনের তথা আমার জীবনের সবচে কঠিন সময়! এ রকম সময় আমি চাই না অথবা আশাও করিনা আসুক আর কোন আমার বয়সী বালকের জীবনে । জীবনের সব আশা, সব ভরসা এবং সকল মনোজ্ঞতা–সুবন্দোবস্ত কেড়ে নিয়েছিল আমার এবং আমার পরিবারের জীবন থেকে । মৃত্যুর ভয় পশুর মত হত্যা হবার ভীতি সর্বপরি হত্যাকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য পলায়ন যে কি কঠিন এক সংকল্প , এবং ওটা যে কি পরিমাণ ভয়ানক তা’ প্রকাশ করাও এক বিশাল কাজ । চোখের পলকে গৃহ বিহীন হয়ে যাওয়া, পরবর্তী আহারের কোন বন্দোবস্ত না থাকা, সন্ধ্যা নেমে আসার পর কোথায় রাত্রিযাপন করা হবে সেটা না জানা এক একটা সবগুলোই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন । বিছিন্ন সংসার, পরিবার ; মা ও আমরা ভাইবোন একসাথে, পিতা কয়েকশ মাইল দূরে চাকরীস্থলে, বোন তার হোস্টেলে রাজধানীতে অধ্যয়নরত, এক ভাই দেশেরঅন্য প্রান্তে বোর্ডিং স্কুলে । সে যেন এক বিভীষিকাময় প্রহর ।শত্রুর বিমান হামলা পর পর দুবার হওয়ার পর শহরের দুই প্রান্ত থেকে শত্রুর অনুপ্রবেশ, গগন বিদারী গোলাগুলির আওয়াজ, বিমানের ভূমিকম্প সম বিদীর্ণ ভয়ঙ্করভাবে অপ্রকিতস্তু হবার মত গুলিবর্ষণ, দূর দিগন্তে ধেয়ে আসা শত্রুর ইয়া আলী ও আল্লাহু আকবর হুঙ্কার এর মধ্যে আমরা কজন প্রাণ হাতে নিয়ে ধেয়ে চলছি এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে – আলিঙ্গন করতে করতে এগিয়ে চললাম এক অজানা ভবিষ্যতকে । গৃহহীন, খাদ্যহীন, ভবিষ্যত বিহীন, দিকবিহীন অর্বাচীন, নির্বুদ্ধির মত পথ এগুচ্ছিলাম আমরা । ক্লান্ত, অবসন্ন, শুষ্ক শ্বাস প্রশ্বাস নালিকা ও টুঁটি নিয়ে মাইল পর মাইল দৌঁড়ানো সঙ্গে মৃত্যুভয় যে কি এক কষ্টকর কাজ সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত ভাষা আমার নেই । অযাচিত অথিতি, অনাগত এবং অভ্যর্থনা বিহীন ভাবে কারো পরিবারে আশ্রয় নেওয়া কি নিম্ন ধরনের কাজ তা সহজেই অনুমান করা ।
নিত্তনৈমত্তিক ব্যাবহারিক জিনিশষর অভাব, এক কাপড়, এক স্যান্ডেল, এক তোয়ালে, বিছানার অভাব, বালিশ ও তোশকবিহীন, অপর্যাপ্ত খাবার, খাবারের স্বাদ ভিন্ন, সারারাত-দিন পর্যাপ্ত অফুরন্ত সময় । আতিথেয়তা যবনিকা টেনে অগস্থযাত্রা, সে একভিন্ন অভিজ্ঞতা , এক এক্সুডাস, এক বিশাল পথযাত্রা , পায়ে হেঁটে, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, কাদা, পানি, নৌকা, দৌড়ে দৌড়ে, তুফান, কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব, নিমিষেই তাপমাত্রা কমে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা, সাঁকোর অবাস্তব পাটাতন এবং হাত দিয়ে ধরার ব্যবস্থা বাচ্চা বা বালক, কিশোরদের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদাসীনতার উদাহরণ । অবিরাম হেঁটে, কোন প্রকার খাবার নে খেয়েই ১৭ – ১৮ মাইল হেঁটে পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তে পদার্পণ ।সীমান্তের এক বারে গা ঘেঁষে থাকা গ্রামে অবস্থান গ্রহণ – অবিরাম কামানের গোলার আওয়াজ এই সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করার সময় । ঐ সীমান্তবর্তী গ্রামের পরিত্যক্ত স্কুলের ভিতর কয়েক রাত যাপন করে – এক দিন ভারতে প্রবেশ করার পর ভারতীয় এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করা ভারতীয় বি এস এফ বাহিনীর সহায়তায় । অতঃপর রিফ্যুজি ক্যাম্পে প্রবেশ । জীবনের এক নতুন অধ্যায় । ক্যাম্পে পরিবারের একমাত্র বোয়জোস্ট পুরুষ হিসাবে সদস্য এর অর্পিত দায়িত্ব । পাশে পাশে স্বাধীনতার সংগ্রামের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সামাজিক এবং সমাজ কর্মী হওয়া থেকে শুরু করে ঔষধ বিতারন, কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ করা । সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাম্পে যেয়ে গান গাওয়া ওদের মনোরঞ্জন এবং মানবিক বল বাড়ানোর আরও জাগ্রত দেশ প্রেম চাঙ্গা করা । নতুন পত্রিকা জয় বাংলা বিতরণ করা এবং শেষ কয় দিন অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে আগরতালার প্রসিদ্ধ জি বি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ার্ড – জয় বাংলা ওয়ার্ডে নার্সদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে করতেই একদিন স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রাপ্তি কিভাবে হল তারই এক অনবদ্য কাহিনীকে লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি আমার এই ছোট্ট প্রয়াসে । অনেক বছর আগের এই স্মৃতি – এক ১১ বছরবয়সী বালকের নিজের চোখে দেখা, নিজের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই ঝর, আত্ম-উপলব্ধির এই উপাখ্যান যা আজও ৪৯ বছর পরও প্রকাশ্য দিবালোকের মত উজ্জ্বল এবং প্রকট। এই উপাখ্যান এর উৎপত্তি সেই ফেব্রুয়ারী – মার্চের টালমাটাল দিনগুলোতে কি দেখেছি, করেছি, শিখেছি এবং তারই পথ ধরে পঁচিশে মার্চ এর গণহত্যা থেকে একে একে কিভাবে সমগ্র দেশ পাকিস্তা নিবর্বর বাহিনী কব্জা করে ফেলল ক্রামন্বয়ে শুরু হল প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ, প্রতিহত এর মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, গণহত্যা, এথনিক ক্লিনযিং, বাঙ্গালি রেস ( জাতিকে ) পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার এক অপপ্রায়াশ, জার্মানির কুখ্যাত হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর ইউরোপ তথা বিশ্ব থেকে ইহুদিদের হোলক্যাস্ট মাধ্যমে হত্যা করার মত । নাৎসিদের পদাঙ্ক হুবুহু অবলম্বন করে কি ভাবে পাকিস্তান আর্মি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার, আমলা এবং জনগণ পূর্ব পাকিস্তানকে বাঙ্গালি শূন্য করতে চেয়েছিল তারই এক বীভৎস রোজনামচা আমার এই ক্ষুদ্র বইখানা । (চলবে)
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
নর্থহ্যাম্পটন, ইউ কে
এপ্রিল, 2020