কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

ববিতা

পরিচালনা ও লেখালেখি অনেকেই ভালো করেন-কিন্তু গণমানুষের প্রাণের স্পন্দনের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন, এমন পরিচালক একটি দেশে খুব বেশি থাকে না। আমাদের দেশে আমজাদ হোসেন ঠিক তেমনই একজন পরিচালক- যিনি গণমানুষের প্রাণের স্পন্দনে মিশে গেছেন। সেই ষাটের দশকে এ দেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। অল্প সময়েই হয়ে উঠেছিলেন সবার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়। বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল বা সেরা মহীরুহদের একজন আমজাদ হোসেন- যিনি একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার, সংলাপকার, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাকে ভালোবাসেন না, এমন একজন মানুষও কি এই দেশে পাওয়া যাবে? এটি এক বিরল ঘটনা। তার এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি তার অসামান্য নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ভালোবাসার কারণেই। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও নিখুঁতভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন। একজন প্রকৃত ও গুণী শিল্পী হিসেবে এই নিষ্ঠা তার ছিল।

আমজাদ ভাই নেই- বড় আঘাত পাওয়ার মতো খবর। অবিশ্বাস্য।

আমি কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারছি না। খুবই কষ্ট হচ্ছে আমার। এতদিন ধরে কাজ করেছি, যা স্মৃতিকোষে আজও জমা হয়ে আছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই দিনগুলোর দৃশ্যপট; আর অশ্রুসিক্ত করছে আমাকে।

কতদিনের পরিচয় আমাদের- তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। দিন, তারিখ, মাস, বছর কোনোটাই মনে নেই। তার অনেক চলচ্চিত্রে আমি অভিনয় করেছি। ভীষণ প্রিয় একজন মানুষ আমার। তার মতো আবেগী মানুষ আমার অভিনয় জীবনে খুব কমই দেখেছি। তার নির্দেশনায় প্রথম ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করি, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অভিনয় করে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে আশা করি।’ সত্যিই ‘নয়নমণি’ দর্শকের কাছে একজন অভিনেত্রী হিসেবে আমাকে অন্যরকম এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ‘নয়নমণি’র পর ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘বড় বাড়ির মেয়ে’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। যারা সত্যিকার অর্থে বড় মাপের নির্মাতা তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু গুণ থাকে, যা সহজেই অন্য অনেকের চেয়ে তাকে আলাদা করে দেয়। আমজাদ ভাই ঠিক তেমনি একজন গুণী মানুষ, নির্মাতা। আমজাদ ভাইয়ের মতো গুণী মানুষ তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন।

ষাট দশকের পাকিস্তানি ছবির দাপটের মধ্যে এ দেশে কম বাজেটের বাংলা ছবি নির্মাণ করা রীতিমতো যুদ্ধ ছিল। আমজাদ হোসেন ছিলেন এ দেশের সিনেমার পক্ষে সেই লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান যোদ্ধা। তিনি নিরলস পরিশ্রমে বাংলা চলচ্চিত্রকে দৃঢ় ভিত্তিমূলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি ইতিহাসের অনিবার্য অংশ।

এই তো সেদিন শেষবার তাকে দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। দূর থেকে তার মুখখানা দেখে হাজারো স্মৃতি ভেসে উঠেছিল মানসপটে।

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে একটা মাইলফলক ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছে ছবিটি। কী অসাধারণ এর নির্মাণশৈলী। ছবিটিতে ছিল বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের গল্প। ছবির প্রতিটি সংলাপ মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। সে সময় তো অফিস-আদালত, হাটে-বাজারে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির সংলাপ সবার মুখে ফিরত। বিশেষ করে ওই কথাটা তো ছড়িয়ে গিয়েছিল-গোলাপীকে প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘তোমরা যে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে এসে ঢুকলা, তোমরা টিকেট কেটেছো?’ উত্তরে সে বলছে, ‘বাংলাদেশে কোনো কেলাস [ক্লাস] নাইক্যা, আমরা হগলেই এক কেলাসের [ক্লাস] মানুষ।’ এই সংলাপটি কী অসাধারণ ভাবেই না আমজাদ ভাই সেলুলয়েডের পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এখনও পর্দায় দেখলে হারিয়ে যাই অন্য ভুবনে। আমজাদ হোসেন সমকালীন মেধাবী নির্মাতাদের একজন। মনে আছে যখন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র কাজ করছি, সেই সময় ট্রেনে বসেই আমজাদ ভাই লিখলেন ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’ গানটি। গানটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখনও গানটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

দীর্ঘ সময় ধরে চলচ্চিত্র অঙ্গনে আমাদের পদচারণা ছিল। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি, পরিচালনা, অভিনয় আর লেখালেখির প্রতি তার আছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। শিল্পীসত্তাকে সমৃদ্ধ করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। চলচ্চিত্রকার-লেখক পরিচয়ের বাইরেও একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। সবার বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতেন। এ জন্য আমজাদ হোসেনের তুলনা চলে কেবল তার সঙ্গেই। সময়কে অতিক্রম করে যাওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা ছিল তার। খ্যাতির মোহ কখনও পেয়ে বসেনি। কাজের বিষয়ে আপস করতেন না। সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল নিজের কাজটিকে ভালো করে তুলে ধরার। এমন একজন যখন আমাদের ছেড়ে চলে যান, তখন কত বড় শূন্যতা তৈরি হয়, তা বলাই বাহুল্য।

যখন খবর এলো আমজাদ হোসেন আর নেই, তখন বাঁধভাঙা অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। অবশ্য আমি মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে, মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। তিনি এই দেশের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তার মৃত্যু নেই। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন আছে, আমজাদ হোসেনের অবস্থান চির অমলিন হয়ে রইবে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দুঃখ, আমরা আর মানুষটিকে চোখে দেখব না। এই তো নিয়তি। বিদায় প্রিয় ভাই। প্রিয় বন্ধু, বিদায়।

Advertisement