ছোটগল্প তবে বাস্তব ঘটনার আলোকে

:লিনু ফারজানা:

শাজান পর্ব ১

যতই নিত্য নতুন বই পড়ি হুমায়ুন আহমেদ আমার পিছু ছাড়েনা।

নির্মম বাস্তবতা উঠে আসে কি অবলীলায়।প্রতিটা উপখ্যানের সবকিছুই কত পরিচিত।

হিমুর রসিকতায় হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়, মিসির আলির কর্মকাণ্ড হেলুসিনেশন বাড়িয়ে দেয়।কানাবাবা শুভ্র, টুনি, রফিক, বাকের ভাই, রূপা,নবনী,লীলাবতি,নাদিয়া,

তিথি, ওরা সবাই কত আপন।অনেক আগে ছোটবেলায় একবার কাজল খালার সাথে উনার শ্বশূর কূলের এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম।দেখতে শুভ্রর মতো এক ছেলেকে দেখে চমকে উঠেছিলাম।অবিকল শুভ্রের মতো দেখতে ছেলেটার চোখে সবসময় থাকত ভারি ফ্রেমের চশমা।

লণ্ডন প্রবাসী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান মা ছাড়া কিছুই বুঝেনা।

আমি তো ভেবে পাইনা হুমায়ুন আহমেদের বই থেকে ছেলেটা বেরিয়ে আসলো কেমনে!!নয়তো হুমায়ুন আহমেদ এই ছেলেটাকে নিয়েই লিখেছেন।

সাহস করে জিজ্ঞেস করা হয় নাই……. এই তুমি কি হুমায়ুন আহমেদ কে চেন?সিলেটী আর ইংরেজি মিশিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা ছেলেটা হুমায়ুন আহমেদকে আলবৎ চিনতে পারতোনা।

আমাদের ড্রাইভার শাহজাহান ও টেইলর নাণ্টুর কথাবার্তা শুনলেই আমার কেবল মনে হয় বেচারা হুমায়ুন আহমেদের জলজ্যান্ত চরিত্র।অতিশয় বাকপটু নান্টু ও মিথ্যা বলায় পারদর্শি শাহজাহান।

কারণে অকারনে মিথ্যা বলে শাহজাহান যে কতবার বিপদে পড়েছে তার হিসেব নেই।২০১৩/১৪ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশ খুব উত্তপ্ত।

জামায়াত ইসলামীর নেতাদের ফাসি নিয়ে ঘন ঘন হরতাল ডাকা হচ্ছে।পুলিশের চিরুনি অভিযানে জামায়াত নেতাকর্মীরা বেশির ভাগই শহর ছেড়ে শহরতলীতে আশ্রয় নিয়েছে।এর মধ্যে শুরু হয়েছে জংগি তৎপরতা।

কোন এক হরতালের আগের রাত্রে পুলিশ হানা দিয়েছে চিকনাগুল বাজার ও মাদ্রাসায়।শাহজাহান মিয়া দীর্ঘমেয়াদী হরতাল উদযাপন করতে ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে এক দোকানে বসে লুডু খেলছিলেন।

বেরসিক পুলিশের তাণ্ডবে লুডু খেলা খালি পণ্ড হলনা, অর্ধশত লোককে জামায়াত কর্মি বানিয়ে থানায় নিয়ে গেল।থুতনিতে কয়েক গুচ্ছ দাড়ি শাহজাহান মিয়ার জন্য কাল হল।অনেকেই ঐদিন ছাড়া পেলেও সম্ভাব্য সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত করে শাহজাহান কে গরাদে রাখা হল।অনেক রাত্রে কর্তার কাছে খবর আসলো শাহজানকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।প্রথমে শাহপরান থানায় পরে জৈন্তা থানায় খবর নেয়া হলো।কোথাও শাহজানের খবর পাওয়া গেলনা।এইদিকে নিখোজ স্বামীর খোজে আর ক্রসফায়ারের ভয়ে শাজানের বউ ও অনেক উৎকণ্ঠিত।আমরা ও উৎকন্ঠায় নির্ঘুম রাত কাটালাম।শাহজান গেল কই?ভোরে উঠে কর্তা কোর্টে গেলেন।খবর পেলেন সব আসামী কে কোর্টে নেয়া হবে।অনেক আসামী র ভিড়ে আমাদের শাজান আছে কিন্তু আসামীর লিস্টে শাজানের নাম নেই।

