সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে কেন?

:: মশিউল আলম ::

একটা সময় ছিল, যখন সাধারণ মানুষ ‘পেপারে লিখেছে’ বললেই ধরে নিত, সংবাদপত্রে যা ছাপা হয়েছে, তা সত্য। তাই যারা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা রকমের অন্যায়-অপকর্ম করে, তারা সতর্ক থাকত তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যেন ‘পেপারিং’ না হয়। এখনো এই মানসিকতার খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) নামের এক বেসরকারি সংস্থার একটি জরিপ বলছে, এ দেশের মাত্র ১৪ শতাংশ পাঠক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পুরোপুরি সত্য বলে বিশ্বাস করে।

একান্তই ছোট পরিসরে (১৪০ জন মানুষের মধ্যে) পরিচালিত এই জরিপে যদি দেশের বৃহত্তর চিত্রই প্রতিফলিত হয়ে থাকে, তবে পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য এটা একটা বড় দুঃসংবাদ। এর মানে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বেশ কমে গেছে। সংবাদপত্রগুলোতে যা ছাপা হচ্ছে, অধিকাংশ পাঠকই তা সত্য বলে বিশ্বাস করছে না। কিন্তু পাঠক-দর্শকদের আস্থাই সংবাদমাধ্যমের মৌলিক পুঁজি। সেটাই যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন আমরা কেন, কী উদ্দেশ্যে সাংবাদিকতা করছি? আমরা সত্য বলে যা প্রকাশ করছি, যাদের জন্য তা প্রকাশ করছি, তারা যদি সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস না করে, তাহলে আমাদের এই কাজের অর্থ বা সার্থকতা কী?

এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। জনগণ যা বিশ্বাস করে না, তা লেখার কোনো অর্থ হয় না। তবে কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয়, এখনো ১৪ শতাংশ মানুষ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনগুলো ‘পুরোপুরি সত্য’ বলে বিশ্বাস করছে। ‘মোটামুটি সত্য’ বলে বিশ্বাস করছে ২৪ শতাংশ। কিন্তু পাঠকদের এই দুটি অংশই বেশ ছোট, বড় অংশ মানে ৫৮ শতাংশের মনে প্রতিবেদনের কোনো কোনো ঘটনার বিবরণ বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে ‘সন্দেহ’ তৈরি করে।

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন, আরও বড় পরিসরে গবেষণা সমীক্ষা চালানো প্রয়োজন। এই ‘সন্দেহ’ দূর করার জন্য সাংবাদিক ও সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক কাজ করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রথমেই জানার ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে সংবাদমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস কমে যাচ্ছে কী কারণে। এ বিষয়ে ব্যাপক পরিসরে মতামত জরিপ করা উচিত। তবে সাধারণভাবেও কিছু সম্ভাব্য কারণ শনাক্ত করা যায়।

সংবাদমাধ্যমের আস্থা কমে যাওয়ার সমস্যা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়, এ সমস্যা বৈশ্বিক। সাম্প্রতিক কালে এ নিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। এর একটা কারণ তথ্য ও খবর এবং এ দুইয়ের মতো করে পরিবেশিত, সঞ্চালিত, প্রচারিত, পুনঃপ্রচারিত গুজব বা ভুয়া খবরের প্রাচুর্য। শুধু গুজব বা শুধু ভুয়া খবরই যে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করেছে তা নয়, আংশিক সত্য খবর এবং ভিন্ন ভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একই ঘটনা বা একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকমের তথ্য-উপাত্ত-ভাষ্য প্রচারিত হওয়ার ফলেও একই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

এই ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অসংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকা বেশি; তবে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের দায়ও কম নয়। একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমের কিছু কর্মীর মধ্যে চাঞ্চল্যকর খবর প্রচারে অতি উৎসাহ কাজ করে; অতি দ্রুত বা ‘সবার আগে’ সংবাদ পরিবেশনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সাংবাদিকেরা খবরের যথার্থতা ভালোভাবে যাচাই করার পেছনে সময় ব্যয় করতে চান না। এটা অনলাইন সংবাদমাধ্যমে বেশি ঘটে। ফলে দেখা যায়, কখনো কখনো একই সংবাদপ্রতিষ্ঠানের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত খবর ও পরদিন প্রকাশিত ছাপা সংস্করণের খবর এক রকম নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনলাইন সংস্করণের ভুল ছাপা সংস্করণে পুনরাবৃত্ত হয় না। কোনো কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান খবর পরিবেশনে সময়ের দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে খবরটির যথার্থতা যাচাইয়ের পেছনে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ব্যয় করার কারণে। কিন্তু অধিকাংশের প্রবণতা এর উল্টো, সবার আগে ‘নিউজ ব্রেক’ করার প্রতিযোগিতায় নেমে বেঠিক বা ভুল সংবাদ পরিবেশনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি রয়েছে। এমআরডিআইয়ের উল্লিখিত জরিপের আরেকটি তথ্য হচ্ছে, এ দেশের সংবাদমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়, তার ৪৪ শতাংশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা বা নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয় না। অবশ্য এমন কথা বলা যাবে না যে এর সম্পূর্ণটাই সচেতনভাবে নিয়মকানুন ভঙ্গ করা। অনেক কারণে নিয়মকানুন অনুসৃত না হতে পারে; সাংবাদিকদের জানা-বোঝার ঘাটতিও একটা কারণ। অনেক সাংবাদিক জানেন না কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়, অনেকের জানা নেই যে একটি ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখতে গেলে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত সব পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে হয় এবং তাদের বক্তব্য প্রতিবেদনে স্থান দিতে হয়। এমনকি, অনেক সাংবাদিকের জানা নেই, খবরের বা তথ্যের সূত্র উল্লেখ করতে হয়।

