॥ ইমরান আহমেদ চৌধুরী ॥
স্বাধীনতা যুদ্ধ আমার জীবনের ঘটে যাওয়া একটা সবচে’ বড় অধ্যায় – স্বাধীনতা সংগ্রাম আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ভিন্নভাবে । ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল এই ৪৯টি বছর যাবত বহন করে আসছি এক বিশাল গল্প, এক বিভীষিকাময় অন্নুছেদ, এক দুঃস্বপ্ন, মহা এক আতঙ্ক, এক ভয়, এক ভীতি, এক যন্ত্রণা এবং এক না বলা বিরগাথা । সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা বারবার প্রত্যহ মনের পর্দায় ভেসে উঠে । জীবন থেকে উড়ে গেছে ঘটনাবহুল এই কয়েকটি মাস ; আপাতঃ দৃষ্টিতে যদিও মনে হবে অল্প কয়েকটা দিন কিন্তু বাস্তবতায় ঐ দিনগুলো ছিল বাঙ্গালী জাতির জীবনের তথা আমার জীবনের সবচে কঠিন সময় ; এরকম সময় আমি চাই না অথবা আশাও করিনা, আসুক আর কোন আমার মত ১১ বছর বয়সী বালকের জীবনে এই পৃথিবীর কোন দেশে। সে যেন এক বিভীষিকাময় প্রহর । শত্রুর বিমান হামলা, শহরের দুই প্রান্ত থেকে শত্রুর অনুপ্রবেশ – গগন বিদারী গোলাগুলির আওয়াজ, বিমানের ভূমিকম্পসম বিদীর্ণ আওয়াজ, ভয়ঙ্করভাবে অপ্রকিতস্তু হবার মত গুলিবর্ষণ ও বোমা বর্ষণ ।
তাইতো হৃদয়ের স্পন্দের সাথে গাঁথা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার ইতিহাস নিয়ে যেই অনুসন্ধান, আবৃতি, বই লেখে অবচেতন মনেই কেমন জানি অমোঘভাবেই পৌঁছে তার নিকট, খুঁজে পাই এক অবারিত সংহতি, এক পারস্পরিক নির্ভতা। তারই পথ ধরে আমার সাথে আনোয়ার শাহজাহানের আত্মিক এক সম্পৃক্ততা । তার লেখা বই সিলেট এর ‘‘ স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা’‘ এবং ”সিলেটের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ‘’ আমার বুক সেল্ভের ”স্বাধীনতা যুদ্ধ ‘‘ সেকশনে খুবি যত্ন করে সাজানো এক গুচ্ছ বই । যখনই স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে ভাবি, রিসার্চ করি, লেখি, স্মৃতিচারণ করি তখনি অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে এই দুইটা/ তিনটা বইকেও বের করে এনে পাতার পর পাতা উলটাই , পড়ি, টেক্সট হাই লাইটার দিয়ে মারকিং করি আর হারিয়ে যাই ১৯৭১ এর সেই স্মৃতির বিভীষিকায় অতল গর্ভে। সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমার সম্পৃক্ততা খুবই সুনিবিড় – ২৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে সকাল ৯–১৫ মিনিটে শমশেরনগর বিমান বন্দরে আমার পিতার ( এ, ডি ফজলুল হক চৌধুরী ) নেতৃত্বেই প্রথম বিদ্রোহ রচিত হয়েছিল ,, । উনি তার ই,পি, আর কোম্পানি নিয়েই প্রথম আক্রমণ করেই পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তারপর সিলেট আক্রমণ, কৈলাসশহর, করিমগঞ্জ , মাসিমপুর হয়ে ৪ নম্বর সেক্টর এর কর্নেল সি আর দত্ত, ক্যাপ্টেন রব এর সাথে সিলেট দখল করে ।
আমিও হারিয়েছি আমাদের অগ্রজকে এই মুক্তির সংগ্রামে, আমাদের বড় ভাই শহীদ বাবুল চৌধুরী ( যে একজন সিলেট রাজা জি, সি, স্কুলের ছাত্র ছিল) কে পাকিস্তান আর্মি ২১সে নভেম্বর ১৯৭১ সালে – ঈদ উল ফিতর এর দিন বন্দী অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে হত্যা করে।
আনোয়ার শাহজাহানের লেখা এই বইগুলো সত্যি প্রশংসার দাবিদার। অত্যন্ত যত্নসহকারে অনুসন্ধান করে তিনি বের করেছেন সব খেতাবপ্রাপ্তদের নামগুলো। আমার এখনো মনে আছে যখন এই খেতাবপ্রাপ্তদের নাম ইত্তেফাক পত্রিকায় বের হয় ১৯৭৩ সালে আমার বয়স তখন ১৩বছর । ব্যক্তিগত জীবনে সিলেটের অনেক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমি পরিচিত । বি,ডি, আর এর নায়েক আরব আলি বীর বিক্রম আমার পিতার খুবি প্রিয়ভাজন ছিলেন ।তারপর তাহের আলি বীর বিক্রম আমার কোম্পানির সিনিয়র জেসিও ছিলেন অনেক দিন, নিভৃতে রাতে ওনার শোনতাম তার বীর গাঁথা ১৯৭১ সালের – এখনো মাঝে মাঝে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ফোনে কথা বলি তাহের বি বি’র সাথে । সিরাজুল ইসলাম (ভি, পি, সিরাজ) বীর প্রতীক আমার অত্যন্ত পরিচিত শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজতুল্য, প্রচারণা বিমুখ এক মহাবীর উনি – ওনার মুখেও শুনেছি তাঁর বীরত্বের ইতিহাস। আমি বিমুগ্ধ যে, আমাদের যুদ্ধের পরে জন্মগ্রহণকারী লেখক তাঁর মাতৃভূমির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি উৎসর্গ করেছে তাঁর লেখনী তা’ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার ।
আনোয়ার এর অন্য আরেকটি বই ‘‘ সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ ‘‘ একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় লেখনী , তাঁর এই বইটি আগামী শতাব্দের পর শতাব্দী ধরে আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে একটি কালের সাক্ষী হিসেবে কাজ করবে। আমি এই বইটার জন্য তাঁকে ভূয়সী প্রশংসা করি। তাঁর এই বই এর ৩৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হাবিলদার গোলাম রসুল বীর বিক্রম আমার পিতার ই, পি, আর, কোম্পানির সদস্য ছিল ; ৩ উইং ই, পি, আর এর বি কোম্পানির । গোলাম রসুলদের কবরটাও আমার পিতার হাতে দেওয়া ।
পরিশেষে, আমি আনোয়ারকে জানাই আমার শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা তাঁর এই ইতিহাস লেখনীর মত মহৎ কাজটি হাতে নেওয়ার জন্য।
আশা করি, যে যুগ যুগ ধরে আমাদের আগামী প্রজন্মরা পড়ুক এবং তারা জানুক কি আত্মত্যাগ এর মাধ্যমে আমাদের বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তি সেনারা এই দেশটি উপহার দিয়েছে তাদেরকে ।
বিন্রম শ্রদ্ধা জানাই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের ।
ল্যেফটেনান্ট ইমরান আহমেদ চৌধুরী
লেখক, ইতিহাসবিদ
নর্থহ্যাম্পটন
ইউ ,কে