তাকে কোর্টে জামিন করানো গেলোনা লিস্টে নাম না থাকার কারনে।জানা গেল শাহ আলম নামে এক আসামী কে প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে সে আমদের শাজান।পরের দিন তার শালা গেল তার সাথে জেলে দেখা করতে।আসল খবর নিয়ে আসলো,…….পুলিশকে শাজান তার নাম বলেছে শাহ আলম।

এইটা তার স্বভাবসুলভ মিথ্যা বলার অংশ ও পুলিশের হাত থেকে বেচে যাওয়ার ফন্দি।সে ভেবেছে ভুল নাম বললে তাকে জেলে যেতে হবেনা।

অতি চালাকের গলায় দড়ি।দীর্ঘ চারমাস জেল কেটে বের হলেও মামলা শেষ হয়নি।

এখনো প্রতিমাসে অন্তত একবার হরতালে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতির মামলায় তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়।শাজানের মিথ্যা আর বোকামির আরো কাহিনী আসবে একে একে।সেই সাথে নান্টুর ও।

শাজান কাহিনী পর্ব ২••
একবার বাসা থেকে কিছু টাকা খোয়া গেল।

স্বাভাবিক ভাবে সন্দেহটা কাজের লোকদের দিকেই বেশি ছিল।টাকার অংকটাও কম ছিলনা তাছাড়া এতবড় অন্যায় মুখবুজে সহ্য করাও যাচ্ছেনা।তাই সবাইকে সরাসরি না বলে একটু অন্যভাবে বললাম এইখানে কিছু টাকা রাখা ছিল,খোজে দেখিও তো কোন চিপায় চাপায় পড়েছে কিনা বা নিজেরাই ভুল করে অন্য জায়গায় রেখেছি কি না।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে যখন টাকা উদ্ধার করা গেল না তখন শুক্কুর মিয়া বললেন উনার পরিচিত এক পিরানী আছেন যিনি আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে সব হারানো জিনিস খুজে বের করে দেন।আমি প্রবল উৎসাহ নিয়ে বললাম ভালো তো এই রকম হলে চুরি চামারি কমে ১% এ নেমে আসবে।

সাথে সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া চারশ কোটি টাকারও একটা হিল্লা হবে।পিরানির কাছে যেতে হয় শনি মঙ্গল বারে।

তুলা রাশির পাঁচ ছয় বছরের এক বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে বিপুল উৎসাহে উনারা গেলেন পিরানীর বাড়ি।১৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে পিরানির সাক্ষাত পেলেন।বেগানা পুরুষ ও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের সামনে তদবির করলে পিরাকির এ্যাকশন চলে যাবে বিধায় উনি সবসময় পর্দার অন্তরালে অবস্থান করেন।উনার অনুমতি সাপেক্ষে ছোট ছেলেটি কেবল উনার ডেরায় প্রবেশ করতে পারলো।

মগভর্তি স্বচ্ছ পানিতে ফু দিয়ে ছেলেটিকে চোরের অবয়ব দেখানো হল আর সবার সুবিধার্থে পর্দার ভিতর থেকে চোরের একটা কাল্পনিক বর্ননা দিলেন।

ছেলেটা একবার বলে সে কিছুই দেখতেছে না আবার বলে কি যেন ঝাঁপসা দেখা যায়।পিরানী মহিলার ধমক খেয়ে বলে হ দেখতেছি একটা মহিলা টাকা চুরি করে দৌড়াচ্ছে।বাসায় আসার পরে তার সামনে আছিয়া, সাফিয়া যারেই আনা হয় সে বলে তারেই দেখেছে মগের ভিতর।আমার বুয়ারা তো রেগেমেগে আগুন।টাকা উদ্ধারের কোন লক্ষণ দেখা না গেলেও বিনোদনের কোন কমতি ছিলনা।