ভালো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাংবাদিকদের এই ঘাটতিগুলো অবশ্যই দূর করা সম্ভব। কিন্তু যেসব সাংবাদিক সচেতনভাবেই সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা এড়িয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন, যাঁরা ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ করেন, তাঁরা এই পেশার ক্ষতি করেন। সাংবাদিকেরা নানা ধরনের বাধাবিপত্তি, ভয়ভীতি, চাপ, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে তাঁদের একটা অংশ সচেতনভাবে অপসাংবাদিকতারও আশ্রয় নিয়ে থাকেন। সংবাদমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার জন্য তাঁদেরও দায়ী করতে হয়।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের নিজেদেরই কথা বলা উচিত, কিন্তু বলা হয় না। সাংবাদিকেরা অন্যান্য পেশার মানুষদের অনিয়ম-দুর্নীতি, অন্যায়-অপকর্ম নিয়ে যত লেখালেখি করেন, নিজেদের এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও করেন না। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের ভুল-ত্রুটি-অন্যায়ের প্রতিকারের চেষ্টা না করি, এসব ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকি, তাহলে আমাদের পেশার মর্যাদা কমতেই থাকবে। ইতিমধ্যেই যে কমেনি, তা-ই বা কে বলতে পারে? আমরা তো কখনো জানার চেষ্টা করি না জনসাধারণ আমাদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে। বোঝার চেষ্টা করি না সাংবাদিক কথাটাকে বিকৃত করে কেন ‘সাংঘাতিক’ বলে অশ্রদ্ধা বা বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করা হয়। সাংবাদিকদের নীতিনৈতিকতা মেনে কাজ করার ক্ষেত্রে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব আছে। কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মী নীতিনৈতিকতার বাইরে কিছু করলে, তাঁর বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া ওই সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কর্তব্য। কারণ, এই ধরনের সংবাদকর্মী বা সাংবাদিকের অন্যায় আচরণ সংবাদপ্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, আস্থার সংকট সৃষ্টি করে। সাংবাদিকতা পেশারও মর্যাদাহানি ঘটে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউটে এমআরডিআইয়ের জরিপ প্রতিবেদনটির তথ্যাবলি তুলে ধরার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন সংবাদপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকেরা। তাঁদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চাপ রয়েছে। এমনকি, একটি সংস্থা কয়েকজন সম্পাদককে ডেকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিলিপি ধরিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের কোনো বক্তব্য ছাড়াই তা প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়েছে। সংবাদপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাব খাটানোরও অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। এগুলোও সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে এবং তার ফলে সংবাদমাধ্যমের ওপর জনসাধারণের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়। যদিও সংবাদ সংগ্রহ ও প্রতিবেদন রচনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধিকাংশ পাঠক অবগত নন এবং উল্লিখিত অভিযোগগুলোর কথা সাধারণত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না, তবু স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধাবিপত্তির নেতিবাচক প্রভাব চাপা থাকে না। চাপের মুখে থাকা সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য হলো, সেই চাপের প্রতিফলন সাংবাদিকদের প্রতিবেদনেও ফুটে উঠতে পারে। আমাদের সংবাদমাধ্যমে সেই চাপ এখন আগের তুলনায় বেশি করে প্রতিফলিত হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষমতাধর কর্তৃপক্ষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়াতে সমঝে চলা সাংবাদিকতা এই সময়ের সংবাদমাধ্যমের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। শুধু সরকারি সংস্থা, সংবাদমাধ্যমের মালিকপক্ষ ও বিজ্ঞাপনদাতারা নয়, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের করপোরেট স্বার্থ, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোর দিক থেকেও নানা রকমের বাধাবিপত্তি আছে। দেশের সামগ্রিক পরিবেশ স্বাধীন ও নির্ভয় সাংবাদিকতার অনুকূল নেই। সেলফ সেন্সরশিপের চর্চা এখন বেশি হচ্ছে।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই: গুজব, ভুয়া খবর, অসতর্কভাবে তৈরি করা আংশিক সত্য সংবাদ ইত্যাদির প্রাচুর্য, একশ্রেণির সাংবাদিকের সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা মেনে না চলার প্রবণতা, সরকারি সংস্থাগুলোর চাপ, মালিকপক্ষ ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাব এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হওয়ার শঙ্কা থেকে স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ—এই সমস্ত কিছুর প্রভাবে সাংবাদিকতার গুণতম মান নেমে যাচ্ছে এবং তার ফলে সংবাদমাধ্যমের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

এই বিরাট ও জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য যা করা দরকার, তা শুধু সাংবাদিকেরা করতে পারবেন না। পাঠক-দর্শককে সামনে রেখে, সাংবাদিকতা পেশাকে ‘পাবলিক সার্ভিস’ হিসেবে অটুট রাখার স্বার্থে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সব পক্ষকে গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শুধু গণতান্ত্রিক পরিবেশেই স্বাধীন ও জনহিতকর সাংবাদিকতা সম্ভব।

মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Advertisement