পরদিন ঢাকা যাব।শাজান আমাদেরকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে বললো….. মামি আপনার সাথে একটা জরুরি প্রাইভেট কথা আছে।জরুরি কথাটা হল…. হারানো টাকাটা না পাওয়াতে সে খুবই মর্মাহত।ঘর থেকে টাকা খোয়া গেছে এইটা তাদের সবার জন্য বিরাট প্রেস্টিজ ইস্যু।তার কাছে এক গরম রুটিপীরের খবর আছে,উনার তাবিজ লিখা রুটি সত্যিকারের চোরের গলায় আটকে যাবে ও গলা দিয়ে রক্তক্ষরণ হবে যতক্ষণ না চুরির কথা সে স্বীকার করবে।শাজানের ভাষ্যমতে লোহা ও লেটলেটা কাঠালের মত জিনিসও গলা দিয়ে নামলেও রুটি বাবাজির রুটি চোরব্যাটা গলধঃকরণ করতে টের পাবে কত ধানে কত চাল।রুটিবাবাজির কেরামতি দেখার জন্য আমি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।শাজান এই ফাঁকে আমাকে খরচাপাতির বিষয়টা ও জানিয়ে দিল।আমি বললাম কোন সমস্যা নাই উদ্ধার হওয়া টাকার পুরোটাই তোমাদেরকে দিয়ে দিব।এইটা থেকে রুটি বাবাজির পেমেন্ট ও তোমাদের বাদবাকি খরচ বুঝে নিবা।পুরো বিষয়টা কর্তার কাছে চেপে গেলাম ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে।ঢাকা থেকে এসে দেখি ময়লা রুটির উপরে আরবি হরফে কি সব যেন লিখা।শুভক্ষণ দেখে রুটি ভক্ষন হবে।কিন্ত কে কে খাবে?ওরাই বললো ওরা পাঁচজন খাবে।আমি বললাম তোমরা বড় চারজন খাও রোজিনা ছাড়া।

সে ছোট মানুষ ওর এসব খাওয়ার দরকার নাই।ওমা!!রোজিনা তো দ্বিগুন আগ্রহে বলে নানি আমি খামু!বললাম খা,গলা দিয়ে রক্ত আসলে আমি কিচ্ছু জানিনা।তার উল্টা জবাব আমি তো চোর না আমার গলায় রুটি আটকাইবো না।ঠিক সন্ধ্যার পর পরই সকল আয়োজন সম্পন্ন হল সবাই এইবার রুটি খাবে।দর্শক বিচারক আমি একলাই।আমার ছেলে ছাড়া পরিবারের বাকি সদস্যরা আমার এসব আজাইরা কাজে সমর্থন জানাবেনা।তাই সবার অনুপস্থিতিতে শুরু হল রুটি ভক্ষন।পড়বিতো পড় মালির ঘাড়ে, অসময়ে কর্তার আগমন বিঘ্ন ঘটালো।কোনমতে কর্তাকে রুমে বসিয়ে টিভি ছেড়ে দিলাম সাউন্ড বাড়িয়ে।সবার আগে শাজান একেবারে ওজু টজু করে রেডি।চলছে রুটি ভক্ষন।ইতিমধ্যে দুজন গিলে ফেলেছেন,তৃতীয় জন গিলার পথে, চতুর্থ জন আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন, পঞ্চম জন শাজান মিয়া কিছু করতে পারতেছেন না যতবারই গলধঃকরন করতে চেষ্টা করেন ততবার ই আটকায়।এরমধ্যে টেটনা রোজিনা বলে উঠে…… শাজান মামা ই চোর,আমরা সবাই তো গিলে ফেলেছি,সে তো গিলতে পারতেছেনা।লজ্জায়, অপমানে রেগেমেগে শাজান রোজিনারে দিল এক ধমক……..তুই বেটি চুপ, আমি চুরি করলে কি রুটি পড়া আনতাম?আমি বললাম এইসব বাদ দিয়ে রুটি বাবাজিরে ধর উল্টা টুটকা করতে হবে।গলা দিয়ে ব্লিডিং হলে তো উপায় নাই।শাজান কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো “মামানি আমি চুরি করি নাই।”
কিছুটা কৌশলে টাকাটা হয়তো উদ্ধার করা যেত,কিন্তু শাজানের বোকামি আর আগলঠাইয়ামির কারনে টাকাও উদ্ধার হলোনা উপরূন্ত তার নিজের উপরে চুরির অপবাদ পড়লো।চোর বহাল তবিয়তে ধরা ছোয়ার বাইরে থাকলো।

(বিঃদ্রঃ রুটি পড়া, চাল পড়া দিয়ে কখনো চোর ধরা পড়েনা। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হল সত্যিকারের চোর জোর করেই গিলে ফেলে। গরিব, সহজ সরল মানুষকে ঠকিয়ে রুটি বাবারা মাঝখান থেকে টুপাইস কামায়।)

(লিনু ফারজানা গল্পকার মুক্ত চিন্তার মানুষ )

Advertisement